অমর্ত্য সেন লিখেছেন - এই কর্মযজ্ঞ যুদ্ধের চেয়ে অনেক বড়

Author Topic: অমর্ত্য সেন লিখেছেন - এই কর্মযজ্ঞ যুদ্ধের চেয়ে অনেক বড়  (Read 584 times)

Offline Md. Siddiqul Alam (Reza)

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 253
    • View Profile
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সবচেয়ে পুরোনো সদস্য সে, এ নিয়ে আমাদের গর্বিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। গণতন্ত্র যেমন সবাইকে কথা বলার সুযোগ দেয়, তেমনি অনেক ব্যবহারিক সুবিধাও দেয়। সে জন্য জিজ্ঞাসা করা সমীচীন, দেশ যখন ভয়াবহ স্বাস্থ্যসংকটের মুখে, তখন কি আমরা এই গণতন্ত্রের সদ্ব্যবহার করছি?

প্রথমে কিছুটা ইতিহাসের দ্বারস্থ হই। ব্রিটিশ রাজের অবসানের পর পর নতুন আসা গণতন্ত্র তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের অনেক ফল দিয়েছে। দুর্ভিক্ষের কথাই বলা যায়, যা কর্তৃত্বপরায়ণ ব্রিটিশ জমানায় কিছুদিন পরপর আবির্ভূত হতো, গণতান্ত্রিক ভারত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর হঠাৎ করেই তার অবসান হয়। ব্রিটিশ-ভারতের শেষ দুর্ভিক্ষ ছিল ১৯৪৩ সালের বাংলার মন্বন্তর। আমি তখন ছোট, তবু স্বাধীনতার অব্যবহিত আগের সেই স্মৃতি এখনো জাগরুক। এই দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়। এরপর ভারতে আর কখনো দুর্ভিক্ষ হয়নি। স্বাধীনতার পরপর যখন দুর্ভিক্ষ মাথা তোলার চেষ্টা করেছে, তখনই সেই মাথা ছেঁটে ফেলা হয়েছে।


এখন কথা হচ্ছে, এটা কীভাবে হলো? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জোর প্রণোদনা দেয়। একদিকে থাকে নির্বাচন এবং অন্যদিকে গণ-আলোচনা। এই দুই কারণে সরকারকে দ্রুত মানুষের চাহিদা আমলে নিতে হয়। তবে শুধু নির্বাচনী ব্যবস্থা এটি নিশ্চিত করতে পারে না। গণতন্ত্র কখনোই শুধু অবাধ নির্বাচনের বিষয় নয়, আবার নির্বাচন যে সব সময় সময়মতো হয়, তা নয়। অনেক সময় এক নির্বাচন থেকে আরেক নির্বাচনের মধ্যে অনেক সময় বয়ে যায়। আবার কখনো কখনো তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক প্রাপ্তির উত্তেজনার কারণেও জনমত ভেসে যায়। উদাহরণ হিসেবে ১৯৮৩ সালের ব্রিটিশ নির্বাচনের কথা বলা যায়। ১৯৮২ সালের ফকল্যান্ড যুদ্ধের আগে প্রাক-নির্বাচনী সব জরিপে মার্গারেট থ্যাচার পিছিয়ে ছিলেন, কিন্তু যুদ্ধের কারণে তিনি অনেকটাই এগিয়ে যান এবং ১৯৮৩ সালের নির্বাচনে ভালোভাবে জিতে যান।

আবার সংসদীয় ব্যবস্থায় সাধারণ নির্বাচনের মানে হলো, সংসদের নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করা। ভোটের ব্যবস্থায় সংখ্যালঘুদের আগ্রহ বা অধিকারবিষয়ক আনুষ্ঠানিক বিধি নেই। এই পরিস্থিতিতে সব মানুষ যদি ব্যক্তিগত ইচ্ছানুসারে ভোট দেন, তাহলে দুর্ভিক্ষের ভুক্তভোগীদের বাঁচানোর ক্ষেত্রে উদ্ধারকর্তা হিসেবে নির্বাচন খুব একটা শক্তিশালী নয়। কারণ, দুর্ভিক্ষে খুব কমসংখ্যক মানুষই প্রকৃত অর্থে না খেয়ে থাকেন। তবে মুক্ত গণমাধ্যমের কল্যাণে এবং গণ-আলোচনার মধ্য দিয়ে অরক্ষিত দরিদ্র মানুষের দুর্দশা ও বিপদ গণপরিসরে ভালো প্রচারণা পায়। ফলে যে সরকার এই ধরনের বিপর্যয় ঘটতে দেয়, তার ভিত্তি নড়ে যায়। আবার সরকারে যাঁরা থাকেন, তাঁদেরও তো মানবিক বোধ ও সহানুভূতি থাকতে পারে; ফলে গণ-আলোচনায় যেসব বিষয় আলোচিত হয় বা যেসব তথ্য উঠে আসে, তাতে তাঁরাও সরাসরি প্রভাবিত হতে পারে।

দুর্ভিক্ষে কমসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হলেও গণ-আলোচনা ও মুক্ত গণমাধ্যমে প্রচারের কল্যাণে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এ সম্পর্কে অবগত হতে পারে। এতে সরকারের ব্যবস্থা নিতে হতে পারে। এটা আবার দুইভাবে হতে পারে—প্রথমত, সরকারের সহানুভূতির কারণে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বিপদগ্রস্ত মানুষ সম্পর্কে জানতে পারে; দ্বিতীয়ত, সরকারের সহানুভূতির অভাবের কারণেও ব্যাপারটা ঘটতে পারে। জন স্টুয়ার্ট মিল তো গণতন্ত্রকে ‘আলোচনাভিত্তিক শাসনব্যবস্থা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এই তত্ত্বের আলোকে দুর্ভিক্ষের হুমকিতে থাকা মানুষেরা মুক্ত গণমাধ্যম ও অবাধ আলোচনার মধ্যে উদ্ধারকর্তা খুঁজে পেতে পারেন।

সামাজিক দুর্যোগ মোকাবিলা করা যুদ্ধের মতো নয়। যুদ্ধের সময় তো নেতা নিজ ক্ষমতাবলে ওপর থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়, সেখানে আলোচনার জায়গা নেই। এর বিপরীতে সামাজিক দুর্যোগের সময় অংশগ্রহণমূলক শাসন ব্যবস্থা ও সচেতন গণ-আলোচনা দরকার। দুর্ভিক্ষের ভুক্তভোগীরা হয়তো তুলনামূলকভাবে সচ্ছল জনগোষ্ঠী থেকে সামাজিকভাবে পৃথক থাকেন, অন্যান্য সামাজিক দুর্যোগেও হয়তো তা-ই হয়। তবে গণ-আলোচনা শুনলে নীতিপ্রণেতারা অন্তত বুঝতে পারেন, তাঁদের কী করা দরকার। নেপোলিয়ন হয়তো শোনার চেয়ে নির্দেশ দিতে বেশি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এটা কিন্তু তাঁর সামরিক সফলতায় বাদ সাধতে পারেনি, রাশিয়া অভিযানের কথা বাদ দিলে। তবে সামাজিক দুর্যোগ মোকাবিলার সময় কথা শোনাটা খুবই প্রয়োজনীয়।

মহামারির সময়ও একই কথা প্রযোজ্য। এই সময়ে অধিক সচ্ছল মানুষেরা হয়তো রোগাক্রান্ত হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন হন, যেখানে অন্যদের আবার এর সঙ্গে আরেকটি চিন্তাও করতে হয়: আয়-উপার্জন ঠিক রাখা (রোগ বা লকডাউনের মতো রোগ প্রতিরোধে নেওয়া পদক্ষেপে যা বিঘ্নিত হয়)। আর অভিবাসী শ্রমিকদের তো এই দুটির সঙ্গে ঘরে ফেরার চিন্তাও করতে হয়। একেক শ্রেণি একেক রকম ঝুঁকির মধ্যে থাকে, এদের সবার কথাই চিন্তা করতে হবে। অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকলে এই প্রক্রিয়া অনেকটাই সহজ হয়, বিশেষ করে যদি গণমাধ্যম মুক্ত ও গণ-আলোচনা অবাধ থাকে এবং সরকারের নীতিপ্রণেতারা মানুষের কথা ও আলোচনা শুনে সিদ্ধান্ত নেন।

কোভিড-১৯-এর সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার যে রোগের বিস্তার ঠেকানোর চেষ্টা করছে, তা ঠিকই আছে। রোগের বিস্তার ঠেকানোর কৌশল হিসেবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার যে কৌশল ভারতীয় নীতিপ্রণেতারা নিয়েছেন, তা-ও ঠিক। সমস্যাটা হলো, রোগের বিস্তার ঠেকাতে এ রকম একমুখী নীতি নেওয়ার ফলে অন্যান্য নীতির কী ফল হতে পারে, আমরা তা ভাবি না। বিকল্প নীতির মধ্যে কোনোটি কোটি মানুষের জীবনে বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে, কোনোটি আবার মানুষের দুর্ভোগ ঠেকাতে পারে।

গরিব মানুষের মূল উদ্বেগ হচ্ছে কাজ ও আয় নিয়ে। সে কারণে এই দুটি হুমকির মুখে পড়লে সুরক্ষা দেওয়াটাই হচ্ছে নীতি প্রণয়নের মূল লক্ষ্য। এমনকি ক্ষুধা বা দুর্ভিক্ষের সঙ্গে অপর্যাপ্ত আয় ও গরিবদের খাদ্য কেনার সক্ষমতার অভাবের যে নৈমিত্তিক সম্পর্ক আছে, এই পরিপ্রেক্ষিতে সেটা খেয়াল রাখা উচিত। হঠাৎ করে সব অবরুদ্ধ করার ফলে লাখ লাখ শ্রমিকের আয়-উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়। এতে কিছু মানুষ ভুখা থাকবে—এ আশঙ্কা অমূলক নয়। এমনকি স্বাধীন ব্যক্তি উদ্যোগের স্বর্গভূমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বেকার ও গরিবদের সরাসরি টাকা দিচ্ছে ফেডারেল সরকার। ভর্তুকি দিচ্ছে। তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ রকম সামাজিক সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পেছনেও গণ-আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির পরামর্শও আছে।

ভারতে যদি গরিবদের বঞ্চনা থেকে রক্ষা করতে হয়, তাহলে তার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবেই ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে কিছু কিছু সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া খুব কঠিন কিছু নয়: গরিবদের কল্যাণে আরও সরকারি ব্যয় বরাদ্দ, যেমন জাতীয় পরিসরে খাবার-দাবার দেওয়া এবং ফুড করপোরেশন অব ইন্ডিয়ার গোডাউনে অব্যবহৃত পড়ে থাকা ৬ কোটি টন চাল ও গম ব্যবহার। এ ছাড়া দুর্দশাগ্রস্ত অভিবাসী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে দেওয়া, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, অসুখ ও স্বাস্থ্যসেবার প্রতি নজর দেওয়া—এসবও অনেক চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার, যা কঠোরভাবে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার বদলে ভুক্তভোগীদের কথা সতর্কতার সঙ্গে শোনাটা দাবি করে।

সামাজিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সবার কথা শোনা সরকারের মূল কাজের অংশবিশেষ হয়ে যায়। সমস্যাটা ঠিক কী, ঠিক কোথায় সবচেয়ে বেশি আঘাত এসেছে, কীভাবে তা ভুক্তভোগীদের আক্রান্ত করে, এসব বিষয় শুনে বুঝতে হবে। গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ না করে বা ভিন্নমতাবলম্বীদের হুমকি না দিয়ে গণ-আলোচনার মধ্য দিয়ে শাসনব্যবস্থা অনেকটাই উন্নত করা যায়। মহামারি সামাল দেওয়া যুদ্ধের মতো মনে হতে পারে, কিন্তু এটা সামাল দিতে আমাদের যুদ্ধের চেয়ে অনেক বড় কর্মযজ্ঞে নামতে হবে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সৌজন্যে
অমর্ত্য সেন: অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ। থমাস ডব্লিউ ল্যান্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও দর্শনের অধ্যাপক।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
MD. SIDDIQUL ALAM (REZA)
Senior Assistant Director
(Counseling & Admission)
Employee ID: 710000295
Daffodil International University
Cell: 01713493050, 48111639, 9128705 Ext-555
Email: counselor@daffodilvarsity.edu.bd