ক্ষমতা ও পদের প্রভাব খাটিয়ে সম্পদ উপার্জন
ইসলাম ক্ষমতা ও পদের প্রভাব খাটিয়ে অর্থ উপার্জনকে নিষিদ্ধ করেছে। কেননা তা ঘুষ ও জুলুমের শামিল। সুতরাং কোনো ব্যক্তি তাঁর সামাজিক, রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে কোনো সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করলে বা তাঁর পরিচয়ে তাঁর আত্মীয়-স্বজন বিশেষ সুবিধা ভোগ করলে তা ইসলামী আইনে অপরাধ বলে গণ্য হবে। কেননা এর ফলে রাষ্ট্র যেমন যোগ্য কর্মী ও প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে, তেমনি একজন যোগ্য ব্যক্তি তার প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
এ ক্ষেত্রে দুটি ঘটনা দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করা যেতে পারে—এক. আবু হুমায়দ সাঈদ (রা.) বলেন, নবী (সা.) আজদ গোত্রের ইবনে উতবিয়া নামের এক লোককে সদকা সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি ফিরে এসে বললেন, এগুলো আপনাদের আর এগুলো আমাকে হাদিয়া দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, সে তার বাবার ঘরে কিংবা তার মায়ের ঘরে কেন বসে থাকল না। তখন সে দেখতে পেত, তাকে কেউ হাদিয়া দেয় কি না। যাঁর হাতে আমার প্রাণ, সেই সত্তার কসম, সদকার মাল হতে স্বল্প পরিমাণও যে আত্মসাৎ করবে, সে তা কাঁধে করে কিয়ামতের দিন উপস্থিত হবে। সেটা উট হলে তার আওয়াজ করবে, আর গাভি হলে হাম্বা হাম্বা করবে আর বকরি হলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতে থাকবে। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর দুই হাত এই পরিমাণ ওঠালেন যে আমরা তাঁর দুই বগলের শুভ্রতা দেখতে পেলাম। তিনি তিনবার বললেন, হে আল্লাহ! আমি কি পৌঁছে দিয়েছি? হে আল্লাহ আমি কি পৌঁছে দিয়েছি? (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৫৯৭)
উল্লিখিত হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার ফলে কোনো ব্যক্তিকে যদি উপহার দেওয়া হয়, তবু তা প্রত্যাখ্যান করা আবশ্যক। কেননা এসব উপহার দাতা ও গ্রহীতা উভয়কে অপরাধপ্রবণ করে তুলতে পারে।
দুই. ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর দুই ছেলে আবদুল্লাহ ও উবায়দুল্লাহ ইরাকের দিকে প্রেরিত এক সেনাদলের সঙ্গে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় তাঁরা বসরায় নিযুক্ত আমির আবু মুসা (রা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি তাঁদের স্বাগত জানালেন এবং বললেন, যদি আমি তোমাদের কোনো উপকার করতে পারতাম তাহলে অবশ্যই করতাম। তবে এখানে কিছু রাষ্ট্রীয় সম্পদ আছে, যা আমি আমিরুল মুমিনিনের কাছে পাঠাতে চাই। আর এটাও চাই যে তোমরাও পথিমধ্যে এর দ্বারা উপকৃত হও। (তা হলো, তোমরা এই সম্পদ দিয়ে স্থানীয় বাজার থেকে পণ্য কিনবে এবং মদিনায় ফেরার পর পণ্য বিক্রি করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ পরিমাণ অর্থ কোষাগারে জমা দেবে। )
তাঁরা সম্মত হলেন এবং আবু মুসা আশআরি (রা.) সম্পদ বুঝে নিতে অনুরোধ করে ওমর (রা.)-কে চিঠি লিখলেন। মদিনায় ফিরে এসে তাঁরা পণ্য বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা করলেন। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বিষয় জানতে পেরে ছেলেদের বললেন, এই সুযোগ কি বাহিনীর সব সেনা পেয়েছে? তাঁরা বললেন, না। তখন ওমর (রা.) বললেন, তোমরা খলিফার ছেলে হওয়ার কারণেই এই সুযোগ পেয়েছ। সুতরাং মূল অর্থ ও লভ্যাংশ উভয়টি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দাও। কিন্তু মজলিসে একজন বললেন, বিষয়টি আমরা তাদের জন্য ঋণ হিসেবেও বিবেচনা করতে পারি। তা এভাবে যে তারা বসরার রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ঋণ নিয়েছে এবং মদিনার কোষাগারে জমা দিচ্ছে। তার পরও ওমর (রা.) তাঁদের মূল অর্থের সঙ্গে লভ্যাংশের অর্ধেক রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
শরিয়াহ আইনে যদিও আবদুল্লাহ ও উবায়দুল্লাহর অর্থোপার্জন অবৈধ ছিল না, তবু খলিফার পুত্র হিসেবে তাঁরা এই সুযোগ পেয়েছেন—এই আশঙ্কা থাকায় ওমর (রা.) তাঁদের জন্য লভ্যাংশ গ্রহণকে বৈধ মনে করেননি। একইভাবে ওমর (রা.) কোনো ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগ দেওয়ার আগে তার ব্যক্তিগত সম্পদের হিসাব গ্রহণ করতেন। যেন সে তার পদের প্রভাব খাটিয়ে অর্থ উপার্জন করতে না পারে। (ইসলামী অর্থনীতির আধুনিক রূপায়ণ, পৃষ্ঠা ১৪২)
Source: https://www.kalerkantho.com/print-edition/islamic-life/2022/10/19/1194582