নামাজে অস্থিরতা-স্থিরতা
নিম্নের বর্ণনাটি দেখুন যেখানে একজন সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) রাসূল ﷺ এর পূর্ণ নামাজের বর্ণনা দিয়েছেন, এখানে ধীর-স্থিরতার বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন ভালো করে।
আবু হুমায়েদ আস সায়েদী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন। তিনি রাসুলুল্লাহ ﷺ এর নামাজের বিস্তারিত বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন: “রাসুলুল্লাহ ﷺ যখন নামাজের জন্যে দাঁড়াতেন, ‘আল্লাহু আকবার’ বলতেন এবং রফে ইয়াদাইন করতেন। এ সময় দুই হাত কাঁধ বরাবর উঠাতেন। তিনি নামাজে এমনভাবে দাঁড়াতেন যে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ স্ব স্ব স্থানে প্রশান্তির সাথে প্রতিষ্ঠিত হতো। তারপর (কুরআন থেকে তিলাওয়াত) কিরাআত পাঠ করতেন। কিরাআত শেষে দুই হাত কাঁধ বরাবর উঠিয়ে ‘রফে ইয়াদাইন’ করতেন। তারপর রুকু করতেন। হাতের আঙ্গুলগুলো হাঁটুতে রাখতেন স্বাভাবিকভাবে। মাথা পিঠ বরাবর রাখতেন। মাথা ঠিক ঝুঁকিয়েও রাখতেন না, আবার উঠিয়েও রাখতেন না। অতঃপর ‘সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদা’ বলে মাথা উঠাতেন। রুকু থেকে মাথা উঠিয়ে প্রশান্তির সাথে দাঁড়াতেন, এমনকি শরীরের প্রতিটি অঙ্গ স্ব স্ব স্থানে বহাল হতো। এরপর সাজদার জন্যে জমিনের দিকে ঝুঁকে পড়তেন। সাজদার সময় দুই বাহু পাঁজর থেকে দূরে রাখতেন। পায়ের আঙ্গুলগুলো কিবলার দিকে মুড়িয়ে (কিবলামুখী) রাখতেন। তারপর দুই পা বিছিয়ে দিয়ে তার উপর বসতেন। [হযরত আবু হুমায়েদ রা.-এর অন্য বর্ণনায় এসেছে, এ সময় বাম পা বিছিয়ে দিয়ে তার উপর বসতেন।] অতঃপর দ্বিতীয় সাজদায় যেতেন। অতঃপর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে বাম পা বিছিয়ে দিয়ে তার উপর বসতেন। প্রশান্তির সাথে বসতেন, এমনকি শরীরের প্রতিটি অঙ্গ স্ব স্ব স্থানে বহাল হতো।
তারপর (দ্বিতীয় রাকাতের জন্যে) দাঁড়াতেন। দ্বিতীয় রাকাতের আরকানগুলোও প্রথম রাকাতের মতোই করতেন। অতঃপর দ্বিতীয় রাকাতের তাশাহহুদ শেষ করে যখন দাঁড়াতেন, দাঁড়াবার সময় ‘রফে ইয়াদাইন’ করতেন। রফে ইয়াদাইনের হাতগুলো কাঁধ পর্যন্ত উঠাতেন, যেমনটি করতেন নামাজের শুরুতে। অতঃপর বাকি নামাজ এই একই পদ্ধতিতে পড়তেন।
অতঃপর শেষ সাজদায়, যে সাজদার পর সালাম ফিরাতে হয়, তখন দুই পা (ডান দিকে) বের করে দিতেন এবং বাম নিতম্ব জমিনে ঠেকিয়ে তার উপর ভর করে বসতেন।” [সহীহ আবু হাতিম, সহীহ মুসলিম, সূত্র: আল্লাহর রাসুল (স.) কিভাবে নামাজ পড়তেন – আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ), অনুবাদ: আব্দুস শহীদ নাসিম]
নামাজে ধীর-স্থিরতা অবলম্বন করুন। রুকু এবং সিজদাহ দীর্ঘ করতে থাকুন; প্রথমে ১০ সেকেন্ড থাকুন, এরপর ১৫ সেকেন্ড, ২০ সেকেন্ড, ১ মিনিট...বৃদ্ধি করতে থাকুন। আল্লাহর শপথ, আপনার নামাজ পূর্বের সমস্ত নামাজের চেয়েও প্রশান্তিদায়ক হবে। অর্থ বুঝে পাঠ করুন, এক তাসবিহকে আরেক তাসবিহ থেকে পৃথকভাবে পড়ুন। পড়ার মাঝে তাসবিহ এর অর্থ, জীবনের সাথে সংশ্লিষ্টতা, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক এগুলো নিয়ে ভাবুন। তাসবিহগুলো সুন্দর করে অন্তরের গভীর থেকে পাঠ করুন, যত পারেন পড়ুন। আল্লাহর সাথে অধিক সময় থাকুন – এর চেয়ে প্রশান্তিদায়ক কিছু আর হয় না, আপনার জীবনের সেরা নামাজ যেন হয় এটি, আল্লাহর সাথে কাটানো সময়টি।
আপনি যেই নামাজ পড়তে যাবেন সেটা জীবনের শেষ নামাজ হলে কেমন করে নামাজ পড়তেন? সময় নিয়ে, বিশেষ যত্নসহকারে, ধীরে ধীরে তারতীলের সাথে সুমধুর তিলাওয়াতে, সমস্ত অবস্থানে শান্তভাবে – এভাবে সুন্দর করে পড়তেন নিশ্চয়। এজন্য রাসূল ﷺ নামাজে মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে বলেছেন। নামাজে যাওয়ার আগে মৃত্যুর কথা, আমার মৃত্যু কেমন হবে ভাবুন; এখনই যদি মারা যাই তবে কি প্রশান্ত আমল নিয়ে মরতে পারবো? এভাবে আপনার প্রতিবার নামাজকে জীবনের শেষ নামাজের মতো করে চিন্তা করে নামাজে দাঁড়ান। শেষ নামাজ কেমন করতে চান, কতোটা নিমগ্ন হতে চান, আল্লাহর সাথে কতোটা আন্তরিক হতে চান সে হিসেবেই নামাজ পড়ুন।
আবু আইয়ুব (রা) কে রাসূলুল্লাহ ﷺ ঠিক এভাবে মৃত্যুর উপদেশ দিয়ে বলেন,‘‘যখন সালাতে দাঁড়াবে, মৃত্যুমুখি ব্যক্তির ন্যায় দাঁড়াবে।’’ (সুনানে আহমাদ)
আল্লাহ তায়ালা আমাদের নামাজের পূর্বেই মসজিদে আসার তাওফিক দিন। নামাজের ভেতরে যেন ইমামের আগে না যাই। নামাজে যেন তাড়াহুড়ো না করি, ধীর-স্থিরতা অবলম্বন করি প্রতিটি রুকুনে। আল্লাহুম্মা আমিন।
একটি প্রজ্ঞার কথা ধরুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন নামাজে খুশু, আল্লাহমুখিতা, একাগ্রতা ও নিষ্ঠা কতো গুরুত্বপূর্ণ। রাসূল ﷺ প্রচণ্ড গরমে একটু দেরিতে নামাজ আদায়ের কথা বলেছেন। কারণ, রাসূলুল্লাহ ﷺ গরমের জন্যে যোহর সালাত ঠাণ্ডা করে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এই হিকমাহ বা প্রজ্ঞার ব্যাপারে ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:“প্রচণ্ড গরম মুসল্লির খুশু ও একাগ্রতা দূর করে দেয় এবং তাতে সে অপ্রসন্ন ও অনীহাভাব নিয়ে ইবাদত করে। তাই শরীয়ত প্রণেতা (আল্লাহ তা’য়ালা) বিশেষ হিকমতবশত প্রচণ্ড গরমে দেরি করে সালাত পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন, যেন গরম পড়ে যায় এবং মুসল্লি অন্তর নিয়ে সালাত পড়তে সমর্থ হয়, তবেই সালাতের বিশেষ উদ্দেশ্য অর্থাৎ খুশু ও আল্লাহর প্রতি পূর্ণ মনোযোগ হাসিল হবে।” (আল-ওয়াবিলুস সায়্যিব, ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ)
সুতরাং বুঝতেই পারছেন খুশু, একাগ্রতা, আল্লাহর প্রতি মনোযোগিতার বিকল্প কিছু নামাজে নেই। নামাজ থেকে উপকারিতা পেতে হলে আপনাকে সুন্নাহ মোতাবেক সকলকিছু আদায় করতে হবে যেন আল্লাহ বর্ণিত এবং রাসূল ﷺ এর দেখানো সকল উপকারিতা নামাজ থেকে পেতে পারেন। আহমদ ইবনে সিনান (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “আমি ওয়াকীকে দেখেছি যখন তিনি সালাতে দাঁড়াতেন সামান্যতমও নড়াচড়া করতেন না এবং উভয় পায়ে ভর না দিয়ে শুধু এক পায়ে ভর করে ঝুঁকে যেতেন না।”
সালফে-সালেহীনদের নামাজের অবস্থাটা কেমন ছিলো একবার দেখুন নীচের বর্ণনায় এবং একে একে কতগুলো দিক উঠে এসেছে দেখুন এবং আপনার নামাজের সময়েও এগুলোকে অনুভূতিতে আনার চেষ্টা করুন।
ইবনে রজব (রাহিমাহুল্লাহ) উদ্ধৃত করেনঃ “হাতিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, মুয়াজ্জিনের আহ্বান শুনে সালাতের জন্যে রওয়ানা করি। ভয়ে ভয়ে পথ চলি। নিয়ত করে সালাতে প্রবেশ করি। আল্লাহর বড়ত্ব নিয়ে তাকবির বলি। তারতীল ও মনোযোগসহ তিলাওয়াত করি। একাগ্রতাসহ রুকু করি। বিনয়সহ সাজদাহ করি। তাশাহহুদের জন্যে পূর্ণরূপে বসি। পুনরায় নিয়ত করে সালাম ফিরাই। ইখলাসের সাথে সমাপ্ত করি। ভয় নিয়ে নিজেকে যাচাই করি এবং শঙ্কায় থাকি যদি আল্লাহ কবুল না করেন। আল্লাহর ইচ্ছায় আমরণ মনের ভাবটি সংরক্ষণ করতে চেষ্টা করব।”
(ইবনে রজব আল-হাম্বালী রাহিমাহুল্লাহঃ ‘আল-খুশু ফিস সালাত’)
Source: https://www.facebook.com/NAKBangla/