ওয়েব নির্ভর কম্পিউটিং-এর দিকে ঝুঁকছে প্রযুক্তি বিশ্ব
সময়ের সাথে সাথে খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে প্রযুক্তি বিশ্বের দৃশ্যপট। প্রচলিত কম্পিউটিং ডিভাইস আর কম্পিউটিং-এর ধরণে গত এক দশকে এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। সামনের দিনগুলোতে এই পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত থাকবে আরও দ্রুতগতিতে। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমানে ওয়েব নির্ভর কম্পিউটিং নিয়ে চলছে জোর গবেষণা। আর তাতে ভবিষ্যত্ প্রযুক্তি বিশ্বে প্রচলিত অপারেটিং সিস্টেমের বিকল্পে ওয়েব ব্রাউজার নির্ভর অপারেটিং সিস্টেমের স্থান দখল করা এখন সময়ের ব্যাপার বলেই ধারণা প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের।
গত শতাব্দীর সত্তর দশকের কথা। বিশ্ব প্রথমবারের মতো দেখল এমন এক কম্পিউটার যন্ত্র, যার ব্যবহার কেবল গবেষকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মানুষের ব্যক্তিগত কাজেও ব্যবহার করা যায় এই যন্ত্র। তারপর থেকে দ্রুতই বদলে যেতে থাকল দৃশ্যপট। একবিংশ শতাব্দীতে এসে সেই কম্পিউটার এখন মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র যা ছাড়া চলে না এক মুহূর্তও। সময়ের সাথে সাথে বদলে গেল সেই কম্পিউটারের রূপ। এখন সেই কম্পিউটার চলে এসেছে মানুষের হাতের মুঠোয়। আর কম্পিউটার পরিচালনার পদ্ধতি, অর্থাত্ কম্পিউটিং-এর ধরনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আর বর্তমান সময়ে তো প্রচলিত অপারেটিং সিস্টেম ছাড়াই ওয়েব নির্ভর অপারেটিং নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো।
অপারেটিং সিস্টেমের বির্বতন
পার্সোনাল কম্পিউটারের সেই শুরুর দিকে অপারেটিং সিস্টেমগুলো এখনকার মতো ছিল না। সেই সময়ের অপারেটিং সিস্টেমগুলো ছিল কমান্ড লাইন দ্বারা পরিচালিত। গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস তখন ছিল না। সেই সব অপারেটিং সিস্টেমের মধ্যে মাইক্রোসফটের এমএস ডস ছিল বহুল ব্যবহূত একটি অপারেটিং সিস্টেম। তারপরের সময়গুলোতে মাইক্রোসফট, আইবিএম এবং অ্যাপল অপারেটিং সিস্টেমের বিবর্তনে রেখেছে মুখ্য ভূমিকা। এর বাইরে অবশ্য ওপেন সোর্স নির্ভর ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেমও সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস নির্ভর প্রথম বহুল ব্যবহূত এবং জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেমটির নাম অ্যাপল-এর ম্যাকওএস। ১৯৮৪ সালে প্রথম ম্যাক ওএস ব্যবহূত হয় অ্যাপল এর পিসিতে। পরে ১৯৮৫ সালে মাইক্রোসফট নিয়ে আসে আরেক জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ। সেই থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত অপারেটিং সিস্টেমের জগতে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা চলে আসছে অ্যাপল আর মাইক্রোসফটের মধ্যেই। ম্যাক আর উইন্ডোজের নতুন নতুন সংস্করণ নিয়েই বিশ্ব কম্পিউটারকে পেয়েছে অত্যন্ত সহজ এবং ব্যবহারবান্ধব একটি ডিভাইস হিসেবে। এর বাইরে অবশ্য লিনাক্স নির্ভর অপারেটিং সিস্টেমগুলোও গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেসকে আত্মীকরণ করে নেয়। আর বিনামূল্যের ওপেন সোর্স নির্ভর লিনাক্সের নানান সংস্করণও ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে।
ইন্টারনেট প্রসার এবং অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে নতুন ভাবনা :
টিম বার্নস লি’র ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব আবিষ্কারের পর থেকে খুব দ্রুত বিশ্ব চলে আসে মানুষের হাতের মুঠোয়। ইন্টারনেটের প্রসারে এখন গোটা বিশ্ব এখন ওয়েব ব্রাউজারে বন্দি। ইন্টারনেটের প্রসারে এখন গোটা বিশ্ব যেন ইন্টারনেট ছাড়া চলেই না। ইন্টারনেট ছাড়া কল্পনা করা যায় না একটি দিনও। এরই মধ্যে বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা পেরিয়ে গেছে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশী। ইন্টারনেটের এই প্রসার খুব দ্রুত বদলে দিয়েছে কম্পিউটিং-এর চেহারা। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এখন মানুষকে সম্পূর্ণভাবে সব ধরনের কম্পিউটিং সুবিধা দেবার দিকে টেনে নিয়েছে। সম্প্রতি গোটা প্রযুক্তি বিশ্বই ঝুঁকে পড়েছে ইন্টারনেট নির্ভর ক্লাউড সার্ভিসের দিকে। এর ফলে পিসি’র নানান সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে এখন ক্লাউড হয়ে উঠছে অন্যতম প্রযুক্তি প্রবণতা। এখন ক্লাউডেই সংরক্ষণ করা যাচ্ছে তথ্য, ক্লাউড সার্ভিসে যে কোনো ডিভাইস থেকে সেই তথ্যে অ্যাকসেসও করা যাচ্ছে। ইন্টারনেট নির্ভর নানান প্রোগ্রাম আর অনলাইন গেম তো রয়েছেই। কম্পিউটার নির্ভর প্রায় সব ধরনের কাজ করার জন্যই প্রচলিত প্রোগ্রাম এবং অ্যাপ্লিকেশনের পাশাপাশি রয়েছে বিকল্প অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন বা প্রোগ্রাম।
তবে এখানেই থেমে নেই প্রযুক্তি বিশ্বের কর্ণধাররা। তাদের লক্ষ্য এখন ওয়েব নির্ভর অপারেটিং সিস্টেমের দিকে। প্রচলিত অপারেটিং সিস্টেমের বাইরে গিয়ে ইন্টারনেট নির্ভর এই অপারেটিং সিস্টেম দিয়েই আগামী দিনের কম্পিউটারগুলো পরিচালনা করতে চান তারা। তাদের এই চিন্তা ইতোমধ্যেই বাস্তবায়নের পর্যায়েও নিয়ে এসেছে তারা। টেক জায়ান্ট গুগল এর মধ্যেই উন্মোচন করেছে তাদের ওয়েব নির্ভর অপারেটিং সিস্টেম ‘ক্রোমিয়াম ওএস’ বা সংক্ষেপে ‘ক্রোম ওএস’। উন্নতসব ওয়েব ব্রাউজার আর ওয়েব নির্ভর প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজগুলোর অগ্রগতি ‘ক্রোম ওএস’ এর মতোই আরো সব ওয়েব নির্ভর অপারেটিং সিস্টেম নিয় আসবে বলেই ধারণা করছেন প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা।
ওয়েব নির্ভর
অপারেটিং সিস্টেম
আধুনিক সব ওয়েব ব্রাউজার এখন আর কেবল ওয়েব ব্রাউজারই নয়, নিজেই একটি কম্পিউটিং ইউনিটে পরিণত হয়েছে। নানান ধরনের অ্যাড-অনস, প্লাগ-ইনস, এক্সটেনশন আর অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে তারা এখন কম্পিউটিং-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। সেখান থেকে ওয়েব নির্ভর অপারেটিং সিস্টেমের জন্যও তারা অনেকটাই প্রস্তুত বলে মনে করেন ‘অপেরা সফটওয্যার’ চিফ ডেভেলপমেন্ট অফিসার ক্রিস্টেন ক্রগ।
‘জেড নেট এশিয়া’কে দেয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাত্কারে তিনি ওয়েব নির্ভর অপারেটিং সিস্টেমের সময় খুব দ্রুতই চলে আসবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। ওয়েব নির্ভর অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে তিনি বলেন, ‘ওয়েব ব্রাউজার নির্ভর অপারেটিং সিস্টেমের যে ধারণার সূচনা হয়েছে, তা ব্রাউজার অ্যাপ্লিকেশনগুলোর উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। আর ডেডিকেটেড নানান অ্যাপ্লিকেশনও নির্দিষ্ট অপারেটিং সিস্টেমের চেয়ে ওয়েব প্লাটফর্মে ভাল কাজ করে। ক্যালেন্ডার, ই-মেইল, আবহাওয়া বিষয়ক অ্যাপ্লিকেশন প্রভৃতি এর উদাহরণ। আর ত্রিমাত্রিক গ্রাফিক্সের জন্য ওয়েব জিএল প্রযুক্তি এখন ডেভেলপারদের মাল্টিমিডিয়া কনটেন্টগুলো ওয়েব প্লাটফর্মেও দূর্দান্ত করে তৈরি করতে সহায়তা করছে। এর ধারাবাহিকতায় আমরা অনেক দিন থেকেই দেখে আসছি যে ওয়েব ব্রাউজারের গুরুত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় এটা বলাই যায়, ওয়েব নির্ভর অপারেটিং সিস্টেমের রাজত্ব শুরু হতে আর বেশি সময় লাগবে না।’
ক্রগ’র সাথে দ্বিমত পোষণ না করলেও কিছুটা ভিন্নমত অবশ্য রয়েছে অনেক প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরই। কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের দীর্ঘদিনের প্রচলিত অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারের অভিজ্ঞতা ওয়েব নির্ভর অপারেটিং সিস্টেমে তাদের স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাঘাত ঘটাবে বলেই মনে করেন তারা। তাছাড়া পরিপূর্ণ একটি অপারেটিং সিস্টেমের সব ধরনের ফিচারকে ওয়েব ব্রাউজারের অপারেটিং সিস্টেমে সংযুক্ত করার চ্যালেঞ্জে জয়ী হওয়াতে আরও কিছু সময় লাগবে বলেই তাদের ধারণা। এসকল ধারণাকেও অবশ্য নাকচ করে দেবার মতো বিশেষজ্ঞরা কম নেই। তাদের পর্যবেক্ষণে, মানুষ এখন প্রযুক্তির সাথেই অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আর নিত্য নতুন প্রযুক্তি আত্মীকরণে তারা উদগ্রীব। আর প্রযুক্তি বিশ্বের অগ্রগতির যে গতি, তাতে ওয়েব নির্ভর অপারেটিং সিস্টেমের যা কিছু দূর্বলতা রয়েছে এখন পর্যন্ত, তা কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় লাগবে না বলেই তারা মন্তব্য করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘ক্রোম ওএস’ এর সফল উন্মোচনও অবশ্য প্রমাণ করে পরের দলের কথা। তাছাড়া মাইক্রোসফটের নতুন চমক উইন্ডোজ ৮-এর অনেক ফিচারও রাখা হয়েছে ওয়েব নির্ভর। এসব প্রবণতা এটাই প্রমাণ করে যে, ওয়েব নির্ভর অপারেটিং সিস্টেমের রাজত্ব করা এখন আর কল্পনার স্থানে নেই।
দ্রুত বদলে যাওয়া প্রযুক্তি বিশ্বের দৃশ্যপটে ক্লাউড সার্ভিস যেমন পাকাপোক্ত আসন করে নিয়েছে, তেমনি নিকট ভবিষ্যতে যে ওয়েব নির্ভর অপারেটিং সিস্টেম তেমনি পাকাপোক্ত আসন তৈরি করতে সমর্থ হবে—সেটা অনুমান করাই যায়। ফলাফলটা সময়ই বলে দেবে।