আত্মহত্যা নয়, জীবনকে ভালোবাসতে হবে
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
(দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫ জুন ২০২০)
বলিউড তারকা সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যাসংক্রান্ত খবর ১৪ জুন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমেও তা ফলাও করে প্রকাশিত হয়। ঐদিন সুশান্তের বাড়ি থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করার পাশাপাশি অ্যান্টি ডিপ্রেশন ওষুধ ও প্রেসক্রিপশন উদ্ধার করা হয়। নায়ক সুশান্তর আত্মহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই ফেইসবুকে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। আবার অনেকেই হয়েছেন বিমোহিত। কারণ প্রিয় নায়কের অস্বাভাবিক মৃত্যু, মন থেকে যা মেনে নেওয়া যায় না। সুশান্তের বাসা থেকে তার লাশসহ অ্যান্টি ডিপ্রেশন ওষুধ ও প্রেসক্রিপশন উদ্ধারের মাধ্যমে ধরে নেওয়া যায় যে এটি একটি আত্মহত্যা। শুধু বলিউড তারকা সুশান্তই নন, বরং পত্রিকার পাতা খুললে প্রায়ই চোখে পড়ে আত্মহত্যাসংক্রান্ত খবরাখবর। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন জনগণের আত্মহত্যাসংক্রান্ত খবরাখবর প্রায়ই চোখে পড়ে। বলা বাহুল্য, আত্মহত্যা হচ্ছে মানবজীবনের এক চরম অসহায়ত্ব, ক্ষণিকের আবেগে একটি মহামূল্যবান জীবনের চির অবসান ঘটানো, যা কোনো কিছুর বিনিময়েই ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজের মূল্যবান জীবনকে যেমন একদিকে শেষ করে দেওয়া হয়, তেমনি অন্যদিকে একটি সম্ভাবনারও চির অবসান ঘটে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অতি প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন দেশে ‘আত্মহত্যা’ নামক এই মহাপাপ সংঘটিত হয়ে আসছে। যদিও এটিকে কোনো সমাজই কখনো ভালো চোখে দেখেনি এবং দেখবেও না। এক ব্যক্তির আত্মহত্যা করার পেছনে সাধারণত বিষণ্নতা বা Depression, আর্থিক, সামাজিক, পারিবারিক সমস্যা কিংবা নিতান্ত ব্যক্তিগত মনোকষ্ট, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া (দীর্ঘদিন ধরে ব্যর্থতা, গ্লানি বা হতাশা এবং নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, অনাগত ভবিষ্যত্ সম্পর্কে উদ্বেগ, নিঃসঙ্গতা, কর্মব্যস্ততাহীন দিন যাপন ইত্যাদি মানব মস্তিষ্ককে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত করে), পারসোন্যালিটি ডিসঅর্ডার, এনজাইটি ডিসঅর্ডার, অ্যালকোহল ব্যবহারজনিত ডিসঅর্ডার ইত্যাদি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) পরিসংখ্যানমতে, বিশ্বে প্রায় ১২১ মিলিয়ন মানুষ মাত্রাতিরিক্ত বিষণ্নতার শিকার। WHO-র বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, ২০২০ সালের মধ্যে হূদেরাগের পরেই বিষণ্নতা মানব সমাজের বিপন্নতার দ্বিতীয় কারণ হিসেবে প্রতীয়মান হবে। WHO-র জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে বার্ষিক আত্মহত্যার হার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। জরিপে দেখা যায়, শুধু ২০১২ সালে সারা বিশ্বে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৮ লক্ষ ৪ হাজার। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একটি করে আত্মহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। তবে ১৫-২৯ বছর বয়সিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। আর বাংলাদেশে বার্ষিক আত্মহত্যার সংখ্যা গড়ে ১০ হাজার ২২০টি, যার মধ্যে ৫৮ থেকে ৭৩ শতাংশ আত্মহত্যাকারীই নারী। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষার্থীই হতাশা, মানসিক অশান্তি ও মানসিক অস্থিরতায় ভুগছে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারসহ সংগত নানা কারণে পূর্বের তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ অবস্থা যেন অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রেমে ব্যর্থতাসহ বিভিন্ন কারণে হতাশা, মানসিক অশান্তি ও মানসিক অস্থিরতার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা বেড়েই চলেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা, আত্মহত্যা চেষ্টার প্রবণতা বেড়ে চলাসহ অনেক শিক্ষার্থী মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতায় ভুগলেও অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নেই কোনো পেশাদার পরামর্শক বা কাউন্সিলর। কোনো শিক্ষার্থী যদি আত্মহত্যা করে বা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে, তবে তা হবে সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জার একটি বিষয়। কারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তাদের পরিবারসহ সমাজ, দেশ ও জাতি ভালো অনেক কিছু আশা করে। একজন শিক্ষার্থীকে স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আসতে তার অভিভাবকসহ ঐ শিক্ষার্থীকে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রাম করতে হয়। পাড়ি দিতে হয় অনেক দুর্গম ও বন্ধুর পথ। এ বিষয়গুলো প্রত্যেক শিক্ষার্থীরই উপলব্ধি করা প্রয়োজন। তাদের স্মরণ রাখা উচিত, অনেক আশা-ভরসা নিয়ে তাদের বাবা-মা বা অভিভাবকেরা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া শেখাতে পাঠান।
মানুষের জীবনে সমস্যা আসে এবং সমস্যা আসবেই—এটিই স্বাভাবিক। তার মানে এই নয় যে জীবনে সমস্যা এলে বা সমস্যায় পড়লে আত্মহত্যা করে জীবনকে শেষ করে দিতে হবে। বরং জীবনে সমস্যা এলে সবাইকে আবেগনির্ভর না হয়ে সুস্থ মস্তিষ্কে ও বাস্তবতার আলোকে সেই সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া। যখন কেউ আত্মহত্যা করে বা আত্মহত্যার চেষ্টা করে, তখন ধরে নেওয়া হয় যে এটি তার মানসিক অস্থিরতা বা আবেগ দ্বারা তাড়িত হওয়ার ফলাফল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আত্মহত্যার পেছনের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে পারিবারিক বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হওয়া, সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটা, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল লাভ করতে না পারা, অপরিসীম অর্থকষ্ট, ধর্ষণ, যৌন, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন-নিপীড়ন, মাদকাসক্তিসংক্রান্ত সমস্যা, নানা ধরনের মানসিক অসুস্থতা ইত্যাদি। এসবের পাশাপাশি রয়েছে প্রিয় কোনো নেতা, অভিনেতা, শিল্পী, খেলোয়াড়ের আকস্মিক মৃত্যুর খবর; কর্মস্থল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহকর্মী বা সহপাঠীদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হওয়া, দীর্ঘদিনের বেকারত্ব বা হঠাত্ চাকরিচ্যুতি বা চাকরিতে পদাবনতি ঘটা; ‘এ পৃথিবীতে কেউ আমাকে চায় না’, ‘এ পৃথিবীতে বেঁচে থেকে আমার কোনো লাভ নেই’—এজাতীয় বদ্ধমূল চিন্তাভাবনা ইত্যাদি। এসব চিন্তার কারণে মনের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া প্রচণ্ড রকমের হতাশা ও ক্ষোভের কারণে মানুষ তার নিজের প্রতি আস্থা ও সম্মানবোধ হারিয়ে ফেলে। আর তখন থেকেই সে সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে এবং একসময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আবার কিছু ব্যর্থতাও মানুষকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়। পরিবারের সব সদস্যের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে না পারা, দীর্ঘদিনেও ঋণমুক্তির উপায় খুঁজে না পাওয়া ইত্যাদি। এছাড়া প্রেমে ব্যর্থতাসহ প্রেমিক-প্রেমিকার ইচ্ছাপূরণের জন্য জেদের বশবর্তী হয়েও অনেক তরুণ-তরুণীকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে দেখা যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। বলা বাহুল্য, আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য। অধিকাংশ ব্যক্তিই আত্মহত্যার সময় কোনো-না-কোনো গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, শারীরিক ও মানসিক যেকোনো অসুস্থতায় যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা লাভের সুযোগ আত্মহত্যার প্রবণতা কমায়। পাশাপাশি আত্মহত্যা প্রতিরোধে কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলোকে প্রোটেকটিভ ফ্যাক্টর বা রক্ষাকারী বিষয় বলা হয়। যেমন জীবনের খারাপ সময়গুলোতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা জন্মানো, নিজের প্রতি শ্রদ্ধা ও আত্মবিশ্বাস জন্মানো, সমস্যা সমাধানের কার্যকর দক্ষতা বাড়ানো, প্রয়োজনে অন্যের কাছ থেকে ইতিবাচক সহায়তা লাভের চেষ্টা করা ইত্যাদি। তাছাড়া সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি, অনুশাসন, ভালো বন্ধু, প্রতিবেশী ও সহকর্মীর সঙ্গে সামাজিক সুসম্পর্ক প্রভৃতি আত্মহত্যার প্রবণতা হ্রাসে সহায়তা করে। এছাড়া সুষম খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত নিদ্রা, নিয়মিত শরীরচর্চা, ধূমপান ও মাদকাসক্তি থেকে দূরে থাকা তথা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং শারীরিক ও মানসিক যেকোনো অসুস্থতায় যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা লাভের সুযোগ আত্মহত্যার প্রবণতা কমায়। সুতরাং, শিক্ষার্থীদের হতাশা ও মানসিক অশান্তি থেকে উত্তরণের জন্য দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দ্রুত পেশাদার কাউন্সিলর নিয়োগ করা প্রয়োজন। আর তা সম্ভব হলে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার চেষ্টা চালানো কিংবা আত্মহত্যা করার প্রবণতা অনেকটাই কমে আসবে বলে আশা করা যায়। সর্বোপরি, আত্মহত্যার বিভিন্ন নেতিবাচক দিক তুলে ধরে নিয়মিতভাবে তা প্রচার-প্রচারণারও ব্যবস্থা করা আবশ্যক। শিক্ষার্থীসহ সবাইকে জীবনের গুরুত্ব ও মূল্য সম্পর্কে বুঝতে হবে। সবাইকে বুঝতে হবে যে জীবন একটাই এবং তা মহামূল্যবান। জীবন একবার হারালে তা আর কোনো কিছুর বিনিময়েই ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। এবং জীবনটাকে যদি সুন্দরভাবে সাজানো যায়, তাহলে জীবনকে সুন্দরভাবে উপভোগও করা যায়। তাই আসুন, আমরা সবাই আত্মহত্যার চিন্তা ও আত্মহত্যার পথ পরিহার করে এখন থেকেই আমাদের জীবনটাকে ভালোভাবে ভালোবাসতে শিখি।
লেখক :সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
Link:
https://www.ittefaq.com.bd/print-edition/opinion/161085/%E0%A6%86%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE-%E0%A6%A8%E0%A7%9F-%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%B9%E0%A6%AC%E0%A7%87?fbclid=IwAR3wq9_OZy_2z26duUWPplBzcibiXmOptZ7jFjUECM-E4b6XMr-te3N7lZw