অবজ্ঞা ও মানসিক নির্যাতনের ফলে শারীরিক, মনঃসামাজিক এবং জ্ঞানের বিকাশজনিত নানা ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। সাধারণত শিশুদের তিরস্কার করা এবং আবেগীয়ভাবে বঞ্চিত করার ফলে তাদের মধ্যে নেতিবাচক আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। ভবিষ্যতে তাদের নিজেদের মধ্যেও সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক এবং অতি সচেতনতামূলক প্যারেন্টিং মডেল তৈরি হতে পারে। অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়ানোর ফলে শিশুদের মধ্যে ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটি তৈরি হয়, যা পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে কনডাক্ট ডিজঅর্ডার ও অ্যান্টি-সোশ্যাল পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার হয়ে থাকে। অবজ্ঞা ও মানসিক নির্যাতনের ফলে কিছু উল্লেখযোগ্য সমস্যা তুলে ধরা হলো
শারীরিক ও মানসিক বিকাশজনিত ঘাটতি
কোনো রকম স্পষ্ট জৈব কারণ ছাড়াই কিছু শারীরিক ও মানসিক বিকাশজনিত ঘাটতি হয়ে থাকে। যেমন:
—বয়সের তুলনায় বাচ্চার ওজন এবং উচ্চতার ঘাটতি
—খাবার খেতে না চাওয়া, বমি ও ডায়রিয়া হওয়া
—পেশি-সঞ্চালনজনিত বিকাশের সমস্যা
—ভাষা ও বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে পেছানো
—অনিরাপদ আবেগীয় সম্পৃক্ততা বা ইনসিকিওর অ্যাটাচমেন্ট তৈরি হওয়া
—অনেক ক্ষেত্রে কিছু অস্বাভাবিক শারীরিক লক্ষণ প্রকাশ পায় (যেমন চিকন হাত-পা, বড় পেট, ঠান্ডা হাত-পা, চুল পড়া, চোখের নিচে কালি পড়া, ঘন ঘন ঠান্ডা লাগা ইত্যাদি)।
—মানসিকভাবেও কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন অলসতা, নিষ্ক্রিয়তা, কম কথা বলা, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা, মন খারাপ থাকা, কান্না ভাব থাকা, ঘ্যান ঘ্যান করা, খুব কম হাসিখুশি থাকা, সামাজিক কার্যকলাপ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা, মানুষের সঙ্গে কম মেলামেশা করা ইত্যাদি।
মনঃসামাজিক বিকাশজনিত ঘাটতি
শারীরিক ও বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে পিছিয়ে থাকার পাশাপাশি সামাজিক এবং আবেগীয় দিক থেকেও কিছু অপরিপক্ব আচরণ দেখা দেয়। যেমন:
—গ্রোথ হরমোন কমে যাওয়া, ওজন ও উচ্চতার সঙ্গে মাথার আকারও ছোট হওয়া।
—খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক কিছু অভ্যাস তৈরি হওয়া; যেমন-অতিরিক্ত খাবার খাওয়া, ময়লার ঝুড়ি থেকে নষ্ট খাবার খাওয়া, অপরিচিত লোকের কাছে চেয়ে খাবার খাওয়া, খাবার জমিয়ে রাখা, চুপি চুপি খাবার খোঁজা, এমনকি রাতের বেলায়ও।
—গুরুত্বপূর্ণ আবেগীয় সম্পৃক্ততার সমস্যা হওয়া; যেমন মায়ের সঙ্গে কথা বলতে না চাওয়া, তাদের সঙ্গে শিক্ষার্থী-শিক্ষকসুলভ আচরণ করা, আক্রমণাত্মক আচরণ করা, অবাধ্য হওয়া এবং বাইরের লোকের সঙ্গে অনুপযুক্ত আচরণ করা।
—নিজেকে আঘাত করার মতো আচরণ করা; যেমন মাথায় আঘাত করা, হাত-পা কাটাকাটি করা ইত্যাদি।
—ঘন ঘন প্রস্রাব ও পায়খানা করা এবং ইচ্ছাকৃতভাবে যেখানে সেখানে তা লুকিয়ে রাখা।
আবেগীয় সম্পৃক্ততার ঘাটতি বা ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট প্রবলেম
অ্যাটাচমেন্ট বা আবেগীয় সম্পৃক্ততা হলো কারও সঙ্গে খুব গভীর ভালোবাসা ও আবেগীয় সংযোগ তৈরি হওয়া, যেমন- মায়ের সঙ্গে সন্তানের গভীর ভালোবাসা ও নির্ভরতার সম্পর্ক। এই আবেগীয় সম্পৃক্ততা সন্তানকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে থাকে। মানসিক নির্যাতনের শিকার শিশুদের মধ্যে বিশেষ করে অবহেলিত এবং শাস্তিমূলক প্যারেন্টিংয়ের কারণে শিশুদের মধ্যে আবেগীয় সম্পৃক্ততার ঘাটতি এবং অনিরাপদ আবেগীয় সম্পৃক্ততা (ইনসিকিউর অ্যাটাচমেন্ট) দেখা দেয়।
এ ছাড়া অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিজঅর্ডারসহ অনেকের মধ্যেই নিষিদ্ধ সম্পর্ক তৈরি হতে দেখা যায়। এই ধরনের অ্যাটাচমেন্ট ডিজঅর্ডারের সঙ্গে সম্পর্কজনিত সমস্যা (রিলেশনশিপ প্রবলেম), আত্মসম্মানবোধের অভাব, ভীতিমূলক আচরণ, আক্রমণাত্মক আচরণ, অবাধ্যতা, উগ্র মেজাজ ইত্যাদি সংযুক্ত থাকে এবং যা থেকে শিশুর মধ্যে পরবর্তী সময়ে ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, কনডাক্ট ডিজঅর্ডার, অ্যান্টি-সোশ্যাল পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার ও অন্যান্য পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার হওয়ার অধিক সম্ভাবনা থাকে।
পারসোনালিটি ডিজঅর্ডারের ক্ষেত্রে ব্যক্তি দীর্ঘদিন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ধরে রাখতে পারে না, সব সময় অতিরিক্ত ভালোবাসা ও মনোযোগ প্রত্যাশা করে, প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলার ভয় থেকে তাকে খুব আঁকড়ে ধরতে চায়, ফলে সম্পর্কের অবনতি হয়। এই ধরনের ব্যক্তি সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না, অন্যকে দোষারোপ করে, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, অতি আবেগীয় আচরণ করে ও মাদকের অপব্যবহার করে থাকে।
এ ছাড়া আরও কিছু গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী, অবজ্ঞা ও মানসিক নির্যাতনের ফলে ব্যক্তির মধ্যে যেসব আচরণ দেখতে পাওয়া যায় তা হলো রাগ করা, ভাঙচুর করা, চুরি করা, জিনিসপত্র নষ্ট করা, অবাধ্য হওয়া, আত্মসম্মানবোধের ঘাটতি, উদ্বিগ্ন হওয়া, এড়িয়ে চলা, আবেগীয় প্রকাশভঙ্গির ঘাটতি, বিকাশজনিত ঘাটতি বিশেষ করে ভাষা ও জ্ঞানীয় বিকাশের ঘাটতি, পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অদক্ষতা, আক্রমণাত্মক আচরণ, সংবেদনশীলতার অভাব, হিংস্র আচরণ, সমালোচনা করা, মা- সন্তানের মাঝে আবেগীয় সম্পর্কের প্রতি অনাগ্রহতা, খারাপ একাডেমিক পারফরম্যান্স, মনোযোগের অভাব, অতি চঞ্চলতা ও অস্বাভাবিক আচরণ।
লেখক: ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিট, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
Ref:
https://www.prothomalo.com/life/health/%E0%A6%B6%E0%A7%88%E0%A6%B6%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%85%E0%A6%AC%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%9E%E0%A6%BE-%E0%A6%93-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A6%95-%E0%A6%AB%E0%A6%B2