গ্রাম পুলিশের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে কবে?

Author Topic: গ্রাম পুলিশের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে কবে?  (Read 742 times)

Offline kekbabu

  • Jr. Member
  • **
  • Posts: 78
  • Test
    • View Profile
    • https://daffodilvarsity.edu.bd/
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু    |    প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৭; 'যুগান্তর'; পৃ. ৪
গ্রাম পুলিশের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে কবে?
বাংলা সাহিত্যের সুসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পণ্ডিত মশাই’ গল্পের কথা অনেকেরই মনে আছে। তৎকালীন উপমহাদেশে যখন ইংরেজদের শাসন চলছিল, তখন তারা ক্ষমতার মঞ্চে অধিষ্ঠিত হয়ে ধীরে ধীরে এ উপমহাদেশের ভাষা ইংরেজিতে রূপান্তর করে। সেই যুগে ইংরেজি শিখলে ভালো চাকরি পাওয়া যেত। আর ইংরেজি শেখা সহজলভ্যও ছিল। প্রথমদিকে মুসলমান জনগোষ্ঠী ইংরেজিকে বিজাতীয় ভাষা মনে করে তা বর্জন করত। নানা সুবিধা দেখে এ দেশের হিন্দুরা ইংরেজি ভাষাশিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করে। চতুর্দিকে ইংরেজি শিক্ষার যখন জয়-জয়কার পড়ে গেল, তখন ইংরেজরা কিছু জায়গায় হাইস্কুল স্থাপন করল। আর এসব স্কুলে স্থান হয় বাংলা ও সংস্কৃত বিষয়ের কিছু শিক্ষকের (পণ্ডিত)। তবে দেখা গেছে, অন্য শিক্ষকদের চেয়ে পণ্ডিত মশাইদের পড়াশোনা বেশি, জ্ঞান-গরিমা বেশি; অথচ তাদের পারিশ্রমিক অনেক কম। ফলে তখনকার পণ্ডিত মশাইদের খেয়ে-না খেয়ে কোনোমতে জীবন ধারণ করতে হতো।
তৎকালীন পণ্ডিত মশাইদের জীবন-বাস্তবতার সঙ্গে বর্তমান সময়ের গ্রাম পুলিশদের মিল অনেক। গ্রাম পুলিশ বিধিমালা ২০১৫ অনুযায়ী একজন গ্রাম পুলিশকে যেসব দায়িত্ব পালন করতে হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে : ১. দিনে ও রাতে ইউনিয়নে পাহারা ও টহলদারী করা, ২. অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বিষয় অনুসন্ধান ও দমন করা এবং অপরাধীদের গ্রেফতার করতে পুলিশকে সহায়তা করা, ৩. চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদকে সরকারি দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা, ৪. পনেরো দিন পরপর এলাকার অবস্থা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবহিত করা, ৫. ইউনিয়নের খারাপ চরিত্রের লোকদের গতিবিধি লক্ষ করা এবং সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবহিত করা, ৬. পাশের এলাকা থেকে আগত কোনো সন্দেহজনক ব্যক্তির উপস্থিতি সম্পর্কে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবহিত করা, ৭. ইউনিয়নে লুকিয়ে থাকা কোনো ব্যক্তি, যার জীবন ধারণের জন্য প্রকাশ্য কোনো আয় নেই বা যে তার নিজের পরিচয় সম্পর্কে সন্তোষজনক কোনো জবাব দিতে পারে না, এমন লোক সম্পর্কে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে রিপোর্ট প্রদান করা, ৮. বিরোধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বা তুমুল কলহ সৃষ্টি করতে পারে এবং জনগণের শান্তি বিঘিœত করতে পারে- এমন বিষয় বা ঘটনা সম্পর্কে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবহিত করা, ৯. দাঙ্গা-হাঙ্গামা, গোপনে মৃতদেহ সরিয়ে জন্ম-সংক্রান্ত তথ্য গোপন করা, কোনো শিশুকে বাড়ি থেকে বের করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া, আগুনের সাহায্যে সংঘটিত ক্ষতি, বিষ প্রয়োগে গবাদিপশুর অনিষ্ট বা ক্ষতি করা, নরহত্যা বা আত্মহত্যার চেষ্টা সম্পর্কিত অপরাধের ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবহিত করা, ১০. আমলযোগ্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি বা যার বিরুদ্ধে যথার্থ অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে বা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়া গেছে বা কোনো অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে, এমন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পুলিশকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করা, ১১. জন্ম ও মৃত্যু রেজিস্টার সংরক্ষণ এবং জন্ম ও মৃত্যু সম্পর্কে ইউনিয়ন পরিষদকে অবহিত করা, ১২. মানুষ বা পশু বা ফসলের মধ্যে কোনো মহামারী বা সংক্রামক রোগ বা পোকার আক্রমণ ব্যাপক আকারে দেখা দিলে দ্রুত ইউনিয়ন পরিষদকে এ সম্পর্কে অবহিত করা, ১৩. কোনো বাঁধে বা সেচে ক্ষতি বা ত্রুটি দেখা দিলে দ্রুত ইউনিয়ন পরিষদকে অবহিত করা, ১৪. সরকারি কাজের উদ্দেশ্যে যে কোনো স্থানীয় তথ্য সরবরাহ করা, ১৫. খাজনা বা ভূমি উন্নয়ন কর, স্থানীয় কর, ফি বা অন্য পাওনা সংগ্রহ ও আদায়ে রাজস্ব কর্মচারীদের সহায়তা করা, ১৬. কোনো অপরাধ সংঘটন বা সংঘটনের অভিপ্রায় সম্পর্কে জ্ঞাত হলে তা ইউনিয়ন পরিষদকে অবহিত করা, ১৭. ইউনিয়ন পরিষদের বা ইউনিয়ন পরিষদের অধিকারে ন্যস্ত কোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষতিসাধন বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি বা অন্যায় দখল সম্পর্কে ইউনিয়ন পরিষদকে অবহিত করা এবং এ ধরনের ক্ষতি, প্রতিবন্ধকতা বা অন্যায় দখল রোধ করার জন্য মধ্যস্থতা করা, ১৮. ইউনিয়ন পরিষদের নির্দেশে কোনো বাসিন্দার আবাসস্থল বা সম্পত্তির ওপর পরোয়ানা জারি করা, ১৯. এলাকার বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা, ২০. অস্বাভাবিক মৃত্যু বা খুনের ক্ষেত্রে লাশ পাহারা দেয়া এবং থানায় পৌঁছানো পর্যন্ত লাশের সঙ্গে থাকা, ২১. এলাকায় পুলিশ এলে সবসময় পুলিশের সঙ্গে থাকা, ২২. উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা গ্রাম পরিদর্শনে এলে তাদের সার্বিক সহায়তা করা, ২৩. আদালতের মামলা-মোকদ্দমার তারিখ জারি এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের আদেশ অনুসারে কাজ করা, ২৪. গ্রাম আদালতে বিচার চলাকালে উপস্থিত থাকা ইত্যাদি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উপরোক্ত দায়িত্ব পালন করার পর একজন গ্রাম পুলিশ যদি মাস শেষে মাত্র তিন হাজার ছয়শ’ টাকা বেতন পান, তাহলে তা দিয়ে তিনি কীভাবে সংসার চালাবেন? বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে একজন গ্রাম পুলিশ যখন মাত্র তিন হাজার ছয়শ’ টাকা বেতন পান, তখন তা আদি যুগের স্কুলের পণ্ডিত মশাইদের মাসিক পাঁচ টাকা বেতনের কথাই যেন স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রত্যেক সচেতন ব্যক্তিকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, মাসিক তিন হাজার ছয়শ’ টাকায় বর্তমান সময়ে কোনো ব্যক্তির পক্ষে সংসার চালানোসহ জীবন নির্বাহ করা সম্ভব কিনা? উত্তর আসবে, না, সম্ভব নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে মাসিক তিন হাজার ছয়শ’ টাকা বেতন দিয়ে সংসার চালানো, জীবন ধারণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এর ওপর যদি গ্রাম পুলিশের ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে, তাহলে ওই গ্রাম পুলিশের চোখে সরষের ফুল দেখা আর হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না।
স্থানীয় সরকারের তথ্যানুসারে, দেশে বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদের সংখ্যা ৪ হাজার ৪৪৫। প্রতিটি ইউনিয়নে একজন দফাদার ও ৯ জন মহল্লাদারের সমন্বয়ে গ্রাম পুলিশ রয়েছে। সেই হিসাব অনুযায়ী দেশে গ্রাম পুলিশের সংখ্যা ৪৫ হাজার ৪৫০। গ্রাম পুলিশদের বেতন-ভাতার মধ্যে ৫০ শতাংশ সরকার দেয় এবং বাকি ৫০ শতাংশ দেয় ইউনিয়ন পরিষদ। সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়েছে ২০১৬ সালে। কিন্তু জাতীয় বেতন স্কেলে এখন পর্যন্ত গ্রাম পুলিশের বেতন-ভাতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আর এখানেই গ্রাম পুলিশদের দুঃখ সবচেয়ে বেশি। গ্রাম পুলিশ কর্মচারী ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা অনেক আগে থেকেই জাতীয় বেতন স্কেলে গ্রাম পুলিশদের অন্তর্ভুক্ত করার জোর দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু ফলাফল এখন পর্যন্ত শূন্য। বলাবাহুল্য, এত কম বেতনে চাকরি করে খেয়ে না-খেয়ে তারা বেঁচে থাকছেন। গ্রেড যাই হোক না কেন, জাতীয় বেতন স্কেল পেতে চান গ্রাম পুলিশরা। এ বিষয়ে এমপি-মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা একের পর এক আশ্বাস দিলেও গ্রাম পুলিশদের ভাগ্যের এখন পর্যন্ত পরিবর্তন হয়নি। দুঃখের বিষয়, একাধিক এমপি-মন্ত্রী গ্রাম পুলিশ সংক্রান্ত সংগঠনের উপদেষ্টা হলেও এক্ষেত্রে গ্রাম পুলিশদের কোনো লাভ হচ্ছে না।
খোঁজ নিলে দেখা যাবে, বর্তমানে গ্রাম পুলিশরা সবচেয়ে বেশি মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অন্যসব পেশায় অধিকার আদায়ে সংশ্লিষ্টরা রাজপথে নামতে পারলেও এ পেশার মানুষরা শুধু পোশাকের কারণে আন্দোলন করতে পারছেন না। আবার এত কম বেতন দিয়ে তাদের জীবন-সংসারও চলছে না। বিষয়টি যেন ‘না পারা যায় কইতে, না পারা যায় সইতে’ অবস্থার মতো। বর্তমান সরকার সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়েছে, যা নিঃসন্দেহে একটি ভালো পদক্ষেপ। বর্তমান বাজারমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার গ্রাম পুলিশদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে তাদের ভাগ্য উন্নয়নে এগিয়ে আসবে, এটাই প্রত্যাশা।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.jugantor.com/sub-editorial/2017/12/24/181876/%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE-%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%A8-%E0%A6%98%E0%A6%9F%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A7%87?
Dr. Kudrat-E-Khuda (Babu).
Associate Professor (Dept. of Law), Daffodil International University;
International Member of Amnesty International;
Climate Activist of Greenpeace International; Column Writer;
Mobile Phone: +8801716472306
E-mail: kekbabu.law@diu.edu.bd