আমার মা বাল্যশিক্ষা পর্যন্ত পড়া। এখনও কুড়িতে কুড়িতে গণেন। বাবা বড়জোড় পঞ্চম শ্রেণী পাশ। বাবা কৃষিকাজ ও ডিলারী করতেন। সে-কালে ডিলারদের অনেক মূল্য ছিল। সরকারের সমস্ত রিলিফ স্বল্প মূল্যে ডিলার-দের মাধ্যমে জনগনের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া হতো।
সাধারনত সৎও ভাল মনের মানুষদেরকেই ডিলার হিসাবে নিয়োগ দেয়া হতো। আর ডিলারী ব্যবসাটা আমাদের পৈতৃক ব্যবসা ছিল। সেজু ভাই বাবার ডিলারী ব্যবসা এখনও ধরে রেখেছেন। আমাদের বাড়ী, ‘ডিলার বাড়ী‘ হিসাবে সাটুরিয়া উপজেলার না হলেও; অন্তত দিঘলীয়া ইউনিয়নের প্রত্যেক গ্রামের মানুষ চিনেন।
আমাদের বাড়ীতে রিলিফের মাল ডেলিভারি দেয়ার দিন, হাজারো মানুষের উল্ল্যাস, চেঁচামেচি আর হাঁক-ডাক লেগেই থাকতো। বাবার সকল কাজের প্রধান সাহায্যকারী ও পরামর্শক কিম্বা বিষন্নতাভোগি ছিলেন মা।
মা, বাবাকে ‘এ্যাদু শুনছ নাকি’ বলে ডাকত। চাল, চিনি, ডাল, লবণও তেল বিতরণ করার জন্য বাহির বাড়ী আলাদা একটা ঘর ছিল। যাকে আমরা ‘বাংলা-ঘর’ বলে জানতাম। সারা দিন বাংলাঘরে বাবা চাল, চিনি, ডাল, লবণ ও তেল বিলি করতেন আর নালিশ জমা হতো মায়েয় রান্না ঘরে।
নালিশের পাল্লা অতিশয় ভারি হলে মা রান্না ঘর হতে বাহির হয়ে বাংলাঘরের পাশে গিয়ে কাশি দিতেন। হাজারো লোকের ভীরে কাশির শব্দ শুনেই বাবা বুঝতে পারতেন। তাৎক্ষনীক তিনি ঘর হতে বাহিরে আসতেন। কাঁচু-মাঁচু হয়ে বলতেন- কি হয়েছে? তাড়াতাড়ি বল..।
মা, হুকুমের সুরে বলতেন-ছমিরণ চাল ডাল ও চিনি পায়নি, ওর পরিবারের সদস্য সংখ্যা তিন। হিসাব আনুয়ায়ী ছয় কেজী চাল, দুই কেজী ডাল ও এক কেজী চিনি পায়। নয়না মিয়াকে দিয়ে চাল, চিনি ও ডাল রান্না ঘরে পাঠিয়ে দিও। টাকা আমার কাছে জমা দিয়েছে। বাবার ইতস্ততায়ও কোন কাজ হতো না। সময় মত চাল, চিনি, ডাল রান্না ঘরে চলে যেত।
এদিকে ছমিরণ মায়ের রান্না ঘরে বসে উনুণে আগুন দিয়ে ফুপিঁয়ে ফুপিঁয়ে কাদঁতো, ভাউজ, কি করি-করি বলে! মায়ের হাত হতে চাল, ডাল, লবণ ও চিনি নিয়ে বাড়ী যাবার সময় মায়ের পা ছুঁতে চাইলে মা তাকে বুকেঁ জড়িয়ে দিতেন। ছমিরণ ভাউজ’ ভাউজ; বলে স্বজোড়ে কান্নাঁয় মায়ের বুকে ভেঙ্গে পড়তো।
তখন সমাজে অর্থহীন বৃত্তহীন ছমিরনদের একমাত্র ভরসা ছিলেন আমার মা। এই সকল ঘটনা এক-দুই দিন নয়, নিত্যই আমাদের বাড়ীতে ঘটতে দেখেছি।
অবসর, সন্ধায়-পাড়ার আফাজ পাগলা, রসূলদী কাকু, সুলতান মাষ্টার, জিন্দা পাগলা, আকালী কাকু আমাদের বাড়ীতে আসতেন। বাড়ীর উঠানে জমিয়ে বৈঠকী গানের আসর বসত। বাবার কণ্ঠে-‘সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে’- গানটি শুনে মা আমাকে কোলে নিয়ে খুব কাঁন্না-কাটি করতো।
বাবা প্রয়াত হয়েছেন, আজ প্রায় ২৩ বছর। মায়ের বয়স ৮০‘এর কাছা-কাছি। ভাল ভাবে চোখে দেখেন না। আমাদের চাচিতারা বাজার সংলগ্ন চল্লিশ শতকের বাড়ীর, ছোট একটি ঘরে মা থাকেন অনেকটাই একা, নিবৃত্তচারী হয়ে। আমরা তিন ভাই ঢাকা থাকি। সকলেরই সময়ে অভাব মায়ের খোজঁ-খবর তেমন রাখতে পারি না। কিন্তু মা আমাদের খোজঁ- খবর ঠিকই রাখেন। প্রতি শুক্রবার হলেই মা শুবার ঘরের বারান্দায় এসে বসে থাকেন, আর মাঝে মাঝে আওয়াজ তুলেন- বউ কে এলো গো ...!!
আমি মায়ের ছোট সন্তান। মায়ের কাছে ছোট্র বেলায় বেশী বেশী ঘোরঘুর করতাম। এখন আর মায়ের কাছে তেমন বসা হয় না। খাবার শেষে মায়ের আঁচলে হাত মুঁছা হয় না, মায়ের কাছে বায়না ধরতে হয় না, মায়ের নতুন কাথাঁ সিলায়ে গড়াগড়ি যেতে হয় না, মায়ের আঁচলের খিঁট বাঁধা টাকা চুরি করতে হয়না। কিম্বা ক্রান্ত চোখে সাঝের সন্ধায় মা-বাবার হাত, পা টিপে দিতে হয় না। এখন আমি বৌয়ের মরমী আঁচলের সুবাসে মায়ের ভালবাসার সলিল সমাধি দিয়েছি।
আজ মা দিবস। তাই কাগজের পাতায় দু‘ছত্র লিখে মায়ের প্রতি কৃজ্ঞতা জানালাম। জানি এটি নিন্দনীয়, তবু মা কে স্বরণে-বরনে রাখার প্রচেষ্টায় মন সব সময় কাঁদে।
পৃথিবী বড়ই অদ্ভূত। আশ্রয়দাতা এখানে প্রয়োজনে আশ্রয়হীন হয়। ব্যক্তিক সুযোগ-সুবিধার কাছে ভগবান অসহায়। ভাল লাগা, ভালবাসা এখানে বিনিময়ে বিক্রি হয়। কিন্তু মাতৃত্ব-পিতার ভালবাসার প্রকৃতির ধারা স্রোতের মতো বহমান রয়ে যায়।
মা ,আমি বড় অভাগা ছেলে। আজ ‘মা দিবসে’ অবনত মস্তকে তোমাকে প্রণাম করছি, যদিও সময়ে বেড়াজালে আমি জাগতিক; তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তোমার ভালবাসার শূণ্যতা আজও আমাকে কাদাঁয়। এ জগৎ সংসারের প্রাপ্তি, ভাললাগা, ভালবাসা তোমার শূণ্যতা অসার মনে হয়। মা গো, আমি আজও তোমাকে আগের মতই ভালবাসি। আজকে মা দিবস। এই দিনে পৃথিবীর সমস্ত মা-দের পদচুম্বন করে পাপাসিক্ত দেহকে পবিত্র করতে চাই।
মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।