শান্তি মুক্তি ও ইসলাম
১. বিশ্বব্যাপী অশান্তি ও অশান্তির ধরণবিশ্বব্যাপী অশান্তি সৃষ্টি করেছে মানুষ। অশান্তি মানুষেরই সৃষ্টি। অশান্তি মানুষেরই কর্মফল। বর্তমান বিশ্বে বিরাজিত অশান্তির ধরণ ও রূপ বর্ণনা করে শেষ করা কঠিন। কয়েকটি বড় বড় অশান্তি নিম্নরূপ :
০১. মানুষের মানসিক অশান্তি, মানসিক যন্ত্রণা ও দাহ।
০২. ক্ষুধা, দারিদ্র, অভাব।
০৩. মারাত্মক রোগ ও মরণ ব্যাধির বিস্তার।
০৪. দাম্পত্য কলহ, বিরোধ, বিচ্ছেদ, বৈধব্য।
০৫.পারিবারিক বিশৃংখলা ও চরম অশান্তি।
০৬. চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, লুটতরাজ, জবরদখল।
০৭. ঘুষ, চাঁদাবাজি।
০৮. ধোকা, প্রতারণা, জালিয়াতি, ফাঁকিবাজি।
০৯. হিংসা বিদ্বেষ, ঝগড়া বিবাদ, হানাহানি, খুনাখুনি।
১০. যৌতুকের যাঁতাকল।
১১. নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, ব্যভিচার, যৌন হয়রানি এবং নারীর অধিকার হরণ।
১২. বেকারত্ব।
১৩. অবাধ্যতা, উশৃংখলা।
১৪. যুলুম, নির্যাতন, অন্যায়, অবিচার।
১৫. মিথ্যাবাদিতা, ওয়াদা খেলাফি, চুক্তিভঙ্গ।
১৬. দমন, নিপীড়ন, বিদ্রোহ।
১৭. আগ্রাসন, অবরোধ।
১৮. সন্ত্রাস।
১৯. যুদ্ধ।
২০. নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতা।
২১. মানবাধিকার পদদলন।
২২. বিপথগামিতা।
২৩. মাদকাসক্তি/নেশা।
২৪. সম্মান ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তাহীনতা।
২৫. জীবনের নিরাপত্তাহীনতা।
২৬. হত্যা, আত্মহত্যা, অন্তর্ঘাত, নারীর জীবনাহুতি।
২৭. সম্পদের নিরাপত্তাহীনতা।
২৮. খেয়ানত, অবিশ্বস্ততা, আত্মস্যাৎ।
২৯. মন্দা, উৎপাদন ঘাটতি, সম্পদের স্বল্পতা, টাকার প্রবাহ, দুস্প্রাপ্যতা।
৩০. পরিবেশ দূষণ।
৩১. অপচয় অপব্যবহার।
শুধু এগুলোই নয়, এর বাইরেও রয়েছে অশান্তির অসংখ্য ইন্ধন। আর আমাদের জানা অজানা, প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য,ছোট বড় এসব অশান্তির ইন্ধনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে স্রষ্টার সেরা সৃষ্টি মানুষের মনের শান্তি, ঘরের শান্তি,সামাজিক শান্তি, রাষ্ট্রীয় শান্তি এবং বিশ্বশান্তি। সব অশান্তির জন্যে দায়ী মানুষের কর্ম :
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُم بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ .অর্থ : স্থলভাগ ও জলভাগে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে মানুষের নিজেরই কৃতকর্মের দরূণ, যেনো তিনি তাদের কিছু কৃতকর্মের স্বাদ আস্বাদন করাতে পারেন। এর ফলে হয়তো তারা ফিরে আসবে। -সূরা ৩০ আর রূম : আয়াত ৪১।
২. সর্বব্যাপী অশান্তির কারণসমাজের সর্বনিু ইউনিট ব্যক্তি, আর সর্বোচ্চ ইউনিট এই বিশ্ব। ব্যক্তি থেকে নিয়ে গোটা বিশ্বব্যাপী জ্বলছে অশান্তির দাবানল। এতে নিরবে এবং সরবে দগ্ধ হচ্ছে প্রায় সবাই, সর্বত্র। দগ্ধ হচ্ছে নারী, দগ্ধ হচ্ছে পুরুষ, দগ্ধ হচ্ছে শিশু। অশান্তির দহন কতো রকম এবং কতো প্রকার তা আমরা বলে শেষ করতে পারবোনা। কিন্তু দহন যে গ্রাস করে চলেছে সবাইকে সে সত্য লুকাবার সাধ্য কার? কিন্তু কিসের কারণে এই সর্বব্যাপী অশান্তি? কারা জ্বালিয়েছে এ আগুন? কারা ঢালছে তাতে তেল ফুয়েল কাঠখড়ি?হ্যাঁ, বিশ্বগ্রাসী অশান্তির অনিবার্য কারণগুলো হলো :
১. মানুষের স্রষ্টা ও প্রভু মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি মানুষের অবিশ্বাস অস্বীকৃতি ও অবজ্ঞা।
২. আল্লাহদ্রোহীতা (আল্লাহর বিধানের প্রতি বিদ্রোহ)।
৩. আত্মার দাসত্ব (লাগামহীন কামনা বাসনা ও লালসার অনুগমন)।
৪. সীমালংঘন (Transgression)।
৫. অহংকার, দাম্ভিকতা ও আত্মম্ভরিতা।
৬. লোভ ও স্বার্থপরতা (ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা জাতীয় স্বার্থ)।
৭. নিষ্ঠুরতা, পাষন্ডতা, পাশবিকতা।
৮. অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা।
৯. পাপলিপ্সা, পাপাচার, অনাচার, কলুষতা।
যাবতীয় দুর্দশার প্রধান প্রধান কারণ হলো এগুলো। অবিশ্বাসী, অমান্যকারী, আল্লাহদ্রোহী, আত্মার দাস,সীমালংঘনকারী, দাম্ভিক, স্বার্থপর, নিষ্ঠুর, নির্লজ্জ, পাপাচারী নেতৃত্ব কর্তৃত্ব ও সমাজের কর্ণধারদের কারণেই পৃথিবীতে নেমে এসেছে আজ এতো অশান্তি, এতো গ্লানি, এতো দুঃখ-কষ্ট আর মানবতার প্রতি লাঞ্ছনা। এ প্রসঙ্গে দেখুন মহান আল্লাহর বাণী :
فَأَمَّا الَّذِينَ كَفَرُوا فَأُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَمَا لَهُم مِّن نَّاصِرِينَ .
অর্থ : যারা কুফুরি (অর্থাৎ তাদের স্রষ্টাকে অবিশ্বাস ও অমান্য) করবে, তাদের আমি পৃথিবীর ও পরকালের জীবনে কঠোর শাস্তি প্রদান করবো এবং তারা কোনো সাহায্যকারী পাবেনা। -সূরা ৩ আলে ইমরান : আয়াত ৫৬।
كُلُوا مِن طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَلَا تَطْغَوْا فِيهِ فَيَحِلَّ عَلَيْكُمْ غَضَبِي ۖ وَمَن يَحْلِلْ عَلَيْهِ غَضَبِي فَقَدْ هَوَىٰ .
অর্থ : তোমরা আমার প্রদত্ত পবিত্র জীবিকা থেকে আহার করো। পৃথিবীতে সীমালংঘণ করোনা। তা করলে তোমাদের উপর আমার গজব অবধারিত হয়ে যাবে। আর যাদের উপর আমার গজব অবধারিত হয় তারা ধ্বংস হয়ে যায়। -সূরা ২০ তোয়াহা : আয়াত ৮১।
أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَـٰهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنتَ تَكُونُ عَلَيْهِ وَكِيلًا .অর্থ : ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে তোমার রায় কি- যে তার কামনা বাসনাকে নিজের প্রভু বানিয়ে নিয়েছে-? তুমি কি তার পক্ষে ওকালতির দায়িত্ব নেবে? -সূরা ২৫ আল ফুরকান : আয়াত ৪৩।
إِنَّ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوا عَنْهَا لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ .
অর্থ : যারা আমার আয়াতকে অস্বীকার করে এবং সে সম্পর্কে অহংকার ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন করে, তাদের জন্যে আকাশের দুয়ার উন্মুক্ত করা হবেনা এবং তারা জান্নাতেও প্রবেশ করতে পারবেনা। -সূরা ৭ আল আ’রাফ : আয়াত ৪০।
إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَن تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ .
অর্থ : যারা বিশ্বাসীদের মধ্যে অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতা প্রসারে উদ্যোগী হয়, তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি পৃথিবীর জীবনে এবং পরকালেও। -সূরা ২৪ আন নূর : আয়াত ১৯।
مَّنَّاعٍ لِّلْخَيْرِ مُعْتَدٍ أَثِيمٍ – عُتُلٍّ بَعْدَ ذَٰلِكَ زَنِيمٍ.
অর্থ : (তার আনুগত্য করোনা) ……. যে কল্যাণের কাজে বাধাদানকারী, সীমালংঘনকারী, পাপিষ্ঠ, রূঢ়-নিষ্ঠুর,কুখ্যাত। -সূরা ৬৮ আল কলম : আয়াত ১২-১৩।
৩. শান্তির উৎস কোথায়?মানুষ শান্তিদাতা নয়, মানুষ শান্তি ও মুক্তির অন্বেষী। সুতরাং শান্তির অন্বেষীদের শান্তি চাইতে হবে শান্তি ও মুক্তি দাতার কাছে। যার কাছে শান্তি আছে এবং শান্তি লাভের ফর্মূলাও আছে।
কে তিনি- যার কাছে শান্তি আছে এবং যিনি মুক্তি দিতে পারেন? এর জবাব একটাই, আর তাহলো : যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং শান্তি ও মুক্তির অন্বেষী বানিয়েছেন। শান্তি কেবল তাঁরই কাছে আছে এবং কেবল তিনিই মানুষকে শান্তি ও মুক্তি দিতে পারেন। তাঁরই নাম আল্লাহ। শান্তির চাবিকাঠি তাঁরই মুষ্টিবদ্ধে। তিনিই শান্তির উৎস এবং তিনিই মুক্তিদাতা :
هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلَامُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ .
অর্থ : তিনিই আল্লাহ। তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ্ (ত্রাণকর্তা ও মুক্তিদাতা) নেই। তিনিই একমাত্র সম্রাট, পুত পবিত্র। তিনিই শান্তি। তিনিই প্রশান্তি ও নিরাপত্তাদাতা। তিনিই রক্ষক। তিনিই প্রবল পরাক্রমশীল মহিমান্বিত। -সূরা ৫৯ হাশর : আয়াত ২৩।
সুতরাং মানুষকে শান্তি চাইতে হবে শান্তির উৎস মহান আল্লাহর কাছে। আর শান্তি লাভের জন্য তিনি যে ফর্মূলা বা জীবন পদ্ধতি দিয়েছেন সেটার অনুসরণ ও অনুবর্তন করতে হবে। তবেই মানব জীবনে নেমে আসবে শান্তির ফল্গুধারা।
৪. শান্তি ও মুক্তি লাভের শর্তএমন কিছু মৌলিক শর্ত বা গুণাবলী রয়েছে, যেগুলো গ্রহণ করা বা অর্জন করা শান্তি ও মুক্তি লাভের প্রাথমিক শর্ত। এগুলো ছাড়া কিছুতেই শান্তি ও মুক্তি লাভের পথে অগ্রসর হওয়া যায় না। সেগুলো হলো :
১. মানুষের স্রষ্টা ও শান্তির মালিক মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা।
২. বিনীতভাবে এক আল্লাহর দাসত্ব করা এবং তাঁর বিধানের আনুগত্য ও অনুসরণ করা।
৩. আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার এবং তাঁর শাস্তির প্রচণ্ড ভয় পোষণ করা।
৪. আল্লাহর পুরস্কার তথা জান্নাত লাভের দুর্নিবার আকাংখা পোষণ করা।
৫. মানবীয় ভ্রাতৃত্ববোধ এবং মানবতার হিতাকাংখা ও কল্যাণ চেতনা।
৬. আত্মপূজা, আত্মার দাসত্ব, স্বার্থপরতা ও অবৈধ কামনা বাসনা থেকে মুক্ত পবিত্র দৃষ্টিভংগি।
৭. ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনের প্রাপ্তি নয়, পরকালের অনন্ত জীবনের মুক্তি আর সাফল্যই হবে জীবনবোধ ও জীবন চেতনার মূল চালিকা শক্তি।
এই শর্তগুলো প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন :
إِنَّ الْإِنسَانَ لَفِي خُسْرٍ – إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ .
অর্থ : নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তবে তারা নয়, যারা ঈমান আনে, আমলে সালেহ করে, সত্যের উপদেশ দেয় এবং ধৈর্যধারণের পরামর্শ দেয়। -সূরা ১০৩ আল আসর : আয়াত ২ ও ৩।
وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ .অর্থ : তোমার প্রভু নির্দেশ দিয়েছেন: তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারো দাসত্ব করো না। -সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ২৩।
تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِّنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا .অর্থ : ‘তুমি তাদের (নবীর সাথিদের) দেখতে পাচ্ছো, তারা আল্লাহর অনুগ্রহ এবং সন্তুষ্টি কামনায় অবনত আত্মসমর্পিত।’ -সূরা ৪৮ আল ফাতহ : আয়াত ২৯।
وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَىٰ – فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَىٰ.অর্থ : আর যে ব্যক্তি তার প্রভুর সম্মুখে জবাবদিহিতার জন্যে দাঁড়াবার ভয়ে ভীত থাকে আর নিজেকে বিরত রাখে আত্মার (কামনা বাসনার) দাসত্ব থেকে, জান্নাতই হবে তার আবাস। -সূরা ৭৯ আন নাযিয়াত : আয়াত ৪০-৪১।
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَىٰ وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا ۚ إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ .অর্থ : হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে। পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে করে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পারো। তবে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদা সম্পন্ন সে, যে তোমাদের মাঝে অধিক আল্লাভীরু। -সূরা ৪৯ আল হুজুরাত : আয়াত ১৩।
৫. ইসলামই শান্তি এবং শান্তির আহ্বায়কইসলাম শান্তির উৎস মহান আল্লাহর প্রদত্ত জীবন যাপন পদ্ধতি। মানুষের শান্তি ও কল্যাণের জন্যেই তিনি মানুষকে এই সুন্দর জীবন যাপন পদ্ধতি উপহার দিয়েছেন। আল্লাহই শান্তির উৎস। তিনি চান মানুষ শান্তিতে থাকুক। তাই তিনি মানুষকে শান্তির বিধান দিয়েছেন এবং মানুষকে শান্তির দিকে আহ্বান করেছেন:
وَاللَّهُ يَدْعُو إِلَىٰ دَارِ السَّلاَمِ وَيَهْدِي مَن يَشَاءُ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ .অর্থ : আল্লাহ আহ্বান করছেন শান্তির আবাসের দিকে। আর তিনি যাকে চান সরল সঠিক পথে পরিচালিত করেন। -সূরা ১০ ইউনুস : আয়াত ২৫।
শান্তির পথ প্রদর্শনের জন্যেই আল্লাহ তায়ালা রসূল পাঠিয়েছেন এবং তাঁর সাথে পাঠিয়েছেন শান্তির ম্যানুয়েল আল কুরআন :
قَدْ جَاءَكُم مِّنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُّبِينٌ – يَهْدِي بِهِ اللَّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلاَمِ .অর্থ : আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে একটি আলো এবং একটি উন্মুক্ত কিতাব। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুগমণ করে, আল্লাহ তাদেরকে এর সাহায্যে পরিচালিত করেন শান্তির পথে। -সূরা ৫ মায়িদা : আয়াত ১৫-১৬।
আল্লাহর দেয়া আলো এবং উন্মুক্ত কিতাব হলো আল্লাহর রসূল এবং আল্লাহর প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা। যারা আল্লাহর রসূলকে এবং তাঁর প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা বা জীবন যাপনের ম্যানুয়্যালকে অনুসরণ করবে, তাদের সমাজেই নেমে আসবে শান্তির ফল্গুধারা এবং তারাই আস্বাদন করবে মুক্তির স্বাদ :
وَالسَّلاَمُ عَلَىٰ مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَىٰঅর্থ : শান্তি লাভ করবে তারাই, যারা ‘আল হুদা’ (আল্লাহ প্রদত্ত জীবন পদ্ধতি) অনুসরণ করবে। -সূরা ২০ তোয়াহা, আয়াত : ৪৭।
ইসলামই শান্তি। ইসলামের একটি অর্থ শান্তি। শান্তিকে পুরোপুরি গ্রহণ না করলে এবং শান্তির মধ্যে পুরোপুরি প্রবেশ না করলে শান্তি লাভ করা যায় না। তাই মহান আল্লাহ পরিপূর্ণভাবে ইসলাম বা শান্তির মধ্যে প্রবেশ করার আহ্বান জানিয়েছেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةًঅর্থ : হে বিশ্বাসীরা! তোমরা পরিপূর্ণরূপে প্রবেশ করো ইসলামে (শান্তির মধ্যে)। -সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ২০৮।
ইসলাম তার শত্রু পক্ষ বা প্রতিপক্ষের সাথেও অশান্তি চায় না। সেজন্যেই প্রতিপক্ষ বিবাদ বা সংঘাত সৃষ্টি করতে চাইলে মুসলিমরা বলে থাকে: ‘আমরা শান্তি চাই’:
وَاِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلاَمًا.
অর্থ : অজ্ঞরা যখন তাদের সাথে বিবাদ বিসম্বাদে জড়াতে উদ্যত হয়, তখন তারা বলে: ‘আমরা শান্তি চাই।’-সূরা ২৫ আল ফুরকান,আয়াত : ৬৩।
রসূল সা. সালাত আদায়ের পর আল্লাহর কাছে শান্তি কামনা করতেন এ ভাষায়:
اَللّٰهُمَّ اَنْتَ السَّلاَمُ وَمِنْكَ السَّلاَمُঅর্থ : হে আল্লাহ তুমিই শান্তি এবং শান্তি তোমার পক্ষ থেকেই এসে থাকে।’
ইসলামের মহান শিক্ষা হলো একজন মানুষের সাথে আরেকজনের সাক্ষাত হলে তারা পরস্পরকে বলবে :
اَلسَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهঅর্থ : ‘আপনার/আপনাদের প্রতি শান্তি, আল্লাহর রহমত এবং তাঁর বরকত বর্ষিত হোক।’
খলিফা উমর রা. কে খেজুর গাছের তলায় গভীর প্রশান্তির ঘুমে দেখতে পেয়ে রোম সম্রাটের দূত বলে উঠেছিল :
يَا عُمَرُ! عَدَلْتَ فَنِمْتَঅর্থ : হে উমর! তুমি ইনসাফ করেছো, তাই ঘুমাচ্ছো প্রশান্তিতে।
৬. শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে কারা?অক্ষম ব্যক্তির শান্তিতে বসবাস করা আর ক্ষমতাবানের শান্তিতে বসবাস করা এক জিনিস নয়। রাস্তাঘাটে বৃদ্ধ ব্যক্তি কর্তৃক মেয়েদের উত্যক্ত না করা আর সুস্থ সবল যুবকের উত্যক্ত না করাটা এক কথা নয়।
বিশ্বব্যাপী অশান্তির জন্যে মূলত দায়ী ক্ষমতাবান সবল গোষ্ঠী। অপরদিকে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে কেবল সবলরাই। দুর্বলরা খুব একটা অশান্তিও সৃষ্টি করতে পারে না, শান্তিও প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। দুর্বলরা স্বভাবত শান্তিপ্রিয় এবং শান্তির পক্ষপাতী। তবে তারা সবল অশান্তি সৃষ্টিকারীদের জন্যেও নিরুপদ্রব সহায়ক।
আমরা আসলে বলতে চাইছি, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কেবল শান্তির উপায় উপাত্তের কথা আলোচনা করাই যথেষ্ট নয়; বরং এর জন্যে প্রয়োজন শান্তি প্রতিষ্ঠার দুর্নিবার আকাংখী একটি সবল শক্তিধর জনগোষ্ঠী। কারণ একটি সবল শক্তিধর জনগোষ্ঠীই কেবল বিশ্বকে ভাংতে এবং এতে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে। অন্যদিকে একটি সবল শক্তিধর জনগোষ্ঠীই কেবল বিশ্বকে গড়তে এবং এতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। মূলতঃ শক্তি এবং বলই সকল কাজে সাফল্যের চাবিকাঠি।
৭. শান্তি ও মুক্তির জন্যে চাই মৌলিক মানবীয় গুণাবলীযারাই মানুষের শান্তি ও মুক্তি নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে, তাদের মধ্যে অবশ্যি নিম্নোক্ত পনেরটি মৌলিক মানবীয় গুণ বা এর অধিকাংশ বর্তমান থাকতে হবে। এগুলো নিরপেক্ষ মানবীয় গুণাবলী। এগুলো ছাড়া অশান্তি সৃষ্টির কাজও করা যায় না, শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগও নেয়া যায় না। গুণগুলো হলো:
১. সুস্পষ্ট জীবন-লক্ষ্য ও জীবন-উদ্দেশ্য।
২. নির্দিষ্ট জীবন-পদ্ধতি (life style) অনুসরণ।
৩. দুর্দান্ত সাহস আর অপরিসীম বীরত্ব।
৪. প্রবল হৃদয়াবেগ, স্বপ্নসাধ, মনোবাসনা ও উচ্চাশা।
৫. দৃঢ়তা, অটলতা ও অবিচলতা।
৬. পরিশ্রম প্রিয়তা।
৭. সর্বোচ্চ ত্যাগের মানসিকতা।
৮. সতর্কতা, দূরদৃষ্টি ও অন্তরদৃষ্টি।
৯. উদ্ভাবনী ক্ষমতা।
১০. সিদ্ধান্তগ্রহণ শক্তি।
১১. পরিস্থিতির অনুকূল কর্মপন্থা গ্রহণের বিচক্ষণতা।
১২. প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা।
১৩. ঐক্য, সংহতি ও সংঘবদ্ধতা।
১৪. বলিষ্ঠ ও প্রভাব বিস্তারকারী নেতৃত্ব।
১৫. টীম স্পীরিট।
৮. শান্তি ও মুক্তি নিশ্চিত করার অনিবার্য গুণাবলীএমন কতিপয় মানবীয় গুণাবলী আছে, যেগুলো উপরে উল্লেখিত মৌলিক মানবীয় গুণাবলীকে কল্যাণমুখী করে দেয়ার জন্য অনিবার্য। উপরোক্ত গুণাবলীর সাথে যাদের মধ্যে নিম্নোক্ত কল্যাণমুখী মানবীয় গুণগুলো যুক্ত হবে,তারাই হবে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত মানবগোষ্ঠী। গুণগুলো হলো :
০১. সত্যবাদিতা ও সত্যপ্রিয়তা।
০২. বিশ্বস্ততা ও নির্ভরযোগ্যতা।
০৩. ন্যায়পরায়নতা, সুবিচার ও নিরপেক্ষতা।
০৪. মানবতাবোধ ও উদার প্রশস্ত হৃদয়- মন।
০৫. আত্মসম্মানবোধ।
০৬. দয়া, অনুগ্রহ, বদান্যতা ও সহানুভূতি।
০৭. প্রতিশ্রুতি পালন।
০৮. ভদ্রতা, শিষ্টাচার ও সৌজন্যপ্রিয়তা।
০৯. আত্মসংযম।
১০. নৈতিক চরিত্রের পবিত্রতা।
১১. নির্মল নিষ্কলুষ মন ও আদর্শপ্রিয়তা।
১২. নিঃস্বার্থপরতা।
১৩. সদিচ্ছা।
১৪. মঙ্গলাকাংখা ও কল্যাণকামিতা।
১৫. আত্মমূল্যায়ন।
বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের মধ্যে সামষ্টিকভাবে এসব মৌলিক এবং অনিবার্য মানবীয় গুণাবলীর প্রচণ্ড অভাব রয়েছে। সে কারণে মানবতার মুক্তি এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় মুসলিম উম্মাহ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। পক্ষান্তরে অন্যদের মধ্যে মৌলিক মানবীয় গুণাবলী বর্তমান থাকার সাথে সাথে অশান্তি সৃষ্টির কারণগুলো (২ নম্বর পয়েন্টে বর্ণিত) বিদ্যমান থাকায় বিশ্ববাসী আজ অশান্তির কারাগারে বন্দী।
তাই বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রয়োজন এমন একদল সুশৃঙ্খল নর শার্দূল যুবক যুবতীর, যাদের মধ্যে একদিকে থাকবে শান্তি প্রতিষ্ঠার শর্তাবলী পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান, অপরদিকে তারা হবে মৌলিক মানবীয় গুণাবলী এবং অনিবার্য সহায়ক গুণাবলীতে বলীয়ান। আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা এবং তাঁর আনুগত্য ও দাসত্বের চেতনায় মানব কল্যাণে তারা থাকবে সদা উজ্জীবিত :
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلاَةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ ۚ أُولَـٰئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ ۗ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ.
অর্থ : মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু। তারা উত্তম কাজের আদেশ করে, মন্দ কাজ নিষেধ করে,সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করে। এরাই ঐসব লোক, যাদের প্রতি আল্লাহ অচিরেই দয়া ও অনুকম্পা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রবল পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়। -সূরা ৯ আত তাওবা : আয়াত ৭১।
إِنَّ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْقَانِتِينَ وَالْقَانِتَاتِ وَالصَّادِقِينَ وَالصَّادِقَاتِ وَالصَّابِرِينَ وَالصَّابِرَاتِ وَالْخَاشِعِينَ وَالْخَاشِعَاتِ وَالْمُتَصَدِّقِينَ وَالْمُتَصَدِّقَاتِ وَالصَّائِمِينَ وَالصَّائِمَاتِ وَالْحَافِظِينَ فُرُوجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا.অর্থ : নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ, মুসলিম নারী, মুমিন পুরুষ, মুমিন নারী, অনুগত পুরুষ, অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ, সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ, ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ, বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ, দানশীল নারী,রোযা পালণকারী পুরুষ, রোযা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী নারী,আল্লাহর অধিক যিকরকারী পুরুষ ও যিকরকারী নারী, তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত করে রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরষ্কার। -সূরা ৩৩ আল আহযাব : আয়াত ৩৫।
Source: https://alquraneralo.wordpress.com/2012/04/26/%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%aa%e0%a6%a5-%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae-2/