কাজটা কার সন্তুষ্টির জন্যে করছি সেটাই প্রথম এবং শেষ কথা
'এই দুয়ার মধ্যে আরেকটা জিনিস বেশ লক্ষ্যনীয়। ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর পুত্র ইসমাইল আলাইহিস সালামকে নিয়ে কা'বার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন শেষ করে আল্লাহর কাছে হাত তুলে দুয়া করলেন। সেই দুয়ার মধ্যে তিনি বললেন—
'হে আমাদের রব! আমাদের পক্ষ থেকে (এই কাজটাকে) আপনি কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি সবকিছু শুনেন আর সবকিছু জানেন'।- সূরা আল বাকারা— ১২৭
উনারা আসলে কাজটা কী করেছেন?
আল্লাহর নির্দেশে কা'বা ঘরের হয়তো একটা দেয়াল নির্মাণ করেছেন, অথবা কিছু পাথরকে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে কা'বা পুনঃনির্মাণের কাজটা শুরু করেছেন। কাজটা শুরু করেই তারা আল্লাহর কাছে হাত তুলে দুয়া করেছেন সবার আগে।
উনারা যেটা করেছেন সেটা পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা এবং মর্যাদাপূর্ণ একটা কাজ নিঃসন্দেহে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা যদিও সবকিছু দেখেন, কিন্তু অতি আশ্চর্যজনকভাবে ওই দুয়ার মধ্যে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম বলেননি যে—
'আমাদের রব! এই কাজটাকে আপনি আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি সবকিছু দেখেন'।
উনারা যেটা করেছেন সেটা তো দেখানোর মতোই একটা কাজ, তাই না? প্রকাশ্য দিবালোকেই তো তারা কাজটা সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু দুয়াটার মধ্যে আল্লাহর গুণবাচক 'আস-সামী' (যিনি সবকিছু শুনেন) এবং আল-আলিম (যিনি সবকিছু জানেন) নাম দুটো ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম উল্লেখ করলেও, আল্লাহর গুণবাচক নাম 'আল-বাসীর' (যিনি সবকিছু দেখেন) নামটা তিনি উল্লেখ করেননি।
কেনো তিনি আল্লাহর 'আল-বাসীর' নামটাকে বাদ দিয়ে 'আস-সামী' এবং 'আল-আলিম' নাম দুটোকে মোটাদাগে উল্লেখ করলেন, ভাবুন তো?
আমার মনে হয়— এখানে আমাদের জন্য একটা জিনিস শেখার আছে।
যা দেখা যায় তা সবসময় সত্য নয়। যা দেখা যায় তার বাইরেও অনেককিছু থেকে যায় যা আদতে দেখা যায় না।
আপনার পাড়ার চৌধুরি সাহেব ৫ লক্ষ টাকা দামের গরু কিনে কুরবানি দিচ্ছে। এই ঘটনায় আপনি যা দেখতে পাচ্ছেন তা হলো— চৌধুরি সাহেবের দিলটা অনেক বড়! এতোবড় গরু কিনে কুরবানি দেওয়ার জন্য তো ওরকম একটা কলিজাও থাকা লাগে, তাই না?
কিন্তু এই ঘটনার পেছনের যে জিনিসটা আপনি দেখতে পাচ্ছেন না তা হলো এই— চৌধুরি সাহেবের ইখলাস আদতে কতোখানি নির্ভেজাল। তিনি কি লোকেদের বাহবা কুড়ানোর জন্যে, মহল্লায় নিজের বড়লোকি প্রমাণের জন্য এতোবড় গরু দিয়ে কুরবানি দিচ্ছেন, নাকি সত্যি সত্যিই আল্লাহকে রাজি-খুশি করাই তার উদ্দেশ্য। তার আয়-উপার্জন কতোখানি হালাল আর কতোখানি হারাম— সেইটাও অনেকসময় আপনি দেখতে পান না।
বি-শা-ল দামের পশু কিনে কুরবানি দেওয়ার এই যে ঘটনা আপনি দেখতে পাচ্ছেন— এটা কিন্তু আসল দৃশ্যপট নয়। আসল দৃশ্যপট দেখা আপনার পক্ষে কখনো সম্ভবও নয়। তাহলে কে দেখতে পায় আসল দৃশ্যপট?
তিনিই দেখতে পান যিনি গোপন আর প্রকাশ্য— সবকিছু শুনেন আর সবকিছু জানেন। অন্তর যা ধারণ আর লালন করে কিন্তু প্রকাশ করে না, প্রদর্শন করে না, বলে বেড়ায় না— সেসবও তাঁর কাছে গোপন থাকে না। হারাম উপার্জনের যে টাকাটা হাত স্পর্শ করা ছাড়াই ব্যাংকে জমা হয়ে যায়, যে ঘটনা সম্পর্কে দুনিয়ার কেউ কোনোদিন জানবে না বলে আপনি বিশ্বাস করেন— আসমানের অধিপতির কাছে সেটা কখনোই অজানা নয়।
পাঁচ লাখ টাকা দামের গরু কিনে চৌধুরি সাহেব বড়লোক সাজতে চান নাকি সত্যি সত্যিই তার উদ্দেশ্য সৎ আর ইখলাস নির্ভেজাল— সেই ঘটনা কেবল জানেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা। কারণ— চৌধুরি সাহেবের অন্তরে কী বাজছে তা তিনি শুনতে পান যদিও তা মুখ দিয়ে বেরোয় না। চৌধুরি সাহেবের অন্তর কী পোষণ করছে তা তিনি জানেন যদিও চৌধুরি সাহেব সেটা কাজে প্রকাশ করে না। যেহেতু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা 'আস-সামী' তথা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবকিছু শুনেন এবং 'আল-আলীম' তথা সবকিছু জানেন, তাই তাঁর কাছ থেকে আসলে কোনোকিছুই গোপন করা যায় না।
চোখে যা দেখা যায় তা সর্বদাই সত্য নয়। তাই, ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এই দুয়ার মধ্যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালার এমন দুটো নাম ধরে দুয়া করেছেন যে নাম দুটো প্রকাশ করে দেয় মূল ঘটনার আদ্যোপান্ত। যে নাম দুটো তুলে আনে ঘটনার পেছনের ঘটনা। যে নাম দুটো অন্তরের গভীরে প্রোথিত ভাবনার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভগ্নাংশকেও জেনে ফেলে অনায়েশে।
দুয়াটার মধ্যে তিনি বলেননি— আমার রব! এই কাজ আমি সম্পন্ন করেছি। আপনি তো সবকিছু দেখেন। এখন আপনি কাজটাকে কবুল করুন।
বরং তিনি বলেছেন— 'আমার রব, কাজটা আমি সম্পন্ন করেছি। এই কাজ কী উদ্দেশ্যে, কার উদ্দেশ্যে আমি করেছি তা আপনার অজানা নয়। নিশ্চয় আপনি সব শুনেন আর সব জানেন। আমার কাজটাকে আপনি কবুল করুন।
দুয়ার এই ছোট্ট অংশেও ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম রিয়া তথা প্রদর্শনেচ্ছাকে এড়িয়ে গিয়ে অন্তরের অবস্থাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। যেন এই দুয়ার মাধ্যমে তিনি শিখিয়ে গেলেন— জীবনে আমরা যা-ই করি না কেনো, ইখলাস তথা কাজটা কার সন্তুষ্টির জন্যে করছি সেটাই প্রথম এবং শেষ কথা।
'কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ-১০'
- আরিফ আজাদ
https://www.facebook.com/arifazad.bd