উৎপাদনক্ষমতা না বাড়াতে পারলে নতুন প্রযুক্তি বা বিনিয়োগ আনা যাবে না

Author Topic: উৎপাদনক্ষমতা না বাড়াতে পারলে নতুন প্রযুক্তি বা বিনিয়োগ আনা যাবে না  (Read 826 times)

Offline Mrittika Shil

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 213
  • Test
    • View Profile
  Collected-          http://bonikbarta.net/bangla/news/2017-09-21/131901/%E0%A6%89%E0%A7%8E%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A6%A8%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%AE%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%A4%E0%A7%81%E0%A6%A8-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AF%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%AC%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%8B%E0%A6%97-%E0%A6%86%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BE/


অর্থনীতিবিদ; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, সোয়াস, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়। পড়াশোনা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে অর্থনীতিতে পিএইচডি সম্পন্ন করেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কর্মজীবন শুরু অক্সফোর্ডের কর্পাস ক্রিস্টি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের জুনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে। প্রভাষক ও ফেলো ছিলেন কেমব্রিজের সিডনি সাসেক্স কলেজের। ১৯৯৬-২০০১ সময় পর্বে প্রভাষক ছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সোয়াসের। পরবর্তীতে সোয়াসের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন, করছেন। ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের। জাতিসংঘের কমিটি অব এক্সপার্টস অন পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (সিইপিএ), বিশ্বব্যাংকের প্যানেল অব এক্সপার্টস অন পলিসি ইমপ্লিমেন্টেশন এবং জোসেফ স্টিগলিটজ কর্তৃক গঠিত ইনিশিয়েটিভ ফর পলিসি ডায়ালগ (আইপিডি) টাস্কফোর্সের সদস্য ছিলেন। উন্নয়ন, অর্থনীতি, রাষ্ট্র, রাজনীতি, শিল্পসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার সঙ্গে কথা হয় বণিক বার্তার। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন এম এম মুসা ও আবু সাঈদ
আমরা উন্নয়নের জন্য যে পথে এগোচ্ছি, তা নিয়ে আপনার মত কী?

উন্নয়নের অর্থ সার্বিকভাবে মানুষের আয় বাড়বে এবং জীবনযাত্রার মান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা উন্নত হবে। উন্নয়ন মানুষের জন্য। মানুষের ভালো হবে বলেই আমরা উন্নয়নের কথা বলি। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাব কোন ধরনের দেশ দ্রুত উন্নয়ন করেছে এবং তাদের উন্নয়ন এমনভাবে হয়েছে যে, তাতে জনগণের বৃহদাংশ উপকৃত হয়েছে, মাথাপিছু আয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মান বেড়েছে। এ ধরনের উন্নতি কোন ধরনের দেশে হয় এবং এর অন্তরায়গুলো কি এবং কোন কোন দেশে এমনটা হয় না, তা নিয়ে বিতর্ক এবং অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এ নিয়ে অনেক বক্তব্য রয়েছে, যেগুলো ঠিক না এবং তা আমাদের ভুল পথে নিয়ে যায়। বিদেশ থেকে যারা পড়ে আসে, অথবা বাইরের দেশের যারা আমাদের পরামর্শ দেয়, তা অনেক সময় ঠিক হয় না। এটা আমাদের মতো দেশে অনেক ধরনের কনফিউশন তৈরি করে। প্রথমত. আমাদের দেশে সব থেকে প্রচলিত তত্ত্ব হচ্ছে, বাজারকে উন্মুক্ত করলে এবং প্রতিযোগিতা বাড়ালে নতুন প্রযুক্তি আসবে, দেশ-বিদেশ থেকে বিনিয়োগ বাড়বে। এ ধারার সমর্থকদের কথা হলো, কীভাবে বাজার অর্থনীতিকে আরো সুসংগঠিত করা যায় এবং বাজার ব্যবস্থাকে আরো কার্যকর করা যায়। এটাকে আমাদের এখানে বাজার সম্প্রসারণের প্রধান নীতি হিসেবে দেখা হয় এবং বলা হয় এভাবে উন্নয়ন হবে। এখন বাজারকে সম্প্রসারণ করতে দরকার সুশাসন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনের জটিলতা হ্রাস ইত্যাদি। এটা যে একেবারে ভুল তা নয়। আইনের শাসন না থাকলে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ থাকলে ও আইনের ব্যাপক জটিলতা থাকলে স্বাভাবিকভাবেই বিনিয়োগ হবে না। বাজারকে চলমান রাখা ও মোটামুটি ভালোভাবে কাজ করানোর জন্য এটা প্রয়োজনীয় কিন্তু যথেষ্ট নয়। মনে রাখতে হবে, বাজার তত্ত্বের সমালোচনার মানে এই নয় যে, আমরা বাজার অর্থনীতি চাই না। আমি যে ধারায় কাজ করছি, তাকে হেট্রোডক্স ইকোনমিকস বলা হয়। এ ধারায় আমরা বলছি, এটা যথেষ্ট নয় এই কারণে যে, আপনি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বাজারকে এমন জায়গায় নিয়ে আসতে পারবেন না, যেখানে সব ধরনের অন্তরায় ও সমস্যা ব্যক্তিগত লেনদেনের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। এটাকে আমরা অর্থনীতির ভাষায় বলি মার্কেট ফেইলিওর। মার্কেট ফেইলিওর মানে হচ্ছে, এমন অনেক ধরনের বিনিয়োগ ও কর্মকাণ্ড রয়েছে, যা উন্নয়নের জন্য আবশ্যক, যা ভলানটারি কন্ট্রাক্টিং অর্থাত্ বিভিন্ন মার্কেট প্লেয়াররা স্বেচ্ছায় একটি চুক্তিতে আসবে, তার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব না। কিন্তু আমাদের মতো দেশে যতই আইন সরল এবং বাজার ভালো করার চেষ্টা করা হোক, বিনিয়োগগুলো এত জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ যে, এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা ও পলিসি সাপোর্ট ছাড়া শুধু বাজারভিত্তিক চুক্তির ওপর নির্ভর করলে যথেষ্ট উন্নয়ন হবে না। আমরা যদি গত ৬০-৭০ বছরের সবচেয়ে সফল দেশগুলোর দৃষ্টান্ত দেখি, যারা দ্রুত নিম্ন থেকে মধ্যম এবং মধ্যম থেকে উন্নত আয়ের পথে দ্রুত এগোচ্ছে, তবে সেখানে পাব দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, চীন প্রভৃতি দেশকে। এসব দেশে বাজার অর্থনীতি ছিল কিন্তু তার সঙ্গে ছিল একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও সহায়ক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। রাষ্ট্র ব্যবস্থা শুধু সহায়ক নীতি প্রণয়ন করেনি, বাস্তবায়নও করতে পেরেছে। এ বাস্তবায়ন করার পেছনে এক ধরনের শাসন ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমন্বয় ছিল। সুন্দর নীতি তৈরি করা হলো কিন্তু বাস্তবায়নের রাজনৈতিক শক্তি নেই, তাহলে তা কোনো কাজে আসবে না। এসব দেশ যেসব কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো তারা বাস্তবায়নও করতে পেরেছে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নাইজেরিয়ার মতো দেশে সঠিক নীতি ঠিকই নেয়া হচ্ছে কিন্তু বাস্তবায়নের জায়গায় সাংঘাতিক দুর্বলতা রয়েছে। এবং ক্ষমতাশীল গোষ্ঠী অর্থনীতির সহায়তাগুলোকে এমনভাবে ক্যাপচার করে নেয় যে, এতে উন্নয়ন যতটা উচিত তা হয় না।
এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের করণীয় কী?

আমাদের মতো দেশে রাষ্ট্রের করণীয় কী ও কীভাবে বাজারকে সহায়তা করবে, সেখানে অনেকগুলো বিষয় রয়েছে। যেমন— প্রায় সব অর্থনীতিবিদ একমত যে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত পুরোপুরি বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে যতটা ব্যাপক উন্নয়ন দরকার, তা কোনো দেশেই হবে না। ব্যক্তিমালিকানায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাত থাকতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রের সহায়তায় কাজ করছে এমন একটা খাতও দরকার। বিশ্বব্যাংকসহ উদারনৈতিক অর্থনীতিবিদরাও একই কথা বলবে। রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত কিছু কাজ রয়েছে। সফট ইনফ্রাস্ট্রাকচার, যেমন— স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মানবসম্পদ তৈরি। আবার হার্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচারের কিছু কাজ রয়েছে, যেমন— সড়ক, সেতু প্রভৃতি নির্মাণ। তবে আমার মতো অর্থনীতিবিদরা যোগ করবে যে, রাষ্ট্রকে দেখতে হবে নতুন সেক্টর তৈরি ও নতুন প্রযুক্তি আনার ক্ষেত্রে অন্তরায়গুলো কোথায়। আমি ও আমার মতো অর্থনীতিবিদরা মনে করে যে, উন্নয়নশীল দেশে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে কাজ করার পদ্ধতির অভাব। এর ইংরেজি হচ্ছে অর্গানাইজেশনাল ক্যাপাবিলিটি। যেমন— আমার মেশিন ও শ্রমিক আছে, কিন্তু যৌথ টিম ওয়ার্কের অভাব রয়েছে। একটি পণ্যের ন্যূনতম মান থাকতে হবে। প্রতিযোগী দেশ যে দামে উৎপাদন করছে, সে দামে অথবা আরো কম দামে পণ্য উৎপাদন করতে হবে। ব্যয়ের দিক থেকে প্রতিযোগিতামূলক হতে হবে। বাজারের যে মান রয়েছে, তার মতো হতে হবে। একটি উন্নয়নশীল দেশে নতুন কিছু উদ্ভাবন করছে না। অন্য দেশে যা রয়েছে, আমাকে নিয়ে এসে তা কাজে লাগাতে হবে। এফিসিয়েন্ট ফ্যাক্টরি আরেক দেশে যেভাবে কাজ করছে, এখানেও তা করতে হবে। আর এটাই হচ্ছে সব থেকে কঠিন কাজ। বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাত প্রতিযোগিতামূলক। কারণ আমরা এ সেক্টরে মোটামুটি এফিসিয়েন্ট ফ্যাক্টরি চালাতে শিখেছি এবং আমাদের মজুরি অনেক কম। অথচ মেশিন একই হলেও উৎপাদনশীলতা যুক্তরাষ্ট্র বা দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ। এটা কোনোভাবেই একজন একক শ্রমিকের দক্ষতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। আমাদের দেশে একক শ্রমিকের অনেক ক্ষেত্রে যথেষ্ট দক্ষতা রয়েছে। কিন্তু যেটার অভাব, তা হচ্ছে টিমের দক্ষতা। যখনই একাধিক মানুষ একসঙ্গে কাজ করে, তখন একজনের উৎপাদনশীলতা আরেকজনের উৎপাদনশীলতার ওপর নির্ভর করে। আমার প্রডাকশন লাইনে যদি ঠিকভাবে পণ্য না আসে তবে আমি যতই দক্ষ হই না কেন আউটপুট কমে যাবে। এটাই হচ্ছে মূল জায়গা, যেখানে আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। যৌথ কাজটা আমরা ভালোভাবে অথবা শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে করতে পারি না। পুরো প্রতিষ্ঠান যেভাবে কাজ করার কথা, সেভাবে কাজ করানো যাচ্ছে না। এর সমাধান না করতে পারলে উৎপাদনক্ষমতা বাড়বে না। উৎপাদনক্ষমতা না বাড়াতে পারলে নতুন প্রযুক্তি বা বিনিয়োগ আনা যাবে না। আমার মতে, এটি এক নম্বর সমস্যা, যেটাতে অর্থনীতিবিদ বা নীতিনির্ধারকরা নজর দিচ্ছেন না। কিছু দেশে দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। এর প্রধান কারণ তাদের রাষ্ট্রীয় সহায়ক নীতিমালা এ সমস্যা অতিক্রম করার জন্য কাজ করছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নীতিমালা অনুযায়ী রাষ্ট্র যেটা করতে চাচ্ছে, সেটা বাস্তবায়ন করার রাজনৈতিক ক্ষমতা তার রয়েছে কিনা। কারখানা সর্িঠকভাবে চালানো অত্যন্ত কঠিন কাজ। কারখানা চালানোর সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো সমাধানে আমাদের করে করে শিখতে হবে, যেটাকে বলে লার্নিং বাই ডুয়িং। জার্মানিতে একটি কারখানা যেভাবে চলে, একই কারখানা বাংলাদেশে হুবুহু নকল করে চালানো যাবে না। বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনুযায়ী কীভাবে কারখানার বিভিন্ন অংশগুলোকে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে কাজ করানো যায়, তা শিখতে হবে। এটা খুব কঠিন কাজ। অর্থ কিংবা শ্রমিক জোগাড় কঠিন না, কারখানাকে সুন্দরভাবে চালানো সব থেকে কঠিন কাজ। এজন্য আপনাকে অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশের মতো দেশ যখন ভর্তুকি দেয় বা কোনো শিল্পকে রক্ষার চেষ্টা করে, তখন দেখা যায় বিনিয়োগকারীরা যথেষ্ট কসরত করেন না। সাধারণভাবে উচিত হলো, সুযোগ পেয়ে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিয়ত কসরত করতে হবে। কিন্তু দেখা যায়, ঋণসহ অন্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক যোগাযোগ শুরু করা হয়। চেষ্টা করা হয়, ছয় মাসের জন্য দেয়া সংরক্ষণ সুবিধা যাতে সারা জীবন পাওয়া যায়। কীভাবে ঋণ ফেরত না দেয়া যায়, তার চেষ্টা চলে। এভাবে উদ্যোগটা রাজনৈতিক লাইনে চলে যায়। টাকা, ভর্তুকি, সংরক্ষিত বাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীরা বসে থাকে, তখন আর উৎপাদন বাড়ে না, শিশু শিল্প কোনো দিন সবল শিল্পে পরিণত হয় না। এখানেই সবচেয়ে বড় পার্থক্য সফল উন্নয়নমুখী রাষ্ট্রের সঙ্গে। দক্ষিণ কোরিয়া, চীনে শিশু কারখানাগুলো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়। কেন বড় হয়, এটা বোঝাতে দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। দেশটি ষাটের দশকে বড় বড় শিল্পে ভর্তুকি, স্বল্প সুদে ঋণ (ওই সময় সব ব্যাংক পাবলিক সেক্টরে ছিল), সংরক্ষিত অভ্যন্তরীণ বাজার, রফতানির জন্য বড় আকারের ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল, কিন্তু শর্ত ছিল, একটা নির্দিষ্ট সময়ে যেমন ছয় মাস বা এক বছরের মধ্যে উৎপাদনক্ষমতা বাড়াতে হবে। কয়েক বছরের মধ্যে সরকারি সাহায্য উঠিয়ে নেয়া হবে। আর কেউ যদি এটা না করতে পারে, সে শুধু ঋণ, ভর্তুকি বা সুযোগই হারাবে না, বরং কোম্পানিটাই হারাবে। অথচ আমাদের দেশে আমরা ঋণটাই ফেরত নিতে পারি না। রফতানিতে পণ্যের গুণগত মান ও উৎপাদন ব্যয় সহজে ধরা যায়। আমি ১০০ টাকা ভর্তুকি পাচ্ছি, আমাকে ৫ শতাংশ বেশি রফতানি করতে হবে। এর অর্থ আমাকে উৎপাদন ব্যয় কমাতে হবে। ওই ভর্তুকিতে যদি আমাকে আরো বেশি রফতানি করতে হয় তবে এই ব্যয়ে পারা যাবে না। আবার নিম্ন মানের পণ্য রফতানি করা যায় না। আমি যদি ভর্তুকিটাকে ফিক্সড রাখি এবং রফতানি লক্ষ্যকে বৃদ্ধি করি, তবে আমাকে কসরত করে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতেই হবে। ওই সময় দক্ষিণ কোরিয়ায় ফেল করা চেইবল কোম্পানির (যেমন স্যামসাংয়ের মতো হোল্ডিং কোম্পানিগুলো) পুরো প্লান্টের মালিকানা আরেক চেইবল কোম্পানির কাছে চলে যায়। এমনটা দু-একবার করার পর পরবর্তীতে এর আর প্রয়োজন পড়েনি। কারণ বিনিয়োগকারীরা বুঝে গেছিল যে, শর্ত না মানলে তাদের রক্ষা নেই। কারণ সরকার এটা করবেই। সুতরাং বিনিয়োগকারীরা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সব রকম কসরত শুরু করে। এখানেই আমাদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য। আমরা একই প্রকার সুবিধা দিচ্ছি কিন্তু উৎপাদন বাড়ছে না। কারণ যারা এসব নিচ্ছে, বড় বড় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক মহলে, ব্যাংকে তাদের অনেক জানাশোনা, তারা একটা লাইন করে ফেলে, তাদের আর কিছুই হয় না।

এমন পদক্ষেপের জন্য তো প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হতে হয়...

প্রতিষ্ঠানও শক্তিশালী না, আবার আমাদের রাজনীতিটাও ভিন্ন। ওইসব দেশ যেটা করেছিল, আমরাও তা করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তাদের বাস্তবায়ন করার মতো রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল, আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশ নেই। ষাটের দশকে ছিল না, এখন তো আরো নেই। এখন রাজনীতিকরণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কোনো সেক্টর আর বাদ নেই। রাজনীতি ব্যবহার করে সুবিধা পাওয়া গেলে তো আর করসত করতে হচ্ছে না। এটাই মূল সমস্যা। রাজনীতির সঙ্গে নীতির সমন্বয় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ওই সময় দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা চীনে ব্যাপক দুর্নীতি ছিল। কিন্তু দুর্নীতি সত্ত্বেও উন্নয়ন হয়েছে। টিম প্রডাক্টিভিটি, অর্গানাইজেশনাল ক্যাপাবিলিটি বেড়েছিল। কারণ ওই সময় যারা শাসক ছিল, তারা এমনভাবে ক্ষমতায় এসেছে যে, তাদের বৈধতা রয়েছে। গণতন্ত্র থাকুক বা না থাকুক, তাদের বৈধতা ছিল এবং ক্ষমতার বাইরে যারা ছিল, তাদের দ্বারা সহজে উত্খাতের সম্ভাবনা ছিল না। যারা ক্ষমতাশালী ছিল, তারা সবাই সরকারের সঙ্গেই ছিল। আর নিচের শ্রেণীর ওপর, যেমন— আমলাদের ওপর শাসক শ্রেণীর শক্ত নিয়ন্ত্রণ ছিল। শাসক শ্রেণী নিশ্চিত ছিল যে, তারা বৈধ এবং সহজে কেউ তাদের হটাতে পারবে না। তাই তারা দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিকোণ থেকে কাজ করছিল। এবং আমলাতন্ত্রের ওপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করার ক্ষমতাও ছিল। দক্ষিণ কোরিয়ায় আরেকটি বিষয় হলো, কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারি সহায়তা পেয়ে বিশাল মুনাফা করছে; তখন রাষ্ট্র বলল, এই মুনাফার একটি অংশ আমি চাই, তবে আইনগত উপায়ে নয়। এটাকে ঘুষও বলা যেতে পারে। তখনকার প্রেসিডেন্ট পাক চুন হে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাপ্ত অংশকে তার সমর্থকদের মাঝে ভাগ করে দিতেন। এটাকে বলে প্রফিট শেয়ারিং দুর্নীতি। প্রফিট শেয়ারিং দুর্নীতি হচ্ছে রাষ্ট্র বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করছে এবং ভাগ চাচ্ছে। এ ধরনের দুর্নীতি উৎপাদনক্ষমতা কমায় না। এটা হয়তো অবাঞ্ছনীয়। কর হিসেবেও এ অর্থ নেয়া যেত, তবে এ ধরনের দুর্নীতি হলেও তা উন্নয়নকে থামিয়ে দেয় না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে লোকটা লক্ষ্য পূরণ করতে পারছে না, সে কোনো ঘুষ দিয়ে বাঁচতে পারছে না। এর উত্তর খুবই সহজ। পাক চুন হের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, আমি যদি জানি লোকটা ব্যর্থ হয়েছে এবং হবে, তাহলে কেন তাকে সহায়তা দেব। এর চেয়ে বরং যে লোক বেশি সফল, দক্ষ, পারদর্শী ও উৎপাদনশীল, তাকে সহায়তা করলে ওর থেকে বেশি মুনাফা পেতে পারব। এ কথাগুলো কিন্তু ষাট-সত্তরের দশকের। এখন কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া আইনের শাসনের দেশ। দুর্নীতি করলে জনগণ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার উত্খাত করবে। চীনে এখনো এ ধরনের দুর্নীতি চলছে কিন্তু কমে আসছে। বাংলাদেশে এটা সম্ভব নয়। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকেও ছিল না, এখনো নয়। কারণ যে সরকারই আসুক না কেন কেউ আশ্বস্ত বোধ করে না যে, তারা এতটাই বৈধ যে তাদের কেউ সরাতে পারবে না। এছাড়া ক্ষমতার বাইরে যারা ক্ষমতাবান থাকে, তাদের পেছনেও যখন বড় জনসমর্থন থাকে, তখন সরকার দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিকোণ নিতে পারে না। যেকোনো মুহূর্তে অবস্থান পরিবর্তন হওয়ার শঙ্কা থাকে। এমতাবস্থায় আমি কি সব সম্পদ এখানে রাখব না কিছু বিদেশে পাচার করব? এজন্য অর্থ পাচার হয়ে আসছে। আর শাসকগোষ্ঠী নিচের তলার লোকদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। যখন দলের মধ্যে কিছু অংশ কোনো অক্ষম ব্যবসায়ীকে রক্ষা করতে চায়, তখন নেতা চাইলেও থামাতে পারে না। এজন্য আমাদের দেশে অনেক অক্ষম, অযোগ্য ব্যবসায়ী ভর্তুকি ও ঋণ নিয়ে বসে আছে, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে জানলেও রাষ্ট্রনায়ক বা প্রধানমন্ত্রীর এটা থামানোর কোনো উপায় নেই। এটাই হচ্ছে পার্থক্য। আমাদের দেশের দুর্নীতি অযোগ্য ও অক্ষম কোম্পানিগুলোকে টিকিয়ে রাখে।
শিল্পকে শক্তিশালী করতে হলে কী করতে হবে?

নিজেদের ব্র্যান্ড চাইলে নিজেদের কম্পোনেন্ট ইন্ডাস্ট্রি গড়তে হবে। এটা না থাকলে অ্যাসেম্বেলর হয়েই থাকতে হবে। ভারতের গাড়ি শিল্প এর বড় উদাহরণ। ভারত গাড়ি শিল্প বিকাশের সময় নিজেদের কম্পোনেন্ট ইন্ডাস্ট্রির ওপর জোর দিয়েছিল। বিদেশী কোম্পানিগুলোকে নিজ দেশে নিয়ে এসে ঠিকই কিন্তু তাদের দেশের উৎপাদিত কম্পোনেন্ট ব্যবহার করারও শর্ত দিয়েছিল। এভাবে নব্বইয়ের দশকে ভারতের কম্পোনেন্ট ইন্ডাস্ট্রি রফতানিযোগ্য হয়ে ওঠে। এরপর দেশী প্রতিষ্ঠানগুলো যখন দেখল এখানে সব কম্পোনেন্ট পাওয়া যায়, এখন শুধু গাড়ির ডিজাইন লাগবে, তখন তারা এগিয়ে আসতে শুরু করে। বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাজ শিখে এখন নিজেরাই নিজেদের ব্র্যান্ড তৈরি করেছে। এমনটাই হওয়া উচিত। এ কাজ করতে গিয়ে ভারত শিখল অর্গানাইজেশনাল ক্যাপাবিলিটি। কোয়ালিটি কন্ট্রোল, ইনভেনটরি ম্যানেজমেন্ট, প্রডাক্টিভিটি কীভাবে বাড়াতে হবে— এটাই হচ্ছে জাদু। এ জাদুটা না শিখে আমরা যতই উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্র ক্রয় করি না কেন, তা ফলপ্রসূ হবে না। বরং উৎপাদন কম থাকবে, বেশির ভাগ পণ্য প্রত্যাখ্যান হবে, কোয়ালিটি খারাপ হবে। সরকার আগে থেকে ভর্তুকি দেবে, উদ্যোক্তা তার উৎপাদনক্ষমতা বাড়াবে, আর উদ্যোক্তা যদি উৎপাদনক্ষমতা না বাড়ায়, তাহলে সরকার ভর্তুকি তুলে নেবে— বাংলাদেশের মতো দেশে এ ব্যবস্থাটা কখনো কাজ করবে না। যখন একবার উদ্যোক্তাকে ভর্তুকি প্রদান করা হয়, এরপর ওই উদ্যোক্তার ওপর চাপ দেয়া বা ভর্তুকি নিয়ে নেয়ার কোনো বিধান নেই। আমরা যদি আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশটা বুঝতে পারি এবং প্রশ্ন করি যে, এ পরিবেশে কীভাবে আমরা উৎপাদনক্ষমতা বাড়াব, নতুন সংগঠন নিয়ে আসব, পোশাক কারখানাকে উন্নত করব, ইলেকট্রনিকস ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করব কিংবা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশী মোটরসাইকেল ইন্ডাস্ট্রি কীভাবে তৈরি করব? উত্তরটা হচ্ছে, আমরা যতদিন রেফ্রিজারেটরের কম্প্রেসার তৈরি করতে না পারব, ততদিন দেশে ফ্রিজের ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়াবে না। এটা হচ্ছে ব্যবসায়ের কম্পোনেন্ট বা সাহায্যকারী উপাদান। বাংলাদেশে যদি কম্প্রেসারের বাজার না থাকে, আমরা তা রফতানি করতে পারব। আমরা এ বিষয়টি এখনো বুঝতে পারিনি যে, কোন ধরনের শিল্পে কম্পোনেন্ট শিল্প তৈরি করতে হবে। আর এটা বুঝতে না পারাই হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় অন্তরায়।
আমাদের শিখতে হবে নিজেদের পোশাক কারখানা কিংবা ভারতের অটো-ইন্ডাস্ট্রির উদাহরণ থেকেও। একজন বিদেশী বিনিয়োগকারীকে আমরা ইনসেনটিভ দিতে পারি। যেমন— মজুরি বৃদ্ধির কারণে চীন বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিকস ইন্ডাস্ট্রি থেকে সরে যাচ্ছে। তারা এখন ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ায় নতুন জায়গা খুঁজছে ওই প্রযুক্তিগুলো প্রতিস্থাপনের জন্য। তবে বাংলাদেশে কেউ আসছে না। এ অবস্থায় আমাদের যা করা উচিত তা হলো, নিজেদের দক্ষতা, বাজার ইত্যাদির ওপর জরিপ করে দেখা যে, চীনের প্রযুক্তিগুলোকে আমরা কাজে লাগাতে পারব কি না। জরিপটা যদি সেই পণ্যের জন্য ইতিবাচক হয়, তখন আমাদের উচিত চীনকে আমাদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের সঙ্গে চুক্তি করা যে, চীনের ওই ইন্ডাস্ট্রিটা, যা তারা এখন আর চালাতে পারছে না, তা আমাদের এখানে নিয়ে আসতে চাই। তবে শর্ত হলো, একজন বাংলাদেশীর সঙ্গে যৌথভাবে তাদের এ ব্যবসাটা করতে হবে এবং তারা আমাদের রফতানিযোগ্য ইলেকট্রনিকস কম্পোনেন্ট তৈরি করে দেবে। পণ্যটি যখন রফতানি শুরু হবে, তখন শর্ত অনুযায়ী চীনের ওই কোম্পানিকে অর্থ পরিশোধ করা হবে, তাকে বড় ধরনের বাড়তি মুনাফা দেয়া হবে এবং কোম্পানিটি বাংলাদেশী মালিকানায় চলে আসবে। আরো একটি বিষয়ের দিকে লক্ষ রাখতে হবে যে, আন্তর্জাতিক বাজারে সুনাম রয়েছে এমন ধরনের কোম্পানি খুঁজে আনতে হবে। আমরা যদি সুজুকিকে এখানে নিয়ে আসি, তাহলে কিন্তু তারা রফতানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন করবে। কারণ ওরা চাইবে না বাজারে ওদের সুনাম নষ্ট করতে। এক্ষেত্রে আমাদেরও পণ্যের মান নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তাই বিদেশী কোম্পানির ক্ষেত্রে শর্তটা এমন রাখতে হবে যে, কোম্পানিটিকে আগে বিনিয়োগ করতে হবে। তবে সে যদি সফলতা পায় তাহলে এর বদলে আমরা তাদের একটা ভালো মূল্য পরিশোধ করব।
আমাদের এ পদ্ধতিটাকে রপ্ত করতে হবে, আর সে জন্য আমাদের যারা নীতি নির্ধারক, বিনিয়োগকারী রয়েছে, তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। একটি শিল্পকে ঘিরে শুধু এর প্রযুক্তি নয়, সাংগঠনিক দিকগুলো শিখতে হবে আমাদের। বুঝতে হবে গ্লোবাল ভ্যালু চেইনের বিষয়টিও। পণ্যটির ক্রেতা কে, কাকে বিক্রি করা হচ্ছে এবং মান সম্পর্কে জানতে হবে। মান আর মূল্য দুটোর সমন্বয় করতে হবে, যা নির্ভর করছে অর্গানাইজেশনের ওপর। তাই রাষ্ট্রকে এমন একটি নীতিনির্ধারণ করতে হবে, যা আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়নযোগ্য।

আমরা চীন কিংবা কোরিয়ার মতো একসঙ্গে দশটা নতুন শিল্প তৈরি করতে পারব না, তবে আমরা যদি পাঁচ বছরে একটি করে নতুন সেক্টর তৈরি করতে পারি, তা আমাদের জন্য যথেষ্ট। শুধু পোশাক শিল্প নিয়ে পড়ে থাকলে আমরা অচিরেই বিপর্যয়ে পড়তে পারি। দীর্ঘসময় ধরে একই মানের পণ্য সরবরাহ করছি আর এখানেও ক্রমাগত চাপ আসছে। আমরা মনে করছি, ম্যানেজ করে নেব। আমাদের চিন্তা থেকে ‘ম্যানেজ’ করার এ প্রবণতা কমাতে হবে