ঘাটে ঘাটে দুর্নীতি পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে
লেখক: মুনমুন শবনম বিপাশা | সোম, ১০ অক্টোবর ২০১১, ২৫ আশ্বিন ১৪১৮
স্বাধীনতার ৪০ বছর পার হলেও দুর্নীতি নামের বিষফোড়ার ব্যথা থেকে এখনও রেহাই পাচ্ছে না দেশ। দেশের সবচেয়ে বড় আসন থেকে শুরু করে সবচেয়ে ছোট আসনেও দুর্নীতির কালো থাবা আমাদের কাছে প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। দেশের অর্থনীতি এখন দুর্নীতির কালো থাবায় বিপর্যস্ত। বর্তমানে আমাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার একটি বড় সমস্যা হলো দুর্নীতি। দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা যদি ধরা হয়, প্রাথমিকভাবে মূল্যস্ফীতিকেই মনে হয়। এ মূল্যস্ফীতির পেছনে একটি বড় প্রভাবক হলো দুর্নীতি। তাছাড়া দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসার গতি কমে যাওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হলো দুর্নীতি। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করতে গড়িমসি করছে। তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে দুর্নীতি থাকলে অর্থায়ন করবে না।
বাংলাদেশের কৃষিপণ্য বেশিরভাগই আসে গ্রামাঞ্চল থেকে। গ্রামাঞ্চল থেকে পণ্য আনতে ঘাটে ঘাটে বিভিন্ন নেতাকে দিতে হয় বিভিন্ন পরিমাণে চাঁদা। এই চাঁদা প্রকৃতপক্ষে দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকেই। কারণ চাঁদার টাকাকে পণ্যের খরচ হিসেবে ধরে তার দাম নির্ধারণ করা হয়। ফলে এ ধরনের দুর্নীতি মূলত পণ্যমূল্যকেই বাড়িয়ে দিচ্ছে। যা সাধারণ মানুষের পকেট থেকেই যাচ্ছে।
দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন করার ব্যাপারটি বেশ দোদুল্যমানের মধ্যে পড়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, দুর্নীতি হচ্ছে কি-না তা সঠিকভাবে বিবেচনা করেই অর্থায়ন করা হবে। অর্থাত্ দুর্নীতির কারণে এ অর্থায়ন হুমকির মুখে পড়ে গেল। এ অবস্থায় যদি অর্থায়ন না হয় তবে বাংলাদেশ বেশ সমস্যার মধ্যে পড়ে যেতে পারে।
শেয়ারবাজারে প্রায় ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী দুর্নীতিবাজদের কবলে পড়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে। প্লেসমেন্ট শেয়ার, অতিরিক্ত প্রিমিয়াম নির্ধারণ এবং হিসাবায়নে অতিরিক্ত মুনাফা দেখিয়ে রাইট শেয়ার ইস্যু করাসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম শেয়ারবাজারকে টাকা লুটে নেওয়ার একটি মাধ্যম করে নিয়েছে গুটিকয়েক মানুষ। ফলে বিনিয়োগকারীরা তাদের সর্বস্ব হারিয়ে অনেকেই এখন দিশেহারা। একজন বিনিয়োগকারী সর্বস্ব হারিয়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে। শেয়ারবাজারে দুর্নীতির হোতাদের নাম প্রকাশ করায় দুর্নীতির তদন্তকারী ইব্রাহিম খালেদকে বেশ রোষের মধ্যে পড়তে হয়। এমনকি শেয়ারবাজারের দুর্নীতিবাজদের বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি।
প্রতি বছরই দেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের দিকে দেখলে দেখা যায়। বছরের শেষদিকে এসে তাড়াহুড়া করে এডিপি বাস্তবায়ন করা হয়। ফলে কাজের মান উন্নত হয় না। পাশাপাশি কাজে ব্যাপক দুর্নীতি হয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সড়ক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় কয়েক দিনের ব্যবধানে সারা দেশের রাস্তাঘাট মেরামতের সময় ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। দেশের সব উন্নয়নধর্মী কাজেই দুর্নীতি আখড়া বেঁধে বসে আছে। ফলে কোনো উন্নয়নমূলক কাজই ভালোভাবে হয় না। যতটুকু হয় তাতে খরচ দেখানো হয় বেশি।
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ না আসার পেছনে একটি বড় বাধা হলো দুর্নীতি। বেশ কয়েক বছর বাংলাদেশ দুর্নীতিতে প্রথম ছিল। যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করতে নিরুত্সাহিত করে। এর প্রভাবেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বেশ কমে গেছে।
খাদ্যপণ্যে ভেজাল মিশিয়েও দুর্নীতি করতে দেখা যায় আমাদের দেশে। বিদেশ থেকে খাদ্যপণ্য আমদানি করা হয় যা অনেক নিম্নমানের। সরকারি কোষাগার থেকে ভালো মানের জন্য টাকা নিলেও আনা হচ্ছে নিম্নমানের। শিশুখাদ্যে পর্যন্ত রয়েছে ভেজাল। এসব ভেজাল রোধে যাদের নিয়োগ করা হয় তারাও করে দুর্নীতি। ফলে দুর্নীতির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় না।
দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায়, এমন কোনো খাত নেই যেখানে দুর্নীতি স্পর্শ করেনি। দুর্নীতির অক্টোপাস যেন পুরো সমাজকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। কোন খাতে যে দুর্নীতি বেশি আর কোন খাতে কম তা নির্ধারণ করতেই ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। কারণ এদিক থেকে সবাই সমানভাবে এগিয়ে রয়েছে। কোথায় নেই দুর্নীতি— রাজনীতি, অফিস-আদালত, আইন-শৃঙ্খলা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, শেয়ারবাজার। সর্বত্রই বিদ্যমান দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের দরিদ্র সমাজ। স্বাধীনতা অর্জনের সময় আমাদের বীর শহীদরা যে স্বপ্ন দেখেছিরলন, দুর্নীতির কারণে সে স্বপ্ন আজ বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। সরকার বদল হয় নতুন সরকার আসে। নতুন উদ্যমে শুরু হয় দুর্নীতি।
লেখক : প্রভাষক, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি