দারিদ্র্যবিমোচনে ‘করজে হাসানা’
সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অন্যতম হাতিয়ার করজে হাসানা। কেননা, করজে হাসানায় সুদের কোনো অস্তিত্ব থাকে না। এ ছাড়া ইসলামি অর্থনীতি মানুষকে সুদ এড়িয়ে চলতে ও সুদি লেনদেন পরিহার করতে পথনির্দেশ করে। ইসলাম সুদকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ্ ব্যবসা হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সূরা বাকারা : ২৭৫)। আধুনিক এ সমাজে সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থা গঠন করতে ইসলামের নির্দেশনা হচ্ছে করজে হাসানার প্রচার ও প্রসার ঘটানো। কুরআন ও হাদিসের একাধিক জায়গায় করজে হাসানা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবৃত হয়েছে। করজে হাসানা আরবি শব্দ এর অর্থ উত্তম ঋণ। শরিয়তের দৃষ্টিতে, ‘মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে অতিরিক্ত কোনো কিছু লাভের উদ্দেশ্য ও শর্ত ছাড়া কাউকে ঋণ প্রদান করাই হচ্ছে ‘করজে হাসানা’।
সাধারণত বিভিন্ন ব্যাংক কিংবা ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির আওতাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ নির্দিষ্ট মেয়াদে ঋণ গ্রহণ করলে তাকে এ ঋণের ওপর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদ প্রদান করতে হয়। প্রায় দেখা যায়, সমাজের অসহায় ও দরিদ্র মানুষেরা নিজেদের প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ করে পরে সময়মতো সুদসহ পরিশোধ করতে পারে না। এক্ষেত্রে অনেক সময়, দরিদ্র পরিবারগুলো নিজেদের অবশিষ্ট সম্পদ হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ে।
এক্ষেত্রে কর্জে হাসানা সম্পূর্ণ ভিন্ন। করজে হাসানা গ্রহণকারীকে কোনো সুদ প্রদান করতে হয় না। এখানে দাতাকে সময়মতো মূল অর্থ ফিরিয়ে দেওয়াই মুখ্য। কেননা, হাদিসে নববির ভাষ্যমতে সুদের শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ। নবিজি (সা.) বলেছেন, আজ রাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, দুব্যক্তি আমার কাছে এসে আমাকে এক পবিত্র ভূমিতে নিয়ে গেল। আমরা চলতে চলতে এক রক্তের নদীর কাছে পৌঁছলাম। নদীর মধ্যস্থলে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে এবং আরেক ব্যক্তি নদীর তীরে, তার সামনে পাথর পড়ে রয়েছে। নদীর মাঝখানে লোকটি যখন বের হয়ে আসতে চায়, তখন তীরের লোকটি তার মুখে পাথর খণ্ড নিক্ষেপ করে তাকে স্বস্থানে ফিরিয়ে দিচ্ছে। এভাবে যতবার সে বেরিয়ে আসতে চায়, ততবারই তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করছে আর সে স্বস্থানে ফিরে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ কে? সে বলল, যাকে আপনি (রক্তের) নদীতে দেখেছেন, সে হলো সুদখোর।’ (সহিহ বুখারি : ২০৮৫)।
এ জন্য সমাজে সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য আবশ্যক। বৃহৎ পরিসরে করজে হাসানা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে সুদের বিরুদ্ধে অবস্থান করতে হবে। এতে দারিদ্র্যরা যেমন এর সুফল ভোগ করতে পারবে, অনুরূপ ইসলামি অর্থনীতিরও প্রসার ঘটবে। এ ছাড়া ইসলামে এটাকে আর্থিক ইবাদতেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এসব কাজে লিপ্ত ব্যক্তির জন্য স্বয়ং আল্লাহতায়ালা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘দানশীল পুরুষ ও দানশীলা নারী এবং যারা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান করে তাদের দেওয়া হবে বহুগুণ বেশি এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার।’ (সূরা হাদিদ : ১৮)। উল্লেখ্য, তাফসিরকারদের মতে, বিপদগ্রস্ত ও অসহায়কে করজ (ঋণ) প্রদান করার মাধ্যমেই মূলত আল্লাহকে করজে হাসানা প্রদান করা হবে।
করজে হাসানার কিছু বৈশিষ্ট্য-ক. ঋণগ্রহীতার ওপর আলাদা করে ঋণের অতিরিক্ত প্রদানের শর্ত প্রদান করা যাবে না। সময়মতো সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হবে। খ. যে ব্যক্তি করজে হাসানা গ্রহণ করবে, তিনি সব ঝুঁকি বহন করবেন। গ. ঋণগ্রহীতা ঋণ ফেরতে অপারগ হলে, ঋণদাতা সেই ঋণ ক্ষমা করে দিতে পারেন কিংবা ঋণ প্রদানে অতিরিক্ত সময়ও প্রদান করতে পারবেন। তবে এ অতিরিক্ত সময়ের জন্য অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করা ইসলামে বৈধ নয়। ঘ. করজে হাসানা গ্রহীতা যেভাবে ইচ্ছা ঋণের অর্থ বা সম্পদ ব্যয় করতে পারবেন ।
এ ছাড়া সামাজিকভাবে করজে হাসানার তাৎপর্য অত্যধিক। কর্জে হাসানার মধ্যে বহু কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এটা দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গঠনের অন্যতম হাতিয়ার। কেননা, করজে হাসানায় শিক্ষা ঋণের মাধ্যমে অসহায় পরিবারের সন্তানেরা বেশি উপকৃত হবে। কৃষক কিংবা আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি এ ঋণের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজন মেটাতে ও সুদ থেকে মুক্ত থাকতে সক্ষম হবে। এর অন্যতম তাৎপর্য হচ্ছে, যারা এ কার্যক্রমে যুক্ত থাকে, তারা মূলত পরোপকারী মানসিকতা নিয়ে কাজ করে থাকেন। এতে দুনিয়াবি স্বার্থ জড়িত না থাকায় ধনী ও ক্ষমতাশীল কর্তৃক দারিদ্র্যের ওপর অর্থনৈতিক শোষণের কোনো সম্ভবনা নেই, যেমনটি প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় পরিলক্ষিত হয়। কেননা, করজে হাসানা হচ্ছে উত্তম ঋণ। এতে আর্থিকভাবে একজন দুর্বল ব্যবসায়ী যেমন ব্যবসায় সক্ষমতা লাভ করবেন, অনুরূপ সুদ থেকে নিজেকে হেফাজত করতে পারবেন। এমনকি করজে হাসানা প্রদানের ফলে প্রচুর নেকিও অর্জিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “এক ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করে দেখল, জান্নাতের দরজায় লেখা রয়েছে-‘দানের নেকি ১০ গুণ ও ঋণের (করজে হাসানা) নেকি ১৮ গুণ’।” (সিলসিলা সহিহা : ১৪৮১)।
তবে মনে রাখতে হবে, ঋণ গ্রহণ করলে অবশ্যই ওটা পরিশোধে চেষ্টা করতে হবে। কেননা, এটা হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। যা বান্দা ক্ষমা না করলে, আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। যেমন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মুমিন ব্যক্তির রুহ্ ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত তার ঋণের সঙ্গে বন্ধক থাকে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৪১৩)। অতএব, বর্তমান সুদমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে করজে হাসানার গুরুত্ব অপরিসীম।
Source: https://www.jugantor.com/todays-paper/features/islam-and-life/607644/%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AE%E0%A7%8B%E0%A6%9A%E0%A6%A8%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%9C%E0%A7%87-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BE