ছাপা পত্রিকায় করোনাভাইরাস ছড়ানোর নজির নেই

Author Topic: ছাপা পত্রিকায় করোনাভাইরাস ছড়ানোর নজির নেই  (Read 717 times)

Offline Shamim Ansary

  • Hero Member
  • *****
  • Posts: 3735
  • Change Yourself, the whole will be changed
    • View Profile
দোড়গোড়ায় নিরাপদে পত্রিকা পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছেন হকার। ছবি: প্রথম আলোকরোনাভাইরাস মহামারির এ সময়ে মানুষ সঠিক তথ্য পেতে চায়। কারণ, এখন বিভিন্ন মিডিয়ায় নানা তথ্য। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল বোঝা কঠিন। এ সময়ে বরাবরের মতো মানুষের আস্থার জায়গা ছাপা পত্রিকা। কিন্তু ছাপা পত্রিকাও শিকার হচ্ছে গুজব আর ‘তথ্য-সংক্রমণের’। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পত্রিকার মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ানোর কোনা ঘটনা নেই। বৈজ্ঞানিকভাবে এর কোনো ভিত্তি নেই।

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর এখন পর্যন্ত শুধু দেশটিতে মারা গেছে ৩ হাজার ২৯১ জন। এর মধ্যে শুধু হুবেই প্রদেশে মারা গেছে ৩ হাজার ১৬৯ জন। গোটা হুবেই প্রদেশ বন্ধ করে দিয়েছিল চীন। রাজ্যটি আংশিক খুলে দেওয়া হবে আগামী ৮ এপ্রিল। ভয়াবহ এই মহামারির সময় চীনের হুবেই প্রদেশে এক দিনের জন্যও ছাপা পত্রিকা সরবরাহ বন্ধ ছিল না। করোনাভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর গোটা চীনের কোথাও ছাপা পত্রিকা সরবরাহ বন্ধ হয়নি।

শুধু চীন নয়, বিশ্বের কোনো দেশে করোনাভাইরাস ছাপা পত্রিকার মাধ্যমে ছড়ায় এ ‘অভিযোগে’ বন্ধ হয়েছে—এমন একটি ঘটনাও নেই। করোনাভাইরাসের কারণে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে ইতালিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা ওই দেশে। দেশটিতে কোনো কোনো জায়গায় এই সময়ে ছাপা পত্রিকার চাহিদা বেড়েছে। অন্য আক্রান্ত দেশগুলোর সরকারও করোনাভাইরাস ছড়ানোর দায় ছাপা পত্রিকার ওপর চাপায়নি।

Lifebuoy Soap

ছাপা পত্রিকার বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা। ‘করোনা তথ্য-সংক্রমণের নিশানায় সংবাদপত্র’ শিরোনামে লেখা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংবাদপত্র ‘তথ্য-সংক্রমণের’ শিকার হয়েছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশের এক মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই সমান্তরাল সংক্রমণ ‘ইনফোডেমিক’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। ভিত্তিহীন তথ্যের বাধাহীন চলাফেরা (বিশেষ করে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং মাধ্যমে) যে অচিরেই সমস্যার কারণ হতে পারে, অতীতের অভিজ্ঞতায় তা বুঝেছিলেন গবেষকেরা। কারণ, মহামারির ইতিহাসই বলছে, গণমনস্তত্ব (মাস সাইকোলজি) এই সময়ে সংশয়ে থাকে। তাই যে মাধ্যমেই তথ্য আসুক, তা গ্রহণ করে মানুষের মন। ফলে সেই তথ্য গুজব হলেও দাবানলের আকারে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। ভিত্তিহীন প্রচার ছড়ানো হয়েছে সংবাদপত্র নিয়ে।

বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট অঙ্কিত চামোলি আনন্দবাজারকে বলেছেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সংক্রমণের মাধ্যম হিসেবে যেখানে শুধু “অবজেক্ট” বলেছে, সেখানে হঠাৎ সব ছেড়ে সংক্রমণের মাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্র বা কাগজ-শিল্পকে বেছে নেওয়ার জন্য কাদের স্বার্থ পূরণ হচ্ছে, তা বিশ্লেষণ করা দরকার। যে মানসিকতা থেকে মহামারি বা অশান্ত পরিস্থিতিকে মাধ্যম করে দৈনন্দিন জিনিসপত্রের কালোবাজারি করে মুনাফা লোটার চেষ্টা করেন এক শ্রেণির মানুষ, তেমনই ভবিষ্যতের লাভের অঙ্ককে মাথায় রেখে কোনো শিল্পকে (এ ক্ষেত্রে সংবাদপত্রসহ কাগজশিল্পকে) কাঠগড়ায় তুলতেও পিছপা হন না অনেকে।’

‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ’-এর ডিরেক্টর অধ্যাপক মধুমিতা দুবে বলেছেন, সংক্রমণ ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবে আলাদা করে কাগজের ওপর জোর দেওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, ‘সংক্রমিত রোগীর ড্রপলেট শুধু কাগজ কেন, দরজার হাতল, চেয়ার-টেবিল, কম্পিউটারসহ অনেক জায়গাতেই পড়তে পারে। তার পরে ওই ভাইরাসের আয়ুষ্কালের মধ্যে (যে আয়ুষ্কাল কার্ডবোর্ডের ওপরে ২৪ ঘণ্টা বলে এখনো পর্যন্ত প্রমাণিত) যদি অন্য কেউ তার ওপরে হাত দেন এবং সেই হাত না ধুয়েই নিজের মুখ-নাকে দেন, তখন সংক্রমণ ছড়াতে পারে। কাগজের ব্যাপারে আলাদা করে মাথা না ঘামিয়ে এই সব জিনিস হাতের সংস্পর্শে আসার পরে হাত ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলার ওপরে জোর দেওয়া জরুরি।’

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক কানাইচন্দ্র পাল বলছেন, ‘‘কাগজের মাধ্যমে এই সংক্রমণ ছড়ানোর কোনো আশঙ্কাই নেই। কাগজ যা দিয়ে তৈরি, বিশেষ করে সংবাদপত্রের প্রক্রিয়াকরণের সময়ে যে সমস্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, তার ওপরে ড্রপলেটের বেঁচে থাকা অসম্ভব। ‘নেকেড’ ভাইরাস কোনো সারফেসেই বাঁচতে পারে না। এদের টিকে থাকার জন্য ড্রপলেটের প্রয়োজন হয়।’’

গবেষকেরা এ-ও পাল্টা প্রশ্ন করছেন-কখনো কি সর্দি বা ফ্লু জাতীয় রোগ খাম বা কাগজের মাধ্যমে ছড়ায়, এমন ঘটনা ঘটেছে? এক গবেষকের কথায়, যদি তাই-ই হতো, তা হলে পরিস্থিতি আরও অনেক অনেক খারাপ হতো। এ সব ক্ষেত্রে নিজের সাধারণ বুদ্ধি প্রয়োগ করলেই হবে। ধরা যাক, কেউ একজন এমন কয়েনের সংস্পর্শে এলেন, যে কয়েনটি আগে কোনো সংক্রমিত রোগীর কাছে ছিল এবং তাতে ড্রপলেট লাগা রয়েছে। যদি সেই ড্রপলেট হাতে লাগার পরে ওই ব্যক্তি নিজের মুখে তা দেন, তা হলেই একমাত্র সংক্রমণ হবে।’

অথচ বাংলাদেশ, ভারতসহ বহু দেশে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ঢালাওভাবে প্রচার করা হচ্ছে যে, ছাপা পত্রিকার মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাদের যুক্তি হলো, যেহেতু কাগজের মুদ্রার মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন আশঙ্কায় চীনে কিছু কিছু জায়গা নোট পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। তাই কাগজের নোট বিপজ্জনক হলে ছাপা পত্রিকা নয় কেন? যারা এমন প্রশ্ন করছেন তাদের কেউ কেউ আবার এই সময়ে ব্যাংকে গিয়ে কাগজের মুদ্রা নিয়ে বাসায় ফিরেছেন। কিন্তু এখানে মূল বিষয়টি হলো টাকা ও ছাপা পত্রিকার কাগজের মধ্যে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য।

এ রকম ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে আগেই সতর্ক করে গিয়েছিল গত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংগঠনটির সতর্কবার্তা তখন বলা হয়েছিল, করোনা ভাইরাস বিষয়ে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়তে পারে। নির্ভরযোগ্য যে ছাপা পত্রিকা এ বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রকাশ করে আসছিল এবার ভুয়া তথ্যের খপ্পরে বিশ্বব্যাপী তারাই বেশি আক্রান্ত।

ছাপা পত্রিকার বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা। ছবি: সংগৃহীত
করোনাভাইরাস ও ছাপা পত্রিকার সম্পর্ক নেই কেন?
জাতিসংঘের সংস্থা ডব্লিউএইচও, যুক্তরাজ্যের ‘জার্নাল অব হসপিটাল ইনফেকশন’ (মহামারি ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে মৌলিক গবেষণা প্রকাশ করে), যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশন ডিজিজ এবং যুক্তরাজ্যের জন ইনস সেন্টার (উদ্ভিদ ও অণুজীব নিয়ে গবেষণা এবং প্রশিক্ষণের স্বাধীন প্রতিষ্ঠান) বলছে, ছাপা পত্রিকায় করোনা ভাইরাস ছড়ায় এ রকম একটি নজির পৃথিবীর কোথাও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে এমন জায়গা থেকে কোনো মোড়ক নেওয়া নিরাপদ কি না, সে সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, কোনো সংক্রামিত ব্যক্তির বাণিজ্যিক পণ্যকে দূষিত করার আশঙ্কা কম থাকে। যে মোড়ক সরানো হয়েছে, ভ্রমণ করেছে এবং বিভিন্ন অবস্থা ও তাপমাত্রায় বাতাসের সংস্পর্শে এসেছে তার থেকে ‘কোভিড ১৯’ ভাইরাস সংক্রামিত হওয়ার ঝুঁকিও কম থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রসিদ্ধ মেডিকেল জার্নাল হলো নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন। গত সপ্তাহে এ প্রতিষ্ঠান একটি গবেষণার ফলাফল ছাপা হয়েছে। গবেষণাটি করেছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ, সিডিসি, ইউসিএলএ এবং প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণা বিভিন্ন রকম পৃষ্ঠে করোনাভাইরাস কতক্ষণ টিকে থাকতে পারে তা দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনার হার সবচেয়ে কম হচ্ছে তামা থেকে। সম্ভবত এর কারণ তামার আণবিক গঠন। আর কম ছড়ায় কার্ডবোর্ড থেকে। যার কারণ হতে পারে এই যে কার্ডবোর্ড ছিদ্রযুক্ত।

গবেষণায় বলা হয়, ছিদ্রহীন ও মসৃণ পৃষ্ঠে করোনাভাইরাস টিকে থাকে সবচেয়ে বেশি সময়। গবেষকেরা দেখেছেন যে, প্লাস্টিক আর স্টেইনলেস স্টিলে এই ভাইরাস টেকে তিন দিনেরও বেশি। তবে এটি শুনতে যত ভয়াবহ মনে হচ্ছে ততটা হয়তো নয়। কারণ বাতাসের সংস্পর্শে এলেই এর কার্যক্ষমতা দ্রুত কমতে থাকে। বাতাসের স্পর্শে প্রতি ৬৬ মিনিটে এর ক্ষমতা অর্ধেক হতে থাকে। তিন ঘণ্টা পর এর সংক্রমণের ক্ষমতা কমে আট ভাগের এক ভাগ হয়ে যায়। ছয় ঘণ্টা পর তা হয়ে যায় মূল সংক্রমণ ক্ষমতার ২ শতাংশ।

সবাই জানেন, ছাপা পত্রিকায় ব্যবহৃত কাগজ (নিউজপ্রিন্ট) কার্ডবোর্ডের চাইতে অনেক বেশি ছিদ্রযুক্ত। এবং অনেকটাই অমসৃণ। এ গবেষণার ফল অনুযায়ী, যে সব জিনিসে ভাইরাসটির টিকে থাকার সম্ভাবনা সব চাইতে কম নিউজপ্রিন্ট তার মধ্যে অন্যতম।

গত ১০ মার্চে বিবিসি রেডিও স্কটল্যান্ড এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জন ইনস সেন্টারের ভাইরাস বিশেষজ্ঞ জর্জ লোমনোসফ বলেছেন, পত্রিকা যেভাবে ছাপা হয় আর যে প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়, তাতে পত্রিকা এমনিতেই অনেকটা জীবাণুমুক্ত থাকে। এ কারণেই ভাজা খাবার নিউজপ্রিন্টে রেখে খাওয়া হয়। আর কালি ও কাগজ একে অনেকটা জীবাণুমুক্ত করে দেয়।

বিশ্বের ৭০টি দেশের ১ হাজারেরও বেশি সংবাদপত্রকে নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল নিউজ মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশন (ইনমা)। গত ২৩ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে ‘ছাপা কাগজ থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানোর ঘটনা শূন্য’ নামে একটি প্রতিবেদন লেখেন ইনমার নির্বাহী পরিচালক আর্ল জে উইলকিনসন।

ইতালিতে পত্রিকার চাহিদা বাড়ছে
ছাপা পত্রিকার মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে এমন অভিযোগে দুনিয়ার কোথাও পত্রিকা বন্ধ হয়নি। বরং, লকডাউন করার কারণে পত্রিকা বিভিন্ন শহরে সরবরাহ করা যায়নি এমন বহু অভিযোগ ভারতের মানুষ করছে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত বর্তমান পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ পত্রিকা সরবরাহ করার মতো পরিবহন ব্যবস্থা নেই। ছাপা পত্রিকার বর্তমান সংকটের মূল ও একমাত্র কারণ, দেশের লকডাউন পরিস্থিতির জন্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া। কিন্তু এগুলো কোনটিই ছাপা পত্রিকার মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে নয়।
প্রেস গেজেটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ইতালিতে কোনো কোনো এলাকায় ছাপা পত্রিকার চাহিদা আগের তুলনায় কিছু বেড়েছে।’ এতে বোঝা যায় যে, ইতালির মানুষ যথাযথ তথ্য পেতে ছাপা পত্রিকার ওপর আরও বেশি আস্থা রাখছে। এখন পর্যন্ত ইতালিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ২১৫ জন।
এরপরেই রয়েছে স্পেনের মৃতের হার। দেশটিতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, যার মধ্যে মারা গেছেন ৩ হাজার ৬৪৭ জন। এরপর রয়েছে ইরান। দেশটিতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, মারা গেছে ২ হাজার ২৩৪ জন। যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত হয়েছে ৬৯ হাজার কিছু বেশি। মারা গেছেন ১ হাজার ৪৬ জন। যুক্তরাজ্যে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১০ হাজার মানুষ, এর মধ্যে মারা গেছে ৪৬৭ জন। অথচ এসব দেশের কোথাও সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থা করোনাভাইরাস ছাপা পত্রিকায় ছড়ায় এমন অভিযোগ করেনি।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রেসগ্যাজেট তাদের প্রতিবেদনে ইতালিতে ছাপা পত্রিকা বিক্রি বাড়ার কথা বলেছে। ছবি: সংগৃহীত
প্রেসগ্যাজেট যা বলছে
যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রেসগ্যাজেট তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইতালি ও হংকংয়ের পত্রিকাগুলোর বিজ্ঞাপনী আয় কমে গেছে। তবে তারা ছাপা বন্ধ করছে না। করোনা মহামারিতে ইতালির বেশি আক্রান্ত হয়েছে লম্বার্ডি ও ভেনেতো অঞ্চল। সেখানকার তিনটি পত্রিকা প্রকাশক অ্যাথেসিসের কারিগরি পরিচালক সিলভিও দ্য গাইয়ু সংবাদমাধ্যমের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ান ইফরাকে বলেছেন, লকডাউনের মধ্যেও তাদের পত্রিকার কিছু বিক্রি বেড়েছে। অবশ্য তা কিয়স্ক সেল (ছোট ডিসপ্লে) বা কিয়স্কের মাধ্যমে বিক্রি।
ইতালির সরকার সংবাদপত্রকে ‘মৌলিক প্রয়োজনীয়তা’ হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে, যাতে সাংবাদিকেরা নিজেদের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। এ ছাড়া সংবাদপত্র মুদ্রণ ও বিতরণ কার্যক্রম চালানো যাবে এবং অন্যান্য অনেক দোকান বন্ধ করতে বাধ্য করা হলে সংবাদপত্রের কিয়স্ক খোলা থাকবে।
গাইয়ু বলেন, ‘কিয়স্কের মাধ্যমে খবরের কাগজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ শতাংশ, যার মধ্যে দশ শতাংশ কিয়স্কের সাবস্ক্রিপশন থেকে আসে এবং হোম ডেলিভারি থেকে আরও দশ শতাংশ থাকে। সংবাদপত্রের ডিজিটাল সংস্করণও রয়েছে। প্রকাশক ছাপা পত্রিকার লোকসান দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন না। কারণ ছাপা পত্রিকার বিজ্ঞাপন থেকে বেশি রাজস্ব আসে তাই পত্রিকা এখনো আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। কিন্তু বিজ্ঞাপন এখন কিছুটা বন্ধ থাকায় সংবাদপত্রের পাতা কমিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।
গাইয়ু বলেন, আরও বেশি সমস্যা তৈরি করতে পারে বা সংবাদপত্র প্রস্তুত করতে বেশি কার্যকলাপ করতে না হয় বা অনেক বেশি পাতার ছাপানোর কোনো অর্থ হয় না। তিনি আরও বলেন, পত্রিকার সার্কুলেশন এ সময় বেড়েছে। যদিও তা খুব বেশি নয় তবে এটি গুরুত্বপূর্ণ যে যখন খবর গুরুত্বপূর্ণ তখন মানুষ কিয়স্কে যায় এবং সংবাদপত্র কেনে। এ সময় অবশ্য অনলাইন ব্যবহারকারী ও পেজভিউ ব্যাপক বাড়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।

হংকং ভিত্তিক সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের একই সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে। সেখানে করোনা আক্রান্ত ২০০ রোগী শনাক্ত করা গেছে ও চারজন মারা গেছেন। সংবাদপত্রটির প্রধান প্রডাকশন সম্পাদক অ্যালিস ওং বলেছেন, ‘আমাদের ছাপা পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখি না। কারণ আমাদের ছাপা পত্রিকা ই-পেপারের মাধ্যমেও পৌঁছে দিতে পারি। আমি নিউজপেপার উৎপাদন বন্ধের কোনো কারণও দেখি না। এখন পর্যন্ত আমাদের উৎপাদন মডেল পরিবর্তনের কোনো পরিকল্পনা নেই। আমরা পত্রিকা ছাপা চালিয়ে যাব।’

ওং আরও বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে তাদের বিজ্ঞাপনও কিছুটা কমে গেছে। অন্যদিকে অবশ্য কাগজে করোনাভাইরাস নিয়ে আরও ভালো উপস্থাপন করার সুযোগ এসেছে। এ সময় ছাপা পত্রিকার গ্রাহক বেড়েছে, যা খুবই আশাব্যঞ্জক। ২০১৬ সালে অনলাইনে পেওয়াল চালু করে পত্রিকাটি। যদিও দুটি পণ্যের মধ্যে কনটেন্ট প্রায় একই। তবে পত্রিকার ক্ষেত্রে লেখাগুলো আরও উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে তুলে ধরা হয় যাতে পাঠক ছাপা পত্রিকায় তাদের আগ্রহ ধরে রাখেন। অনলাইনে পড়ার পরেও ছাপা পত্রিকায় পড়ার জন্য তারা অপেক্ষা করেন।

নিউজরুমের কর্মী ও প্রেসের কর্মীরা কি করছেন
ইতালির সংবাদপত্রগুলোর ক্ষেত্রে কতজন কর্মী অফিসে এসে কাজ করবেন তা ঠিক করা হয়েছে। এ ছাড়া নিউজরুমে পরিবর্তন আনা হয়েছে যাতে কর্মীরা নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে বসতে পারেন। একটি সংবাদপত্রের ৮০ শতাংশ কর্মী এখন বাড়িতে বসে কাজ করছেন। এখন শুধু প্রধান সম্পাদক ও দুজন প্রডাকশন কর্মী অফিস ভবনে বসে কাজ করছেন। অন্য দুটি সংবাদপত্রের ৬০ শতাংশ কর্মী বাড়িতে বসে কাজ করছেন।

গাইয়ু বলেন, তিনটি সংবাদপত্রের সমস্ত সম্পাদকীয় প্রয়োজনকে ২৯ শে মার্চের মধ্যে দূরবর্তীভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় সম্পাদকীয় সভাগুলো যাতে শিরোনাম ও পেজ লেআউটের মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। এ ছাড়া মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় আমাদের আচরণ বদলাতে হয়েছে।

অ্যাথেসিস ছাপাখানার ক্ষেত্রেও নিয়ম পরিবর্তন করে ফেলেছে। যাতে একসঙ্গে কম কর্মীকে কাজ করতে হয় তার জন্য ব্যবস্থা করতে হয়েছে। ওয়াং বলেন, ছাপাখানা যদি বন্ধ হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে তাদের একটি অবিচ্ছিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে।

ইকোনমিক টাইমস বলেছে করোনাভাইরাস সংবাদপত্রে সংক্রমিত হয় না। ছবি: ছবি: সংগৃহীত
মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী যা বলছেন
মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজেশ তোপের বরাতে ইকোনমিক টাইমস সম্প্রতি তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, করোনাভাইরাসে সংবাদপত্রে সংক্রমিত হয় না। গত মঙ্গলবার সংবাদপত্রের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ানোর গুজব প্রত্যাখ্যান করে রাজেশ তোপে বলেন, ভিত্তিহীন গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, এমন অনেক গুজব প্রচারিত হচ্ছে যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করোনা ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং মানুষ এতে প্রভাবিত হচ্ছে। আসলে সংবাদপত্রের মাধ্যমে করোনা ছড়ায় না। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

এ সময় তথ্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং এ কাজে সংবাদপত্র কেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন তোপে। গণমাধ্যম গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে পরিচিত, তারা আমাদের সংবাদ পৌঁছে দেয়। বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই এমন গুজবের ভিত্তিতে তাদের সম্পর্কে ধারণা তৈরি করা খুব ভুল। এ ধরনের গুজব বিশ্বাস করা উচিত নয়। সংবাদপত্র ধরলে বা পড়লে করোনা সংক্রমণ ঘটবে না। আমি পূর্ণ আত্মবিশ্বাস ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতেই বলতে পারি সংবাদপত্র পড়লে আপনার করোনা সংক্রমণের ভয় নেই। অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো এসব গুজব বাতিল করেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছে, সংবাদপত্রের মতো প্যাকেজ গ্রহণ করা নিরাপদ। সংবাদপত্র উৎপাদনের বিষয়টি এতটাই স্বয়ংক্রিয় যে তা সংক্রমণের কোনো ঝুঁকি নেই। এমনকি সে সাপ্লাই চেনের মাধ্যমে পত্রিকা আপনার হাত পর্যন্ত পৌঁছায় তাতে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হয়।

মানুষের হাতে দ্রুত ছাপা পত্রিকা পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করেন হকাররা। ছবি: প্রথম আলো
ঢাকায় বাড়ির মালিকদের সিদ্ধান্ত বিপাকে নিম্ন আয়ের মানুষ
রাজধানীর একাধিক বহুতল ভবন ও হাউজিং কমপ্লেক্সের মালিকেরা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁদের ভবনে ঠিকা গৃহপরিচারিকা, দুধ দিতে আসা ব্যক্তি, ডিশ ও ইন্টারনেটের বিল দিতে আসা ব্যক্তি, পত্রিকার হকারসহ বাইরের কাউকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হবে না। কারণ তাদের থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। এতে অনেক গৃহপরিচারিকারা বিপদে পড়েছেন। একইভাবে পত্রিকার হকারও দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। অথচ করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে যা যা করা দরকার তা ওইসব ভবনের মালিকদের অনেকেই করেননি। যেমন, জীবাণুনাশক দিয়ে ভবনের নিচতলার মেঝে দিন অন্তত দু বার পরিষ্কার করা, বাইরে থেকে আসা প্রত্যেক ভবনের বাসিন্দার হাত পা জীবাণু মুক্ত করা ইত্যাদি। এ ছাড়া মহামারির সময় প্রান্তিক দরিদ্র মানুষও যাতে বাঁচতে পারে সেটিও দেখা অন্যদের দায়িত্ব। এভাবে গণআতঙ্ক তৈরি হলে মানুষ থেকে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, একে অন্যকে সাহস জোগাতে। সাহসের গল্পগুলো ছড়িয়ে দিতে হবে।

বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো যে ব্যবস্থা নিয়েছে
বাংলাদেশ সহ আধুনিক বিশ্বে পত্রিকা ছাপা হওয়ার সময় হাতের স্পর্শ লাগে না। এরপরও পত্রিকা পরিবহন, বিতরণের সকল পর্যায় ভাইরাস সংক্রমণ রোধে ব্যাপক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সংবাদপত্র প্রকাশ থেকে তা গ্রাহকের বাসায় যাওয়া পর্যন্ত সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার ওপর প্রতিটি পত্রিকা জোর দিয়েছে। সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সুনির্দিষ্টভাবে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ বিষয়ে।

নোয়াব পত্রিকার এজেন্ট, হকার, পত্রিকা পরিবহনের সঙ্গে যারা যুক্ত তারা যাতে করোনা সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থেকে রাজধানী সহ সারা দেশে পত্রিকা বিলি করতে পারে সে জন্য সংবাদপত্র তিন হাজার হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং ২৩ হাজার মাস্ক ও ২৩ হাজার গ্লাভস সরবরাহ করেছে ইতিমধ্যে। ঢাকার বাইরে মফস্বলের এজেন্টদের পত্রিকার প্যাকেটের মাধ্যমে গাড়িতে সরবরাহ করা হচ্ছে।


Source: https://www.prothomalo.com/bangladesh/article/1647390/%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A6%BE-%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B8-%E0%A6%9B%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8B%E0%A6%B0-%E0%A6%A8%E0%A6%9C%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%87
"Many thanks to Allah who gave us life after having given us death and (our) final return (on the Day of Qiyaamah (Judgement)) is to Him"