কৃমি রোগ
কৃমি আমাদের দেশে একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা৷ যে কোনো বয়সের মানুষের কৃমি হতে পারে৷ তবে শিশু কিশোরদের মাঝে কৃমির সংক্রমণ বেশি দেখা যায়৷ অবশ্য ছোট শিশু যেমন - পঁাচ মাস বয়স পর্যন্ত, যখন শুধু মাত্র মায়ের বুকের দুধই পান করে, তখন সাধারণত কৃমি হয় না৷ আমাদের দেশের মানুষের সুতা কৃমি, কেঁচো ও হুক কৃমির সংক্রমণ বেশি হলেও ফিতা কৃমির সংক্রমণও দেখা যায়৷
কৃমি
কৃমি হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে ক্ষতিকর ও বৃহত্ পরজীবী৷ এটি মানুষের দেহে বাস করে এবং শরীর থেকে খাবার গ্রহণ করে বেঁচে থাকে ও বংশ বৃদ্ধি করে৷ কৃমি অনেক ধরনের আছে৷ তবে আমাদের দেশে কেঁচো কৃমি, বক্রকৃমি ও সুতা কৃমিতে আক্রান্তের হার বেশি৷
কৃমি কীভাবে ছড়ায়
বাংলাদেশের বেশিরভাগ লোকের জন্য কোনো প্রকার স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার ব্যবস্থা নেই৷ এসব লোক কঁাচা পায়খানা ব্যবহার করে এবং নদীতে, খালে, উণ্মুক্ত স্থানে মল ত্যাগ করতে অভ্যস্ত৷ ফলে পানি ও মাটিতে কৃমির ডিম ছড়িয়ে পড়ে৷ এসব মাটিতে ও পানিতে উত্পন্ন শাক-সবজি, ফল-মূল কঁাচা খেলে অথবা কৃমির ডিম বাহিত দূষিত পানি পান করলে কৃমির সংক্রমণ ঘটে৷ এছাড়া খালি পায়ে হঁাটার ফলে পায়ের নিচ দিয়ে হুকওয়ার্ম বা বক্রকৃমির লার্ভা শরীরে প্রবেশ করে কৃমি হতে পারে৷
সুতা কৃমি
পৃথিবীর সর্বত্রই সবচেয়ে বেশি সুতা কৃমির সংক্রমণ ঘটে৷ সুতা কৃমি ২ থেকে ১২ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের সাদা সুতার মতো চিকন৷ খাবারের সাথে পেটে গিয়ে সুতা কৃমি ক্ষুদ্রান্ত্রে অবস্থান করে কিন্তু প্রাপ্ত বয়স্ক সুতাকৃমিদের বৃহদন্ত্রের কোলনেই বেশি পাওয়া যায়৷ স্ত্রী কৃমি রাতের দিকে মলদ্বারের বাইরে এসে ডিম পাড়ে ও কামড়ায় ফলে মলদ্বার চুলকায়৷ সুতা কৃমি মেয়েদের প্রস্রাবের দ্বারেও চলে যেতে পারে ফলে সেখানেও চুলকায়৷ যখন চুলকায় তখন তার আঙুলের ভঁাজে ও নখের মধ্যে কৃমির ডিম ঢুকে যায়৷ তাছাড়া জামা-প্যান্ট, বিছানার চাদরেও কৃমির ডিম লেগে যেতে পারে৷ আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের মলদ্বারে চুলকিয়ে সে হাতে কিছু খেলে নিজের কাছ থেকে নিজেই এবং নোংরা হাতে ধরা খাবার অন্যরা খেয়ে কৃমিতে আক্রান্ত হয়৷ মলদ্বারে চুলকানি বেশি হয় বিশেষ করে রাতে বেলায়৷ মলদ্বারে চুলকানি থেকে শিশুর ঘুমের অসুবিধা হতে পারে তাছাড়া পেটের গোলমাল দেখা যায়৷ কখনও কখনও অপুষ্টি ও রক্তস্বল্পতাও হতে পারে৷ কারো কারো খাবারে রুচি চলে যায়৷
কেঁচো কৃমি
বাংলাদেশের মানুষের বিশেষ করে শিশুদের অপুষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ হলো কেঁচো কৃমির সংক্রমণ৷ দেখতে কেঁচোর মতো এবং পরিণত অবস্থায় ৬ থেকে ১৪ ইঞ্চি লম্বা হয়৷ কেঁচো কৃমির রঙ হালকা হলুদ৷ সাধারণত অপরিষ্কার শাকসবজি ফলমূল, নোংরা খাবার, দূষিত পানির মাধ্যমে কেঁচো কৃমির ডিম আমাদের মুখে প্রবেশ করে৷ সেখান থেকে খাদ্যনালীর ক্ষুদ্রান্তে এ ডিম চলে যায় এবং ক্ষুদ্রান্তের এনজাইম বা পাচকরসের মাধ্যমে ডিম থেকে লার্ভা বের হয়৷ লার্ভাগুলো রক্তের মাধ্যমে যকৃত, হৃদপিণ্ড এবং ফুসফুসে প্রবেশ করে৷ এরপর ফুসফুসের এলভিওলাই ছিদ্র করে শ্বাসনালী দিয়ে অন্ননালী পার হয়ে পাকস্থলীতে প্রবেশ করে ক্ষুদ্রান্ত্রে এসে পূর্ণতা লাভ করে এবং ডিম পাড়ে৷ পরিণত স্ত্রী কৃমি দৈনিক প্রায় ২ লাখ ডিম মানুষের মলের সাথে নিষ্কাশন করে৷ হাত-পা ঠিকমতো না ধুলে নখের মধ্যে বা আঙুলের ভঁাজে লেগে থাকা ডিম এবং অপরিষ্কার খাবার ও পানির মাধ্যমে আমাদের মুখে প্রবেশ করে৷ অর্থাত্ কেঁচোকৃমির সংক্রমণ ঘটে মল থেকে মুখে (Foeco-oral route) কেঁচো কৃমির সংক্রমণে অনেক সময় প্রথম দিকে কিছু বোঝা যায় না কিন্তু ধীরে ধীরে নানা রকম লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে৷ অন্ত্রে বেশি কেঁচো কৃমি থাকলে অস্বস্তিভাব, পেটফঁাপা, পেট ফুলে ওঠা, বদহজম, ক্ষুধামন্দা বা অরুচি, বমি বমি ভাব, ওজন কমে যাওয়া, পাতলা পায়খানা, আমমিশ্রিত মল, শুকনো কাশি, শ্বাসপ্রশ্বাসে দুর্গন্ধ, যকৃত প্রদাহ ইত্যাদি হতে পারে৷ কেঁচো কৃমি কখনো কখনো পিত্তনালীতে গিয়ে নালী বন্ধ করে দেয়, অগ্ন্যাশয় নালীতে গিয়ে নালী বন্ধ করে জন্ডিস, এপেন্ডিসে গিয়ে আটকে যেয়ে এপেন্ডিসাইটিস এর সৃষ্টি করতে পারে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশনই একমাত্র চিকিত্সা৷ মাঝে মাঝে ২/১ টি কৃমি বমির সঙ্গে মুখ দিয়ে বা পায়খানার সঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারে৷
বক্রকৃমি
হুক ওয়ার্মের মুখে হুক বা বড়শির মতো চারটি দঁাত রয়েছে এবং ২ থেকে ৬ ইঞ্চি লম্বা সবুজাভ-সাদা রঙের হয়ে থাকে৷ বক্রকৃমির ডিম মলের সঙ্গে বেরিয়ে আসে পরে আর্দ্র, ভেজা মাটিতে লার্ভায় পরিণত হয় এবং সংক্রমণ করার উপযুক্ত হয়৷ মাটিতে বা ঘাসে লেগে থাকা বাচ্চা কৃমি সাধারণত পায়ের তলার চামড়া ফুটো করে শরীরে প্রবেশ করে এবং ফুসফুসে থেকে শ্বাসনালী হয়ে অন্ননালীর ক্ষুদ্রান্ত্রে এসে পূর্ণতা পায় এবং অনবরত ডিম পাড়ে৷ যারা খালি পায়ে টয়লেটে, রাস্তায়, মাঠে হঁাটাচলা করে তাদের বক্র কৃমি বেশি হতে দেখা যায়৷ বিশেষত গ্রামাঞ্চলে মাঠেঘাটে মলত্যাগের প্রবণতা বেশি বলে সেখানেই এ কৃমির সংক্রমণ বেশি৷ বক্রকৃমি ক্ষুদ্রান্তে তার হুকের সাহায্যে রক্ত চোষে এবং রক্ত খেয়েই বেঁচে থাকে৷ একটি বক্রকৃমি প্রতিদিন প্রায় ০.২ মি. মি. রক্ত খায়৷ বক্রকৃমির সংক্রমণের লক্ষণ প্রধানত রক্তক্ষয় জনিত দুর্বলতা হিসাবে প্রকাশ পায়৷ বুক ও পেটের ব্যথা, বমি অনেকটা পেপটিক আলসার রোগের মতো মনে হয়৷ এছাড়া রক্তমিশ্রিত কাশি, প্রায়ই পাতলা পায়খানা, রক্তশূণ্যতা, আমিষস্বল্পতা, এমনকি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি বাধা প্রাপ্ত হতে পারে বিশেষ করে যারা কম খাবার খায়৷ বক্রকৃমি পায়ের তালুর চামড়া ফুটো করে প্রবেশ করায় পায়ের তালুর ত্বকে সংক্রমণ দেখা দেয় এবং পায়ের তালুতে ছোট ছোট গর্তের সৃষ্টি হয়৷
ফিতাকৃমি
ফিতাকৃমি দেখতে ফিতার মতো দীর্ঘ আকারের, ৫ থেকে ২৫ ফুট বা আরো বেশি লম্বা হয়৷ ছোট মাথার সঙ্গে অসংখ্য চেপ্টা খণ্ড (শসার বীচির মতো) একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত হয়ে এ কৃমির দেহ গঠিত হয়৷ সাধারণত পেটে একটি মাত্র ফিতাকৃমি থাকে তবে বেশিও থাকতে পারে৷ ফিতাক্িঋম ক্ষুদ্রান্ত্রে ডিম পাড়ে৷ মানুষের মলের সঙ্গে বেরিয়ে ফিতাকৃমির ডিম মাটিতে পড়ে থাকে কিংবা ঘাসে লেগে থাকে৷ গরু, মহিষ, শুকর মাঠে চরার সময় এ ডিমগুলো খেলে গরু,শুকরের ও মহিষের দেহে লার্ভা প্রবেশ করে এবং সিস্ট হয়ে মাংস পেশিতে বেঁচে থাকে৷ মানুষ এ সমস্ত গরুর মাংস অসিদ্ধ বা অর্ধসিদ্ধ করে খেলে সংক্রমিত হয়৷ যারা খুব শিক কাবাব খায় তাদের এ কৃমি হওয়ার আশংকা বেশি৷ অন্ত্রে ফিতাকৃমি থাকলে দেখতে অনেকটা শসার বিচির মতো মলের সঙ্গে বেরিয়ে আসে৷ বিপদ দেখা দেয় যখন মানুষের ব্রেনে বা মস্তিস্কে ফিতাকৃমি সিস্ট তৈরি করে৷ এ সিস্টগুলো মাথাব্যথা, খিঁচুনি, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন এমনকি মৃতু্যর কারণ হতে পারে৷
চিকিত্সা
কৃমির চিকিত্সা দেবার আগে মল পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া ভালো৷ যদি রোগীর মলে বা বমির সঙ্গে কেঁচো কৃমি বের হয়, রোগী যদি বলে যে রাতে তার মলদ্বার চুলকায়, মল পরীক্ষায় সুযোগ ও সামর্থ্যের অভাব, কিন্তু কৃমি আছে বলে সন্দেহ হয় তবে মল পরীক্ষা না করেও কৃমির ঔষধ দেওয়া যায়৷ চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী বয়স অনুযায়ী আলাদা আলাদা মাত্রায় ঔষুধ খেতে হবে৷
কারো কারো কৃমির ঔষধ খাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ, যেমন গর্ভবতী মহিলা, জ্বর ও ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী৷
প্রতিরোধ
* যেহেতু প্রতিরোধ চিকিত্সা অপেক্ষা অধিকতর ভালো তাই প্রতিরোধে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া উচিত৷
* জণ্মের পর প্রথম ৫ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে শুধু বুকের দুধ খাওয়াতে হবে৷
* মল নিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করতে হবে৷
* খাবার তৈরি, পরিবেশন এবং খাওয়ার পূর্বে সাবান দিয়ে অবশ্যই হাত ধুয়ে ফেলতে হবে
* মলত্যাগের পর সাবান বা ছাই দিয়ে অবশ্যই হাত ধুয়ে ফেলতে হবে৷
* নিয়মিত গোসল করা, পরিষ্কার জামা-কাপড় পড়া এবং নখ বড় হবার আগেই অবশ্যই কেটে ফেলা কারণ বড় নখের ভেতর কৃমির ডিম ঢুকে থাকে৷
* শিশুর সুতাকৃমি হলে তাকে সুতির জাঙ্গিয়া পরিয়ে শোয়ানো উচিত যাতে সে মলদ্বার হাত দিয়ে চুলকাতে না পারে৷
* ফুটানো পানি খাওয়া বা ব্যবহার করা এবং শাকসবজি ও ফলমূল ভালোভাবে ধুয়ে খাওয়া কেননা এগুলোতে কৃমির ডিম লেগে থাকতে পারে ৷
* খালি পায়ে মাঠে, রাস্তায় ও পায়খানায় না যাওয়া এবং শিশুকে যেতে না দেয়া৷ সর্বদা স্যান্ডেল পরে থাকার অভ্যাস করা উচিত৷
* অসিদ্ধ বা অর্ধসিদ্ধ মাংস না খাওয়া৷
* প্রতি চার মাস পরপর পরিবারের সকলকে বয়স অনুযায়ী নির্দিষ্ট মাত্রার কৃমির ঔষুধ খাওয়ানো উচিত৷ বাড়ির একজনের কৃমি থাকলে সকলেরই সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ তাই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে বাড়ির সবাইকে কৃমির ঔষধ খেতে হবে, বাড়ির কাজের মানুষটিও যেন বাদ না পরে৷
বহুল প্রচলিত কৃমি সম্পর্কিত ভুল ধারণা/ কুসংস্কার
* মিষ্টি খেলে কৃমি হয় - এটি ঠিক নয়৷ মিষ্টি খাওয়ার সঙ্গে কৃমি হওয়ার ব্যাপারটি কোনোভাবেই যুক্ত নয়৷ নোংরা খাবারের মাধ্যমে কৃমি হয় সেটা টকঝাল মিষ্টি যাই হোক না কেন৷
* পেটে কিছু কৃমি না থাকলে খাবার হজম হয় না - এটি একদম বাজে কথা৷ কৃমি কোনো উপকারই করে না, উল্টো বদহজম, ক্ষুধামন্দা ও পেটের রোগ সৃষ্টি করে৷
* কৃমির ঔষধ ঠাণ্ডার দিনে বা শীতকালে বা বৃষ্টির দিনে খাওয়াতে হবে - এটি ভুল ধারণা৷ এলোপ্যাথিতে কৃমির ঔষধ ঠাণ্ডা-গরম যে কোনো সময়ই খাওয়ানো যায়৷
ঔষুধ সেবন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে রেজিষ্টার চিকিত্সকের পরামর্শ নিন৷ অন্যথায় কোন সমস্যার জন্য ডি.নেট দায়ী থাকবে না৷
তথ্যসূত্র -
ড্রাগ ডিরেক্টরি