বিশ্বব্যাপী নিও লিবারেলিজমের উত্থান ও ক্ষুদ্রঋণ ধারণার বিকাশ
লেখক: মুনমুন শবনম বিপাশা | সোম, ২৮ নভেম্বর ২০১১, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪১৮
১৯৭০ সালে আমেরিকাতে ‘কেইনসিয়ান’ অর্থনীতি চালু ছিল। কেনসিয়ান অর্থনীতির মূল কথা হলো ‘বৃহত্ সরকার (BIG GOVERNMENT) তৈরির মাধ্যমে জনগণের প্রয়োজন মেটাতে হবে। এখানে বেসরকারি খাতের কথা বলা হয়েছে, তবে সরকারি খাতই এখানে বেশি জনসম্পৃক্ত কাজ করবে।’ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ধনী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কর আদায় করে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ করা হতো। এখন এ কেইনসিয়ান তত্ত্বের কারণে অর্থনীতিতে ‘নিয়ন্¿ণাধীন পুঁজিবাদ’ (CONTROLLED-CAPITALISM) দেখতে পাই। ১৯৪৫ সালে আমেরিকায় ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ দেখা যায়। তখন এ মতবাদ পুরোদমে চালু হয়। তবে পরবর্তীকালে এক সময় অর্থনীতিতে মন্দার দোহাই দিয়ে রবার্ট লুকাস, ফ্রিডম্যান ‘নিও লিবারেল’ তত্ত্বকে জনপ্রিয় করে তোলেন। ‘নিও লিবারেলিজমে’ আছে ডিএলপি (DLP) ফর্মুলা। অর্থাত্ ডিরেগুলেশান অফ ইকোনমি (অনিয়ন্¿িত অর্থনীতি), লিবারাইজেশন অব ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ব্যবসা ও শিল্পের মুক্তায়ন বা বিশ্বায়ন) এবং প্রাইভেটাইজেশন অব স্টেট ওন্ড এন্টারপ্রাইজের (সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেসরকারিকরণ) সমন্বয়।
নিও লিবারেল অর্থনীতির কারণে ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়বে থাকে। ভারতীয় অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতীর লেখায় বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে সরকারের আকার ছোট করা, জনগণের সুযোগ-সুবিধা হ্রাস, ধনী ব্যবসায়ীদের কর মওকুফ, মৌলিক চাহিদাকে উচ্চমূল্যের পণ্যে পরিণত করা, শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন বন্ধ করা, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর সুবিধা দিয়ে বাণিজ্যে আগ্রহী করানো ইত্যাদি কাজ করা হয়।
নিও লিবারেল তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৯৮০ সালে গঠিত হয় ওয়াশিংটন ঐক্যজোট। যেখানে বিশ্বব্যাংক, এইএমএফ, সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিস, অ্যাডাম স্মিথ ইনস্টিটিউটসহ সবাই একত্র হয়। শুধু তাই নয়, তত্কালীন সময়ের চার ক্ষমতাধর নেতা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিগ্যান, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্¿ী থ্যাচার, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার প্রেসিডেন্ট মুলরোন, ফ্রেজোরসহ অনেক কূটনীতিক, মিডিয়া তারকা, সাংবাদিক এ তত্ত্বের প্রচারে নেমে পড়েন।
নিও লিবারেলিজমের ফল হিসেবে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি ও আইন বিষয়ের অধ্যাপক জগদীশ ভগবতী তার লেখায় বিভিন্ন উদাহরণ দিয়েছেন। সেখান থেকে বেশ কিছু উদাহরণ আজকের এ লেখায় তুলে ধরা হলো। জগদীশ ভগবতী বলেছেন, ‘চিলি প্রজেক্ট’ নামে একটা মিশন চালু করেন অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান। এতে চিলির শ’খানেক ছাত্রকে নিও লিবারেল অর্থনীতির পাঠ দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালের এগারোই সেপ্টেম্বরে পিনোশে সিআইএর সমর্থন নিয়ে ক্যু জারি করে ক্ষমতায় আসে। তখন এ ছাত্ররা চিলির অর্থনীতিকে বেসরকারিকরণে নেমে পড়ে। স্বৈরশাসক পিনোশের যাবতীয় নিপীড়ন, গণহত্যার মাধ্যমে নতুন নিও লিবারেল চিলি বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। মার্কসবাদীদের হাত থেকে চিলিকে বাঁচানোর কথা বলে পিনোশে প্রায় তিন হাজার মানুষ হত্যা করে। জেলে ঢুকিয়ে নির্যাতন করে প্রায় ত্রিশ হাজারের বেশি লোককে। পিনোশের এ জঘন্য মানবতাবিরোধী আপরাধ সংঘটনের সময় বিশ্বব্যাংক কোনো প্রতিবাদ করেনি। সে সময় দেশে মাত্র ১০ শতাংশ ধনী লোক এ অর্থনীতির সুফল ভোগ করে। ১৯৭৬ সালে আর্জেন্টিনায় ও ১৯৮০ সালে মেক্সিকোতে এ একই ঘটনা ঘটে। ১৯৮৯ সালে ব্রাজিল নিও লিবারেলিজমে দীক্ষিত হয়। প্রথমদিকে এশিয়াতে এ তত্ত্ব না এলেও নব্বই দশকে ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট মডেল’ হিসেবে এশিয়ায় এর জোর প্রবেশ ঘটে। জগদীশ ভগবতী আরও বলেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ‘মার্কেট গ্লোবালিজম’ এবং টনি ব্লেয়ার ‘থার্ড ওয়ে’ নাম দিয়ে এ তত্ত্বের সমর্থন করেছিলেন। নিও লিবারেলিজম চায় বাজারকে অনিয়ন্¿িত চেহারায় দেখতে, সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বেসরকারিকরণ করতে আর মুক্তবাজার অর্থনীতির নাম করে ধনী-গরিব ব্যবধান বাড়াতে। জগদীশ ভগবতীর মতে, মানুষের মৌলিক চাহিদা রাষ্ট্র পূরণ না করে বেসরকারি মুনাফালোভী প্রতিষ্ঠান করবে এটা বিশ্বাস করা কষ্টকর। সরকারে ‘গোষ্ঠীবদ্ধতাকে’ কাটিয়ে মানুষ ‘একাকি’ সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারবে এ রকম প্রচারও করা হয়। ক্ষুদ্রঋণও ঠিক একইভাবে ব্যক্তিস্বাতন্¿্যের কথা বলে। বলা হয়ে থাকে যে প্রতিটা মানুষ একজন উদ্যেক্তা। এখানে ‘গোষ্ঠীবদ্ধ উদ্যোগ’কে দূরে ঠেলে ‘ব্যক্তি উদ্যোগ’-এর কথা বলা হয়েছে। যেমন নিও লিবারেল আমাদের শিখিয়েছে ব্যক্তি-স্বাতন্¿্যের কথা। উদ্যোক্তা হলেই যে সফল হবে তা ঠিক নয়। অর্থ না থাকার জন্য মানুষ গরিব হয়। তবে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ না দিয়ে শুধু ঋণ দিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে মুরগির বাচ্চা পালন, ছাগল-গরু পালন করার উত্সাহ দিলেই সফল উদ্যোক্তা হওয়া যায় না। নিও লিবারেলিজমে যেমন বেসরকারি খাতকে উত্সাহিত করে সরকারি খাতকে অক্ষম করার পরিকল্পনা চলছে, তেমনিভাবে ক্ষদ্রঋণ ব্যবস্থায় নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়েছে। ১৯৮৩ সালে ঋণগ্রহণে পুরুষের সংখ্যা ছিল ৫৫ শতাং আর ১৯৯৪ সালে ঋণগ্রহণে পুরুষের সংখ্যা কমে হয়ে ৬ শতাংশ। নারীর ঋণগ্রহণের প্রবণতা বাড়ে ৭০০ গুণ। অথচ এ সময় নারীর কোনো রকম শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা দেওয়া হয় না। এদিকে অনেক সময়ই দেখা যায়, পুরুষেরা এসব ঋণের টাকা দিয়ে ফুর্তি করে নষ্ট করে, তারা জোর করে মহিলাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। এখন প্রশ্ন হলো যে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো কি পুরুষদের মানসিকতা পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা রাখছে? আবার প্রশিক্ষণ ছাড়া শুধু ঋণ দিয়েই কি নারীর ক্ষমতায়ন আনা সম্ভব? বলা হয় যে দারিদ্র্য দূর হবে ব্যক্তিগত দক্ষতায়। অথচ দারিদ্র্যের মূল কারণগুলোকে চিহ্নিত না করে কেমন করে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব?
ক্ষুদ্রঋণ মানে হলো ক্ষুদ্র অংকের ঋণ। অথচ এ ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতারা বৃহত্ ঋণগ্রহীতাদের চেয়ে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি সুদে ঋণ নেয়। অন্যভাবে বলা যায়, এটা হলো ‘দ্রুত-অর্থ উত্পাদনকারী শিল্প’।
ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর সবাই তাকে দারিদ্র্য দূরীকরণের দেবতা হিসেবে গণ্য করতে থাকে। এ ক্ষুদ্রঋণ নিলে গরিবেরা নাকি বিশ্বের যে কারও সমকক্ষ হতে পারবে। অথচ এসব লোক ভেবে দেখে না যে গরিব, অশিক্ষিত, প্রশিক্ষণবিহীন জনগণ উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে কেমন করে ধনিক শ্রেণীতে নাম লেখাবে? একবারও তারা ভেবে দেখে না যে এ পর্যন্ত কতজন মানুষ ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদে পরে আত্মহত্যা করছে।
ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থায় কোনো দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায় না। এ ঋণ ব্যবস্থায় একবারে সুদের টাকা না তুলে বিভিন্ন কিস্তিতে টাকা তোলা হয়। বছরে ৫০টা কিস্তি। বলা হয় যে, এভাবে ঋণ শোধ করলে গরিবদের ওপর চাপ কম পড়বে। ফলে বিষয়টা এমন হয়ে গেছে যে ঋণ নিয়ে বাড়িতে আসার আগেই কিস্তির টাকা নিতে লোক চলে আসে। আসল বিষয় হলো— এ সব সংস্থা চেষ্টা করে কতটা কম সময়ের মধ্যে টাকা উঠিয়ে আনতে পারবে এবং আবার বিনিয়োগ করতে পারবে।
আমরা দেখেছি আমাদের তেরেসা, ফ্লোরেন্স, নাইটিংগেলর মতো মহীয়সী ব্যক্তিদের নোবেল পাওয়ার ঘটনা। যারা নিঃস্বার্থভাবে জনগণের কল্যাণ করে গেছে। অথচ একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যার মূল উদ্দেশ্য হলো সুদ খাওয়া, সে ধরনের সংস্থার জন্য কেমন করে ‘শান্তি’তে নোবেল পুরস্কার আসে তা বোধগম্য নয় ।
লেখক : প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি