নিষ্পাপ-নিরপরাধ শিশুরা আজ নিরাপদ কোথায়? [The daily Kalerkantho on 18.10.2019]

Author Topic: নিষ্পাপ-নিরপরাধ শিশুরা আজ নিরাপদ কোথায়? [The daily Kalerkantho on 18.10.2019]  (Read 893 times)

Offline kekbabu

  • Jr. Member
  • **
  • Posts: 78
  • Test
    • View Profile
    • https://daffodilvarsity.edu.bd/
নিষ্পাপ-নিরপরাধ শিশুরা আজ নিরাপদ কোথায়?
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
১৮ অক্টোবর, ২০১৯ [The daily Kalerkantho, page no. 15]

জাতির ভবিষ্যৎ শিশুরা আজ যেন কোথাও নিরাপদ নয়। সংঘবদ্ধ অপহরণকারীচক্র, প্রতারক, দুর্বৃত্তের হাতে তো স্বাভাবিকভাবেই শিশুরা নিরাপদ নয়। নিজের পরিবারে, নিজের বাবার কাছে, এমনকি গর্ভধারিণী মায়ের কোলেও আজ নিষ্পাপ-নিরপরাধ শিশুরা আর নিরাপদ নয়। নিজ পরিবারের কাছেও যে শিশুরা নিরাপদ নয়, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার কেজাউড়া নামের এক গ্রামে তুহিন নামের এক শিশুকে বর্বরভাবে হত্যার ঘটনার মধ্য দিয়ে। গত ১৩ অক্টোবর রাতে শিশু তুহিনকে এমন বর্বর ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, যা কল্পনাকেও হার মানায়। একই সঙ্গে ঘটনাটি মানবসভ্যতাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে তুলেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশ, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে তুহিন নামের পাঁচ-ছয় বছরের ওই শিশুকে ঘুম থেকে তার বাবা তুলে নিয়ে যায় এবং তার চাচা শিশুটিকে গলা কেটে হত্যা করে। পরে তাদের বাড়ির অদূরে একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে শিশুটির পেটের মধ্যে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দুটি ছুরি ঢুকিয়ে রাখা হয়। শুধু তা-ই নয়, শিশুটির পুরুষাঙ্গ ও কানও কেটে ফেলা হয়। এ ঘটনা জানার পর স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, মানুষের বিবেকবোধ আজ কোন পর্যায়ে! কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের মূল্যবোধ! বলা বাহুল্য, সারা দেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলছে শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা ও নির্যাতন। দেশব্যাপী শিশু ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতন ক্রমাগতভাবে বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় দেশবাসী ও অভিভাবক মহল আজ রীতিমতো উদ্বিগ্ন। নিজ পরিবার-পরিজন, স্কুল, মাদরাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বাসে-লঞ্চে, পথে-ঘাটে, মাঠে—কোথাও আজ যেন শিশুরা নিরাপদ নয়। এ অবস্থা নিঃসন্দেহে এ জাতির জন্য এক অশনিসংকেত। আশঙ্কাজনক হারে শিশু ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনাগুলো বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে কোনো সমাজে ধর্ষণ বিস্তৃত হলে এবং ধর্ষকদের কঠোর সাজার ব্যবস্থা করা না হলে সেই সমাজে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বলে কিছুই থাকে না। এ ধরনের ঘটনা পুরো সমাজ, দেশ ও জাতিকে বিশৃঙ্খলা ও পাপাচারের দিকে ধাবিত করে, যা কখনোই ভালো ফল বয়ে আনে না। এমতাবস্থায় শিশু ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যা বন্ধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হলে ভবিষ্যতে এ অবস্থা ভয়ানক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে।

পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশে প্রতিবছর এক হাজারেরও বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল মাসের প্রথম ১৫ দিনে সারা দেশে ৪৭টি শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। বিগত বছরগুলোতেও দেশে শিশু ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের চিত্র ছিল ভয়াবহ। ওই বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, গত বছর ধর্ষণের শিকার হওয়ার মোট ৩৪৫টি সংবাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৩৫৬, যার মধ্যে মারা গেছে ২২ জন এবং আহত হয়েছে ৩৩৪ জন। প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশুরা প্রতিবেশী, উত্ত্যক্তকারী, বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক বা অপরিচিত ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, দেশে প্রায় ৭০ শতাংশ শিশু তার প্রতিবেশী, আত্মীয়, বন্ধু ও তাদের শিক্ষক দ্বারা ধর্ষণ, হত্যা ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশে এক হাজার ৩০১ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে শিশু, প্রতিবন্ধী, গৃহকর্মী ও স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১২ সালের শুরু থেকে ২০১৫ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত দেশে সাড়ে ৯ শরও বেশি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে।

চলতি বছর দেশে একের পর এক যেভাবে শিশু ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে, তা বিগত বছরগুলোর পরিসংখ্যানকে ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমেয়। সমাজ থেকে দ্রুত এ অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন না ঘটালে বিভিন্ন সভা-সেমিনার আর বক্তৃতায় ‘আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’, ‘আজকের শিশুরাই আগামীতে জাতির কর্ণধার’, ‘আজকের শিশুরাই আগামী দিনে দেশ-জাতির নেতৃত্ব দেবে’—এমন কথাবার্তা সত্যিকার অর্থে অপপ্রলাপে পরিণত হবে। শিশু ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতন যেকোনো মূল্যে বন্ধ করা এখন জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশু ধর্ষণ ও হত্যার মতো জঘন্য ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা অনেক সময় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় কিংবা পেশিশক্তির জোরে ছাড় পেয়ে যাচ্ছে এবং অনেক সময় অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন সামাজিক অবক্ষয়ের পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি অন্যদিকে তা সার্বিক সমাজব্যবস্থার ব্যর্থতার পরিচয় তুলে ধরে। শিশু হত্যা, শিশু নির্যাতন এবং শিশু অপহরণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে না পারলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি যে আরো ভয়াবহ হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯ ধারা মোতাবেক, ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষণকারীর জন্য রয়েছে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত কমপক্ষে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড। একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে ধর্ষণকালে বা ধর্ষণের পর যদি তার মৃত্যু ঘটে, তবে ওই দলের সবার জন্যই এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে। ধর্ষণের চেষ্টা করলে ধর্ষণচেষ্টাকারীর সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিম্ন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেরও বিধান রয়েছে। কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানো বা আহত করার চেষ্টা করলে ধর্ষণকারী যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমান সমাজটা এখন এমন এক জায়গায় চলে গেছে, যেখানে শুধু বিচারব্যবস্থা কোনো কাজে আসবে না। পুরো বিষয়টি এক বড় গবেষণার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। শিশু ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতন নিয়ে এখন দরকার সমাজতত্ত্ববিদ, মনোবিজ্ঞানীসহ বিশেষজ্ঞদের সুচিন্তিত গবেষণা, যা মানুষের অপরাধপ্রবণতার কারণগুলো উদ্ঘাটনপূর্বক প্রতিকারব্যবস্থার সুপারিশ করতে পারবে। পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ ধরনের অপরাধ রোধ করতে অবশ্যই সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। সর্বোপরি যেহেতু এ ধরনের অপরাধ শুধু আইনের যথাযথ প্রয়োগ দ্বারা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না, তাই সামাজিক ও পারিবারিকভাবেও এসব অপরাধ রোধকল্পে ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। স্মরণ রাখা দরকার, শিশু ধর্ষণ বা নির্যাতন বা হত্যার বিষয়ে মামলা করে বিচার পাওয়ার চেয়ে সমাজে যেন এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই না ঘটে সে ব্যবস্থা করা অধিকতর মঙ্গলজনক। কারণ Prevention is better than cure. আর এ অবস্থা থেকে চিরতরে মুক্তি পেতে হলে আমাদের দর্শন ও নৈতিকতার উন্নয়ন করতে হবে। মনের অশুভ চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় সমাজে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কণ্ঠে প্রতিবাদ হওয়াটা খুবই জরুরি। ধর্ষকরা অনেক সময় শাস্তি পায় না বলেই পরবর্তীকালে তারা বীরদর্পে ধর্ষণ করে। আর তাদের দেখে অন্যরাও ধর্ষণ করতে উত্সাহিত হয়। এভাবে চলতে থাকলে দেশ, সমাজ ও জাতি কলুষিত হবে; দেশ পরিণত হবে মগের মুলুকে, যা কারো কাম্য নয়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2019/10/18/828074
Dr. Kudrat-E-Khuda (Babu).
Associate Professor (Dept. of Law), Daffodil International University;
International Member of Amnesty International;
Climate Activist of Greenpeace International; Column Writer;
Mobile Phone: +8801716472306
E-mail: kekbabu.law@diu.edu.bd