গ্রিক বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের নামটা অনেকেই জানেন সেই "ইউরেকা ইউরেকা" কথাটা মানে "আমি পেয়েছি" এর সুবাদে। রাজার মুকুটের ভেজাল ধরতে পারার কায়দাটা বের করে উত্তেজনার চোটে গোসল করা বাদ দিয়ে আর্কিমিডিস কাপড় চোপড় না পরেই রাস্তায় দৌড়ে বেরিয়ে গেছিলেন ইউরেকা বলতে বলতে। কিন্তু আর্কিমিডিসের অন্যান্য অনেক আবিষ্কারও আসলে বেশ ইন্টারেস্টিং। এর মাঝে আছে তাপ রশ্মি।
সাইন্স ফিকশন মুভ্যি যেমন স্টার ট্রেক বা স্টার ওয়ার্স দেখেছেন? ঐ যে, স্পেস শিপ থেকে লেজার কামানের মারণ রশ্মি ছুটে আঘাত করছে শত্রুর জাহাজে? মজার ব্যাপার হলো আজ থেকে দুই হাজারের বেশি বছর আগে আর্কিমিডিস খুব সহজ উপায়ে আর প্রতিদিনের ব্যবহার্য একটা জিনিষকে কাজে লাগিয়ে বানিয়ে ছিলেন ভয়াবহ মারণ তাপ রশ্মি -- বহু দূর থেকে তাপের হলকায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন আক্রমণকারী রোমান বাহিনীর জাহাজে।
আর্কিমিডিসের বাড়ি গ্রিসের সিরাকিউজে, সেখানে হামলা চালাতে আসে রোমান সৈন্যরা। খ্রিস্টপূর্ব ২১০-২১২ সালের কথা। জাহাজের পর জাহাজ নিয়ে করছে হামলা। দুর্বল রাজ্য সিরাকিউজের সবাই দ্বারস্ত হলো আর্কিমিডিসের। কোনো ভাবে কি আর্কিমিডিস রোমান জাহাজগুলোকে পারবেন ঠেকাতে?
আর্কিমিডিসের মাথায় খেলে গেলো দারুণ একটা বুদ্ধি। আর কিছু না, লাগবে তাঁর আয়না। একটা দুইটা না, অনেকগুলো। খটখটে রোদেলা এক দিনে আয়না হাতে দাঁড় করিয়ে দিলেন অনেকজন সহকারীকে। আয়নাগুলো বড়সড়। কিছু দূরে যেই না রোমান একটা জাহাজ এলো, আর যায় কোথায়, সবাই মিলে আয়নাটা তাক করলো এমনভাবে, সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে যাতে পড়ে সেই জাহাজের মাস্তুলের একটা জায়গাতে। আয়না একটা হলে প্রতিফলিত আলোয় তাপের পরিমাণ কমই হতো, কিন্তু এতোগুলো আয়নার সমবেত শক্তি কম না, মুহূর্তের মধ্যে সেই জায়গাটার তাপমাত্রা দাঁড়ালো কয়েকশ ডিগ্রি সেলসিয়াস, দাউ দাউ করে ধরে গেলো আগুণ। রোমানরা তো গেলো ভড়কে, কী এমন অদ্ভুত শক্তি নিয়ে বসে আছে সিরাকিউজের লোকজন, দূর থেকে ধরাচ্ছে আগুন? বেশ কয়েকটা জাহাজ হারিয়ে তারা শেষমেশ বিরতি দিলো আপাতত। যদিও দুই বছরের অবরোধ শেষে তারা ঠিকই এক সময়ে সিরাকিউজ জয় করে নেয়।
(আর্কিমিডিসের এই আবিষ্কারের গল্পটা কি সত্যি? কাঠে আগুন ধরাতে হলে লাগে অন্তত ৩০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা, রোদের আলো প্রতিফলিত করে সেটা করা সম্ভব? জনপ্রিয় টিভি সিরিজ মিথবাস্টারে এটা করার চেষ্টা করতে গিয়ে সফল হয়নি, কিন্তু ২০০৫ সালে MIT এর একদল ছাত্র অনেকগুলো আয়না বসিয়ে ঠিকই দূর থেকে কাঠের জাহাজে আগুন লাগাতে সক্ষম হয়, কাজেই ব্যাপারটা কারিগরিভাবে সম্ভব বটে)।
নিজের শহরকে বাঁচাতে আর্কিমিডিস এরকম আরো অনেক আবিষ্কার করেছিলেন, কিন্তু তাঁর মন পড়ে থাকতো জ্যামিতি আর গণিতে। জীবনের শেষ দিনটিতে আর্কিমিডিস বালির উপরে বৃত্ত্বের চিত্র এঁকে একটি জ্যামিতিক সমস্যা নিয়ে গভীর চিন্তায় ছিলেন মগ্ন। হঠাৎ সামনে পড়লো কারো ছায়া। রোমান এক সৈন্য তরবারী হাতে এসেছে। রোমান সেনাপতি মার্সেলাস আর্কিমিডিসের নাম জানতেন, সম্মানও করতেন। তাই সৈন্যদের প্রতি আদেশ ছিলো আর্কিমিডিসকে মার্সেলাসের দরবারে নিয়ে আসার। সৈন্যটি আর্কিমিডিসকে যাবার জন্য তৈরী হতে আদেশ দিলে আর্কিমিডিস বললেন, Nōlī turbāre circulōs meōs! অর্থাৎ "আমার বৃত্তগুলোকে নষ্ট করো না, আমি চিন্তা করছি"! হৃদয়হীন রোমান সৈন্যটির খুব রাগ হলো, কতো বড় সাহস এই আধ পাগল গ্রিক লোকটার, সেনাপতির আদেশ অমান্য করছে বালির উপরে আঁকিবুকির জন্য! তরবারির এক আঘাতে হলো আর্কিমিডিসের জীবনাবসান, ৭৫ বছর বয়সে জ্যামিতির সেই সমস্যটির কথা ভাবতে ভাবতে। সেনাপতি মার্সেলাস পরে এই ঘটনার কথা জানতে পেরে খুব মন খারাপ করেন, আর্কিমিডিস ছিলো তাঁর মতে জ্যামিতির জগতের দেবতুল্য প্রতিভা।
সিরাকিউজেই হয় আর্কিমিডিসের সমাধি, স্মৃতিফলক হিসাবে তাঁর প্রিয় জ্যামিতিক সমস্যা -- সিলিন্ডার আর বৃত্তের চিত্র আঁকা ছিলো পাথরে। কালের স্রোতধারায় সেই সমাধিটি গেছে হারিয়ে, কিন্তু ইউরেকা ইউরেকা বলা সেই প্রতিভাধর বিজ্ঞানীর কথা আমরা আজও মনে করছি ২২০০ বছর পরে। আরো বহুদিন মনে করবো।