ক্লাস ফাইভে আমি নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। স্কুল বাসে যেতাম আবার স্কুল বাসেই বাসায় ফিরে আসতাম। আমার বাবা আমাকে ভোর সকালে ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন। আমাকে উঠিয়ে দিয়ে তিনি মর্নিং ওয়াক করতে চলে যেতেন। আমি ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খেয়ে ঠিক ৬ টা বাজার ৫ মিনিট আগে বাসা থেকে বের হতাম। মজা লাগতো ঘড়িতে ৫ টা ৫৫ মিনিট ৫৫ সেকেন্ড দেখতে। বাসা থেকে একাই বের হয়ে মেইন রোডে যেতাম। তখন আমরা থাকতাম মোহাম্মাদপুরে। মোহাম্মাদপুর পোস্ট অফিসের সামনে দাড়িয়ে স্কুল বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকতাম। আমার বাবাও মর্নিং ওয়াক করে আমি যেখানে দাঁড়াতাম সেখানে আসতেন। আমাকে স্কুল বাসে উঠিয়ে দিয়ে তারপর বাসায় ফিরতেন। কোন কোন দিন তার আসার আগেই স্কুল বাস চলে আসতো। শীতকালে ভোর ৬ টায় কিছুটা অন্ধকারই থাকতো। তবে মনে পড়ে না যে কোনদিন বাসা থেকে একা একা মেইন রোডে যেতে ভয় লেগেছে। ভয় লাগতো শুধু রাস্তায় বেওয়ারিস কুকুর দেখলে।
স্মৃতি গুলো আমার মনে কত স্পষ্ট ভাবে আছে। যখন স্কুল বাসের জন্য অপেক্ষা করতাম দেখতাম বড় রাস্তার যানবাহন গুলো। প্রতিদিনই একই সময় স্কুল বাসের জন্য রাস্তায় দাড়িয়ে থাকতাম। আমাদের স্কুল বাস আসার আগে কোন কোন গাড়ী যায় সেইটাও মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। কয়েকটা পরিচিত গাড়ী-বাস যাওয়ার পরেই বুঝতাম এইবার আমাদের স্কুল বাস আসবে। আমাদের স্কুল বাসটা ছিল সবুজ রঙের। সামনে লেখা ছিল সুপিরিওর। আর পিছনে লেখা ছিল প্রগতির তৈরি। একসময় আমাদের স্কুল বাসের সামনের একটি হেডলাইট নষ্ট ছিল অনেক দিন। শীতকালে অন্ধকারে দেখে মনে হত মোটর সাইকেল আসতেছে। বাসটি শ্যামলী পার হলেই কল্যাণপুর থেকে মিরপুর রোড অনেক সরু হয়ে যেত। কল্যাণপুরে মিরপুর রোডে একটি ছোট ব্রিজ ছিল। যার নীচে দিয়ে ছোট নদী বয়ে যেত। নদীর দুই পাশে ছিল নিচু জায়গা। যেগুলো বর্ষাকালে পানিতে ডুবে যেত। যতটুকু মনে পড়ে তখনকার কল্যাণপুরের সাথে এখনকার বিরুলিয়ার কিছুটা মিল আছে।
আমাদের বাস এগিয়ে চলতো। আর পথে পথে স্কুলের ছাত্ররা বাসে উঠত। কল্যাণপুর ছাড়িয়ে বাস যেত টেকনিক্যাল হয়ে মিরপুর এক। তখন বাংলা কলেজের পরে মিরপুর এক পর্যন্ত পুরোটাই খালি ছিল। এরপর সনি সিনেমা হলের পাশ দিয়ে মিরপুর দশ হয়ে পল্লবি। সেখানে আমাদের বিশাল বাস ইউ টার্ন নিয়ে আবার মিরপুর দশ হয়ে বাম দিকে মিরপুর ১৪ হয়ে কাফ্রুল দিয়ে পরিশেষে ক্যান্টনমেন্টে স্কুলে পৌঁছুত। মিরপুর ১৪ এর বাম পাশের পুরোটাই ছিল ধান ক্ষেত। সেখানে এক জন স্কুল ছাত্র বাসে উঠত। চারিদিকে ছিল খালি জায়গা। তাই তার আসতে দেরী হলে আমরা দূর থেকেই দেখতে পেতাম সে হাতে স্যুটকেস নিয়ে তার বাবার সাথে আসতেছে। আর বাস তার জন্য কিছুটা দাড়াতো। মিরপুর ১৪ এর ডান দিকে ছিল সরকারী কোয়ার্টার। কাফ্রুলে ছিল বেশ কিছু করাত কল। কাফ্রুলের সরু রাস্তা দিয়ে যখন আমাদের স্কুল বাস পার হত, নাকে আসত কাঠ সিজনিং করার পচা গন্ধ।
সেই সময়কার ঢাকা এখনকার যে কোন মফস্বল শহরের থেকেও নিরিবিলি ছিল। নিরাপদও ছিল। সেই তিলোত্তমা নগরী ঢাকা শুধু এখন আমাদের স্মৃতিতে অটুট আছে। সেই গুলো মনে পড়লে ক্ষোভ ও আক্ষেপ ছাড়া আর কিছু অনুভুতি জাগে না।