একাকী মায়ের মনের যুদ্ধ

Author Topic: একাকী মায়ের মনের যুদ্ধ  (Read 769 times)

Offline Raihana Zannat

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 392
  • Test
    • View Profile
একাকী মায়ের মনের যুদ্ধ
« on: December 21, 2017, 10:31:13 AM »
শহুরে জীবনে অভ্যস্ত মানুষের নানা ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা যাচ্ছে। ১২ ডিসেম্বর কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত মনোরোগবিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ রকম সমস্যার মধ্যে উঠে এসেছে ঢাকা শহরের একাকী মায়েদের মানসিক অবস্থার কথাও। গবেষণায় দেখা গেছে যে বিভিন্ন রকম সামাজিক, মানসিক চাপ মোকাবিলা করে জীবনে এগিয়ে যেতে হয় একাকী মায়েদেরতখন আমার বয়স কতইবা হবে, ২৮ কি ২৯ বছর। হঠাৎই জানতে পারি, আমার স্বামী গোপনে আরেকজনকে বিয়ে করে দিব্যি আরেকটা সংসার করছেন। এমন ভয়ানক সত্য আচমকা সামনে এসে পড়ায় টালমাটাল হয়ে গিয়েছিলাম সেটা অস্বীকার করব না। স্বামীর এই লুকানো বিয়ের কথা জেনে শুধু মনে হয়েছিল, এই সংসারে আর না। দুই ছেলেমেয়ের কথা ভেবেই মনটা শক্ত করেছি। মনে হয়েছে, এই পরিবেশে বড় হলে ওদের স্বাভাবিক মানুষ হওয়া বাধাগ্রস্ত হবে। আমার স্বামী সাফ বলে দিয়েছিলেন, তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে, তা না হলে সন্তানদের বা আমার কোনো ভরণপোষণ তিনি দেবেন না। আমারও জেদ চেপেছিল, কীভাবে তখন এত জোর এসেছিল মনে কে জানে। দুই সন্তানকে নিয়ে ১৫ বছরের সাজানো সংসার ছেড়ে চলে এসেছিলাম। সংসার চালানো, সন্তানদের বড় করা—একাই যুদ্ধ করেছি নিজের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে। নিজের মনের কথা পড়াও তখন বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সন্তানেরা বড় হলো। তাদের নিজের জগৎ তৈরি হয়েছে। মা হিসেবে আমি সার্থক, সন্তানদের মনের মতো করে মানুষ করতে পেরেছি। আজকাল খুব একা লাগে। মনের দিকে তাকালে ধু ধু ফাঁকা মরুভূমি, সেখানে শুধু ধূসরতা, বিবর্ণতা। সিঙ্গেল মায়ের এই যুদ্ধ বাইরে থেকে বোঝা কঠিন।’ একটানে কথাগুলো বলে কিছুক্ষণ দম নিলেন জোয়াইরিয়া আহমেদ (ছদ্মনাম)। বোঝাই যাচ্ছে, তিনি একজন সিঙ্গেল বা একাকী মা, স্বামীর বিন্দুমাত্র সাহায্য ছাড়াই সন্তানদের বড় করেছেন।

বয়স ষাটের ঘর ছুঁইছুঁই জোয়াইরিয়া আহমেদকে বছর খানেক আগে গ্রাস করে ফেলেছিল বিষণ্নতা। দীর্ঘদিন মনের মধ্যে দুঃখ–কষ্ট চেপে রাখতে রাখতে আচমকা কেমন বদলে গিয়েছিলেন। ছেলেমেয়েরা তাঁদের এই কঠিন মনোবলের অধিকারী মায়ের পরিবর্তনে কিছুটা অবাক হয়েছিলেন। শরণাপন্ন হয়েছিলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের। কাউন্সেলিং নেওয়ার পর এখন বেশ ভালো আছেন জোয়াইরিয়া।
১২ ডিসেম্বর কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত হয়েছিল মনোরোগবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব সাইকিয়াট্রি ২০১৭’। সেখানে শহুরে জীবনের মানুষের প্রতিদিনের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে অনেকগুলো অধিবেশন হয়। এগুলোর মধ্যে একটির বিষয় ছিল ঢাকা শহরের সিঙ্গেল মায়েদের মানসিক অবস্থা কেমন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগের অধ্যাপক ঝুনু শামসুন্নাহার এই গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ১৫৬ জনের মধ্যে জরিপ চালিয়ে তিনি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তবে তিনি এও বলেন, এ গবেষণার কাজ শেষ হয়ে যায়নি। এখনো গবেষণা চলছে।
সেই গবেষণার সূত্র ধরে দেখা যায় বেশির ভাগ সিঙ্গেল মা জোয়াইরিয়া আহমেদের মতো বিয়ের পর স্বামীর পরকীয়া, দ্বিতীয় বিয়ে বা নির্যাতনের কারণে সন্তানদের নিয়ে চলে এসেছেন। ঢাকা শহরে আলাদা থাকছেন, এমন সিঙ্গেল মায়ের হার ২১ দশমিক ২ শতাংশ, বিবাহবিচ্ছেদের কারণে ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ এবং স্বামী মারা যাওয়ার কারণে ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ একাকী মা মনের সঙ্গে যুদ্ধ চালাচ্ছেন। বেশ কিছু মা আছেন, যাঁরা সন্তানের সামাজিক স্বীকৃতি পাননি, আইনি প্রক্রিয়ায় বিয়ে করেননি, তবে সন্তানের মা হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি মনোসামাজিক সমস্যায় আছেন এই সিঙ্গেল মায়েরা।
আমার মন কেমন করে দিনরজনী
একটা অশান্তি, দুর্বিষহ পরিবেশ থেকে বের হয়ে এসে মনে করেছিলেন—যাক, রেহাই তো পাওয়া গেল। আসলে কি নিস্তার পাওয়া যায়? শুরু হয় নতুন যুদ্ধ। দেখা যায় ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সের মধ্যে এই একাকী জীবনের দিকে যেতে হয়েছে তাঁকে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য হলো যে সিঙ্গেল মায়েদের বেশির ভাগই, মানে ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ কর্মজীবী। সংসার, চাকরি ও সন্তান সামলাতে গিয়ে তাঁরা একসময় হাঁপিয়ে ওঠেন।
এই মায়েদের মনের যাতনা তাঁকে বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন করে ফেলে বেশি। অল্পতেই দুশ্চিন্তা করার প্রবণতা, অসামাজিক হয়ে ওঠা—এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয় কারও কারও মধ্যে। তাঁর যে মনের যত্ন প্রয়োজন, সেটা না একাকী মা অনুভব করেন, না তাঁর আশপাশের মানুষ।
যেহেতু একই সঙ্গে মা-বাবা দুজনের দায়িত্ব পালন করতে হয়, তাই কাজের চাপ বেশি থাকে। ১৫৬ জনের মধ্যে গবেষণা করে দেখা গেছে, ১০৭ জন অতিরিক্ত কাজের চাপে মানসিক চাপ বোধ করেন, ১০৬ জন অর্থনৈতিক চাপে আছেন এবং ৫৮ জন সামাজিক অপদস্থতা ও অপমানের কারণে কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। তবে আশার কথা হলো, এই একাকী মায়েরা তাঁদের বাবার পরিবার থেকে বেশির ভাগ সময় সমর্থন পেয়ে থাকেন। দেখা গেছে, সন্তানের দেখভালের ক্ষেত্রে সেই হার ৪৯ দশমিক ৪ শতাংশ, আন্তরিক সমর্থন পান ৫০ দশমিক ৬ শতাংশ এবং পুরোপুরি আর্থিক সমর্থন পান ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ। কেউ কেউ স্বামী মারা গেলে শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছুটা সমর্থন-সহযোগিতা পেয়ে থাকেন, তবে সেই হার খুবই কম।
বাবার বাড়ি থেকে সমর্থন পেলেও কথা শুনতে হয় অনেক সিঙ্গেল মাকে। মাহফুজার (ছদ্মনাম) কথাই ধরা যাক। ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন; যা বেতন পান, তা দিয়ে সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে পারেন না। গ্রামে মায়ের কাছে রাখতে হয়। তা নিয়েও দুকথা কম শুনতে হয় না তাঁকে। হতাশ হয়ে তিনি বললেন, ‘আমি নাকি সিঙ্গেল মা-ই না! নিজের সন্তানকে মায়ের কাছে রেখেছি। একদিন ছুটি পেলেই ছুটে যাই সন্তানের কাছে। আমার মনের হাহাকার, কষ্ট কেউ বোঝে না। ছুটির সময় সবাই বন্ধুদের নিয়ে ঘোরে, নিজেদের মতো সময় কাটায়। আর আমি সন্তানকে সময় দিই। ফুরফুরে হাসিখুশি থাকলেও দোষ যেন আমারই। মাঝেমধ্যে ক্লান্ত লাগে। মনে হয়, সব ছেড়েছুড়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যাই।’

একাকী মায়ের পাশে
একাকী মায়ের সবচেয়ে বেশি দরকার সমর্থন, নিজের জন্য, সন্তানের জন্য। অধ্যাপক ঝুনু শামসুন্নাহার মনে করেন, সিঙ্গেল মায়ের আবেগীয় সহায়তা কাছের মানুষ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে আর্থিক নিরাপত্তাও দিতে হবে।
একাকী মায়েরা যেন মানসিকভাবে ভালো থাকেন, সেটা খেয়াল রাখার দায়িত্ব আসলে সবার। অনেক তারকা মা যেমন হলিউড অভিনেত্রী সান্দ্রা বুলক, অস্কার বিজয়ী অভিনেত্রী হ্যালি বেরি সিঙ্গেল মা হিসেবে তাঁদের সন্তানকে বড় করছেন। হ্যালি বেরি মনে করেন, সিঙ্গেল মাকে অনেক ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। এই মায়েদের পেশাগত সন্তুষ্টি জরুরি। সিঙ্গেল মায়ের কষ্ট তিনি খুব বোঝেন। হ্যালি বেরি নিজেও একজন সিঙ্গেল মায়ের সন্তান। এটা নিয়ে তিনি গর্ববোধও করেন।
একাকিত্ব যেন একাকী মায়ের জীবনে, মনের জোরে ছন্দপতন না ঘটায়, তার জন্য মনের যত্ন নিতে হবে। যাতে তেজোদীপ্তভাবে নিজের স্বপ্ন, ইচ্ছা পূরণ করতে পারেন। জীবনের দাঁড় টানতে গিয়ে মনের দ্বার বন্ধ করা যাবে না।
(collected)
Raihana Zannat
Senior Lecturer
Dept. of Software Engineering
Daffodil International University
Dhaka, Bangladesh