« on: January 02, 2022, 11:12:15 AM »
বান্দার হক আদায় করা ফরজ
কবি বলেছেন, ‘ এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি/রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’ পৃথিবীতে যার যত বেশি আছে, সে আরো তত বেশি চায়। অন্যকে কষ্ট দিয়ে, বঞ্চিত করে, জুলুম করে, বেশি পাওয়ার বা বেশি ভোগের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় এবং পেশিশক্তি বলে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করে। যার ফলে অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ন হয় বা বান্দার হক নষ্ট হয়। বান্দার হক বা হককুল ইবাদ একটি বিস্তৃত বিষয়। বান্দাহ অর্থ আল্লাহর গোলাম, আর হক অর্থ অধিকার বা মানবাধিকার। বান্দার হক মানে মানুষের অধিকার বা মানবাধিকার। অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ হরণ করা, নষ্ট করা, আর্থিক, দৈহিক ও মর্যাদার ক্ষতিসাধন করা, কারো ন্যায্য অধিকার হরণ করা এবং ইনসাফবিরোধী কাজ করাই হচ্ছে বান্দার হক নষ্ট করা। বান্দার হক নষ্ট করলে বান্দাহ ক্ষমা না করলে আল্লাহ পাকও তা ক্ষমা করেন না। মহান আল্লাহ কুরআন মজিদে ফরমান, ‘তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ করো না।’ (সূরা বাকারা-১৮৮)।
মানুষের প্রতি অবিচার করতে নিষেধ করে আল্লাহপাক কুরআনে ইরশাদ করেন ‘তোমরা যখন বিচার করো, তখন ন্যায়-সঙ্গতভাবে বিচার করো।’ (সূরা নিসা-৫৮)।
আদল বা ন্যায় নিষ্ঠা আল্লাহর গুণ, এ গুণে সমৃদ্ধ হওয়া ঈমানদারের কর্তব্য। সেই শ্রেষ্ঠ মানুষ যে মানুষের সর্বোত্তম কল্যাণ করে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ, শাসক-শাসিত নির্বিশেষে সব মানুষের হক ও সম্মান রক্ষায় প্রিয় নবী সাঃ অভূতপূর্ব অবদান রেখেছেন। বিশ্বনবী সাঃ বলেন, ‘যদি কোনো বক্তি অন্যের এক বিঘত পরিমাণও জমি জবরদখল করে, তাহলে কিয়ামতের দিন সাত তবক জমিন তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে।’ (মুসলিম)। আল কুরআনে কারো কুৎসা রটনা করা, গিবত করা, কাউকে হেয়প্রতিপন্ন করা, তিরস্কার করাকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
‘উপযুক্ত কারণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে আদালতে নালিশ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গোপনে দোষ অনুসন্ধান করা হারাম, কারো সম্পর্কে অকারণে কুধারণা পোষণ করা হারাম ঘোষিত হয়েছে।’ (সূরা হুজরাত-১২)।
ইসলামের বিধান অনুসারে শিশুর জন্য মায়ের বুকের দুধের হক, স্বামীর কাছে স্ত্রীর মোহরানার হক, উপার্জনক্ষম সন্তানের নিকট বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভরণপোষণের হক, আত্মীয়-স্বজনের হক, প্রতিবেশীর হক, দাস-দাসি ও শ্রমিকের উপযুক্ত মজুরির হক, দরিদ্রের হক, মুসাফিরের হক, অসহায় এতিমের হক সবই হককুল ইবাদ। এ সব বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাঃ এত বেশি বলেছেন যার কোনো তুলনা নেই। নবীজী সাঃ আল্লাহর নামে তিন-তিনবার কসম খেয়ে বলেছেন ‘যে ব্যক্তি প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে নিজে পেটপুরে খায় সে মুমিন নয়।’ আল কুরআনে একে অপরের সম্পদ অবৈধভাবে ভোগদখল হারাম ঘোষিত হয়েছে। সঠিক মাপ নিশ্চিত করে সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান করা হয়েছে। রাসূল পাক সাঃ বলেন, যে ব্যক্তি কারো উত্তরাধিকার হরণ করে, আল্লাহ তায়ালা তার জান্নাতের উত্তরাধিকার হরণ করবেন (সুনানে ইবনে মাজাহ)। তিনি আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কারো ধন-সম্পদ ও পরিবারপরিজনের ব্যাপারে ধোঁকা দেয় সে জাহান্নামি।’ নিশ্চিয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে ন্যায় নিরপেক্ষতা ও সহমর্মিতার নির্দেশ দিচ্ছেন। (নাহল-৯০)।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ‘আদল’ ও ‘ইহসান’ প্রতিষ্ঠার নির্দেশ প্রদান করেছেন। তোমরা ন্যায়ের ঝাণ্ডা উঁচু করে দাঁড়াও যদিও তা তোমাদের নিজেদের ওপর আপতিত হয়। কিয়ামতের দিন প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নিশ্চয়ই মানুষের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং অনুভবশক্তি (বিবেক) সম্পর্কে (কিয়ামতের দিন) প্রশ্ন করা হবে। আল্লাহপাক আরো বলেন, ‘শুধু তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে থাকে। জুলুমবাজরা (বান্দার হক নষ্টকারীরা) তাদের অত্যাচারের পরিণতি অচিরেই জানতে পারবে। (সূরা-২২)।
তাই প্রত্যেক মানুষের উচিত বান্দার আচরণগত হক এবং বৈষয়িক বা আর্থিক লেনদেনসংক্রান্ত হক যথাসম্ভব আদায়ের জন্য দায়িত্ব সচেতন হওয়া। আল্লাহ ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিদের খুবই ভালোবাসেন (মায়েদা-৪২)।
মালিক শ্রমিকের সাথে, কর্মকর্তা কর্মচারীর সাথে, শাসক শাসিতের সাথে সদ্ব্যবহার না করা, কেউ কারো সাথে অসৎ ব্যবহার করা, অনর্থক কারো সাথে কটুবাক্য প্রয়োগ করা, গালমন্দ করা, কাউকে মারধর করা ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির হক নষ্ট করার পর্যায়ভুক্ত। প্রকৃতপক্ষে ওইসব ব্যক্তির অধিকার রয়েছে তাদের কাছ থেকে সুন্দর ও ভালো আচরণ পাওয়ার। আল্লাহ বলেন, যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে (আহযাব-৫৮)।
স্ত্রীর জন্য স্বামীর ওপর বিয়ের দেনমোহর আদায় করা ফরজ। এ হক থেকে স্ত্রীকে বঞ্চিত করা, দুর্বলদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে নির্দিষ্ট পাওনা থেকে বঞ্চিত করা, কারো টাকা-পয়সা, সম্পদ বা অন্যান্য মালামাল অবৈধভাবে ভোগ করা বা যার যা প্রাপ্য তাকে তা থেকে বঞ্চিত করা, এসবই বৈষয়িক বা আর্থিক লেনদেনসংক্রান্ত হক। বান্দার এ সব হক নষ্টের জন্য অবশ্যই একদিন আল্লাহপাকের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। রাজা-প্রজা, মালিক-শ্রমিক বিত্তশালী-বিত্তহীন কাউকেই সেদিন বান্দার হক নষ্টের জন্য ছাড় দেয়া হবে না।
এ জীবনে চলার পথে, কথাবার্তায়, আচার-আচরণে, কাজকর্মে লেনদেনে অন্যের হক রয়েছে। তাই অন্যের হক বা অধিকারের বিষয়টি চিন্তা করে আমাদের বিবেক সচেতন হয়ে চলতে হবে, যাতে কারো হক নষ্ট না হয়। হে আল্লাহ! আমাদের বান্দার হক আদায়ে তৌফিক দান করুন এবং সততা, বিনয় অল্প তুষ্টি, শুকুরগুজারি দিয়ে আত্মাকে সুসজ্জিত করে দিন।
Logged
Hafez Maulana Mufti. Mohammad Ashraful Islam
Ethics Education Teacher, DISS
Khatib, Central Mosque, Daffodil Smart City
Ashuli , Savar, Dhaka