আসামিরা পালানোর সুযোগ পায় কীভাবে
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
১৩ মার্চ ২০২১
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পুলিশ হচ্ছে প্রধান আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, যা সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। ইংরেজিতে POLICE শব্দটির পূর্ণরূপ করলে দাঁড়ায় P= Polite, O= Obedient, L= Loyal, I= Intelligent, C= Courageous, E= Eager to help or Efficient. পুলিশ জনগণের বন্ধু তথা জনগণের সেবক হিসাবে কাজ করবে এবং তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করবে- জনগণ এমনটাই প্রত্যাশা করে।
কিন্তু যখন দেখা যায় কতিপয় পুলিশ সদস্য তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন না বা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দেন, তখন উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। ইদানীং দেশের কারাগার, হাসপাতাল ও আদালত থেকে প্রায়ই কারাবন্দি পালানোর ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যসহ জেলারদের দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলার প্রমাণ পাওয়া যায়, তেমনি কারাগারের বা পুলিশি হেফাজতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, তাও ফুটে ওঠে।
পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হচ্ছে, পুলিশি হেফাজত থেকে আসামির পলায়নের ঘটনা। আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়, যা দুঃখজনক। পুলিশ হেফাজত থেকে যদি আসামি পলায়ন করে বা ‘বিশেষ সুবিধা’র কারণে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্য কর্তৃক আসামিকে পালানোর সুযোগ(!) করে দেওয়া হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে একদিকে যেমন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা কঠিন বিষয় হয়ে পড়ে, তেমনি অপরদিকে ভুক্তভোগী বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি অনেক সময় ন্যায্য প্রতিকার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন।
সর্বোপরি, পলায়নকারী আসামি ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা সাক্ষীদের জন্য এবং সাক্ষ্যের জন্য বিরাট হুমকি বা ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। অনেক সময় তা ক্ষতির কারণ হিসাবেও দেখা দেয়। এ দেশে পুলিশি হেফাজত ও কারাগার থেকে অনেক সময় সাধারণ আসামি থেকে শুরু করে হত্যা মামলার আসামি পর্যন্ত পলায়নের নজির রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
যেমন- গত ৬ মার্চ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফরহাদ হোসেন রুবেল নামের এক বন্দি উধাও হয়ে যায়। এর আগে গত বছরের ৬ আগস্ট কাশিমপুর কারাগার থেকে মইয়ের সাহায্যে পালিয়ে যান যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি আবু বক্কর ছিদ্দিক। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলায় পুলিশের কাছ থেকে পালিয়ে যায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত মো. পলাশ নামের এক আসামি। এর আগে চাঁদপুর জেলা কারাগার থেকে মোখলেছুর রহমান নামের বিচারাধীন মামলার এক আসামি দেওয়াল টপকে পালিয়ে যায়।
এ ছাড়া ২০১৯ সালের ১৮ জুন নোয়াখালী জেলা জজ আদালতের হাজতখানা থেকে কারাগারে নেওয়ার পথে হাতকড়াসহ পালিয়ে যায় সাহাব উদ্দিন ওরফে সুজন নামের মাদক মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি। হত্যা মামলার আসামি কিংবা পুলিশের হেফাজতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আসামি পলায়নের পাশাপাশি ধর্ষণ মামলার আসামি পলায়নের ঘটনাও রয়েছে।
যেমন- ২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর রাজধানী ঢাকার উত্তর বাড্ডায় এক গারো তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে এক ডজন মামলার আসামি রাফসান হোসেন রুবেলকে গ্রেফতারের জন্য ব্যাপক তৎপরতা চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এক পর্যায়ে র্যাবের হাতে ধরা পড়ে রুবেল। পরে তাকে আদালতে তোলা হয় এবং পুলিশের কর্তব্যরত দুজন সদস্যের ‘চোখ ফাঁকি’ দিয়ে হাতকড়াসহ আদালত থেকে পালায় রুবেল। আবার থানা থেকেও আসামি পালানোর ঘটনা দেখা যায় অনেক সময়।
যেমন- ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর পল্লবী থানা থেকে আতিকুর রহমান ওরফে সূর্য নামে রিমান্ডে থাকা এক আসামি পালিয়ে যায়। আতিকুর দীর্ঘদিন ধরে পল্লবীর এভিনিউ ৫ এলাকায় একটি বাসায় অসামাজিক কার্যকলাপ করে আসছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ পাওয়ার পর ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে আতিকুরসহ পাঁচজনকে আটক করা হয়। ওই বাসা থেকে এক নারীকেও উদ্ধার করা হয়।
বিচারের কাঠগড়া থেকে আসামি পালানোর প্রকৃষ্ট উদাহরণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুবায়ের হত্যা মামলার চার আসামির আদালত থেকে পালানোর ঘটনা। জুবায়ের হত্যা মামলার চার আসামি আশিকুর রহমান, খান মোহাম্মদ ওরফে রইস, মাহবুব আকরাম ও ইশতিয়াক ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আদালতের কাঠগড়া থেকে পালিয়ে যায়। ওইদিন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ৪-এ এই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ এবং ছয় আসামির জামিন বাতিলের বিষয়ে আদেশের দিন ধার্য ছিল।
বিচারক এবিএম নিজামুল হক আসামিদের জামিন বাতিলের আদেশ দেওয়ার পর আদালতে উপস্থিত ওই চার আসামি কাঠগড়া থেকে পালিয়ে যায়। উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদকে কুপিয়ে জখম করে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীরা। পরদিন ভোরে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান জুবায়ের। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ডেপুটি রেজিস্ট্রার হামিদুর রহমান বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এসবের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীও পুলিশের হেফাজত থেকে পালানোর ঘটনা ঘটেছে। যেমন- ২০১৬ সালের ১১ মার্চ কক্সবাজারের টেকনাফে আটকের পর থানায় নিয়ে যাওয়ার সময় হাতকড়া পরা অবস্থায় পালিয়ে যায় ইয়াবা ব্যবসায়ী নুরুল হুদা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ৭৬৪ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর মধ্যে নুরুল হুদার নাম ছিল ১ নম্বরে।
উল্লিখিত ঘটনাগুলো ছাড়াও পুলিশি হেফাজত থেকে আসামি পালিয়ে যাওয়ার অনেক ঘটনার নজির রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশি হেফাজত কিংবা কারাগার থেকে আসামি পালিয়ে যাওয়া বা উধাও হওয়ার ঘটনার মাধ্যমে কি সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যসহ জেলারদের দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলার বিষয়টি ফুটে ওঠে না এবং তা কি কারাগারের দুর্বল নিরাপত্তার চিত্র তুলে ধরে না?
১৮৬১ সালের পুলিশ অ্যাক্টের ২৯ ধারায় পুলিশ সদস্যদের দায়িত্বে অবহেলার জন্য সুস্পষ্টভাবে শাস্তির কথা বলা আছে। অনেক সময় দেখা যায়, এ ধরনের ঘটনা ঘটার পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যকে শাস্তি হিসাবে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় অথবা জেলার বা ডেপুটি জেলারকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলাকারীরা ‘ছাড়’ পেয়েও যায়।
পুলিশি হেফাজত থেকে আসামির পালিয়ে যাওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যরা আসামির পক্ষ থেকে ‘বিশেষ সুবিধা’ নিয়ে থাকেন কিনা, তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবার ভালোভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। আর এ ধরনের ঘটনা কেউ ঘটিয়ে থাকলে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ঠিক রাখতে সঠিক তদন্তপূর্বক দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
পাশাপাশি জেল সুপার ও জেলার যদি কারা অভ্যন্তরে নিয়মিত তদারকি করেন, ডেপুটি জেলাররা যদি তাদের নির্দিষ্ট এলাকাগুলো নিয়মিত তদারকিপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন এবং কারারক্ষীরা যদি নিষ্ঠা আর আন্তরিকতার সঙ্গে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে কারাগারের ভেতর থেকে আসামিরা পালানোর সুযোগ পাবে বলে মনে হয় না।
পুলিশ বাহিনী এবং জেলার সম্পর্কে জনগণের ভালো ধারণা বজায় রাখতে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে এবং সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যসহ জেলারদের দায়িত্বশীলতার সর্বোচ্চ পরিচয় দিতে ভবিষ্যতে আর কোনো আসামি যেন পুলিশি হেফাজত থেকে পালানোর সুযোগ না পায়, সেদিকে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; সহযোগী সদস্য, সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব গ্লোবাল হিউম্যান মুভমেন্ট, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি (যুক্তরাজ্য)
kekbabu@yahoo.com
Link:
https://www.jugantor.com/todays-paper/window/401312/%E0%A6%86%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A6%BE-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8B%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%AF%E0%A7%8B%E0%A6%97-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%95%E0%A7%80%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%87