সালাতে একাগ্রতা অর্জনের গুরুত্ব ও উপায়

Author Topic: সালাতে একাগ্রতা অর্জনের গুরুত্ব ও উপায়  (Read 60 times)

Offline Mrs.Anjuara Khanom

  • Sr. Member
  • ****
  • Posts: 478
  • Test
    • View Profile
ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হ’ল সালাত। সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণকে হৃদয়ে সঞ্চারিত রাখার প্রক্রিয়া হিসাবে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। আল্লাহ বলেন: ‘আর তুমি সালাত কায়েম কর আমাকে স্মরণ করার জন্য’।  [ত্বোয়া-হা ২০/১৪]

আর প্রতিটি কাজে সফলতার জন্য মৌলিক শর্ত হ’ল একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতা। আর এ বিষয়টি ছালাতের ক্ষেত্রে আরো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইবাদতের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদনের জন্য একাগ্রতার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, বর্তমানে এই ব্যস্ত যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে একাগ্রচিত্তে সালাত আদায় করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ একাগ্রতাবিহীন সালাত  শুধুমাত্র দায়সারা ও শারীরিক ব্যায়ামের উপকারিতা ব্যতীত তেমন কিছুই বয়ে আনে না। হৃদয়ে সৃষ্টি করে না প্রভুর একান্ত সান্নিধ্যে কিছু সময় অতিবাহিত করার অনাবিল প্রশান্তি। সঞ্চারিত হয় না নেকী অর্জনের পথে অগ্রগামী হওয়ার এবং যাবতীয় অশ্লীলতা ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার কোন অনুপ্রেরণা। সার্বিক অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে রাসূল (সা:)-এর নিম্নোক্ত হাদীছটি একটি কঠিন বাস্তবে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন: ‘এই উম্মত হ’তে সর্বপ্রথম ছালাতের একাগ্রতাকে উঠিয়ে নেয়া হবে, এমনকি তুমি তাদের মধ্যে কোন একাগ্রচিত্ত মুছল্লী খুঁজে পাবে না’।  [1]

একই বক্তব্য প্রতিধ্বনিত হয়েছে হুযায়ফা (রাঃ)-এর নিম্নোক্ত বাণীতে। তিনি বলেন: ‘সর্বপ্রথম তোমরা ছালাতে একাগ্রতা হারাবে। অবশেষে হারাবে সালাত। অধিকাংশ সালাত  আদায়কারীর মধ্যে কোন কল্যাণ অবশিষ্ট থাকবে না। হয়তো মসজিদে প্রবেশ করে একজন বিনয়ী-একাগ্রতা সম্পন্ন সালাত  আদায়কারীকেও পাওয়া যাবে না’।  [2]

বস্ত্ততঃ খুশূবিহীন সালাত বান্দাকে অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখে না। তাইতো আল্লাহ তা‘আলা একাগ্রচিত্তের অধিকারী মুছল্লীদেরকেই সফল মুমিন বলে আখ্যায়িত করেছেন। বক্ষমান প্রবন্ধে ছালাতে একাগ্রতার প্রয়োজনীয়তা, ফযীলত এবং একাগ্রতা সৃষ্টির কিছু উপায় সংক্ষেপে আলোচিত হ’ল।
খুশূ বা একাগ্রতার পরিচয়:

‘খুশূ’-এর আভিধানিক অর্থ হ’ল দীনতার সাথে অবনত হওয়া, ধীরস্থির হওয়া ইত্যাদি। ইবনু কাছীর বলেন: খুশূ অর্থ- স্থিরতা, ধীরতা, গাম্ভীর্য, বিনয় ও নম্রতা। [3]

ইবনুল ক্বাইয়িম বলেন: খুশূ হ’ল হৃদয়কে দীনতা ও বিনয়ের সাথে প্রতিপালকের সম্মুখে উপস্থাপন করা। [4]

প্রত্যেক ইবাদত কবুল হওয়া এবং তার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করার আবশ্যিক শর্ত হ’ল খুশূ। আর শ্রেষ্ঠ ইবাদত ছালাতের ক্ষেত্রে এর আবশ্যিকতা যে কত বেশী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন: ‘তোমরা আল্লাহর সম্মুখে দন্ডায়মান হও বিনীতভাবে’ [বাক্বারাহ ২/২৩৮]

তিনি আরো বলেন: ‘ঐ সকল মুমিন সফলকাম, যারা ছালাতে বিনয়াবনত’ [মুমিনূন ২৩/১-২]

খুশূ বা একাগ্রতার স্থান হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে। কিন্তু এর প্রভাব বিকশিত হয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। অন্যমনস্ক হওয়ার দরুন আত্মিক জগতে বিঘ্ন সৃষ্টি হ’লে বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও তার কুপ্রভাব পড়ে। তাই হৃদয় জগতকে একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতায় পরিপূর্ণ করতে সক্ষম হ’লেই ছালাতের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া সম্ভব। ছালাতের মধ্যে খুশূ কেবল তারই অর্জিত হবে, যে সবকিছু ত্যাগ করে নিজেকে শুধুমাত্র ছালাতের জন্য নিবিষ্ট করে নিবে এবং সবকিছুর ঊর্ধ্বে সালাতকে স্থান দিবে। তখনই সালাত তার অন্তরকে প্রশান্তিতে ভরে দিবে। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলতেন: ‘সালাতেই আমার চোখের প্রশান্তি রাখা হয়েছে’। [5]

আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে মনোনীত বান্দাদের আলোচনায় ‘খুশূ-খুযু’র সাথে সালাত আদায়কারী নারী-পুরুষের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাদের জন্য নির্ধারিত ক্ষমা ও সুমহান প্রতিদানের ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয় মুসলমান পুরুষ, মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ, ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ, অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ, সত্যবাদী নারী, ধৈর্য্যশীল পুরুষ, ধৈর্য্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ, বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ, দানশীল নারী, রোযা পালণকারী পুরুষ, রোযা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ, , যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী নারী, আল্লাহর অধিক যিকরকারী পুরুষ ও যিকরকারী নারী-তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরষ্কার“। [আহযাব ৩৩/৩৫]

‘খুশূ’ বান্দার উপর ছালাতের এই কঠিন দায়িত্বকে স্বাভাবিক ও প্রশান্তিময় করে তোলে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘তোমরা ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয়ই তা বিনয়ী-একনিষ্ঠ ব্যতীত অন্যদের উপর অতীব কষ্টকর’। [বাক্বারা ২/৪৫]

বস্ত্ততঃ যেকোন ইবাদতের ক্ষেত্রে যখন রাসূল (সা:)-এর নিম্নোক্ত বাণীর অনুসরণ করা হবে, তখনই তা এক সফল ইবাদতে পরিণত হবে। হৃদয়জগতকে অপার্থিব আলোয় উদ্ভাসিত করবে। তিনি বলেন: ‘আল্লাহর ইবাদত কর এমনভাবে, যেন তাঁকে তুমি দেখতে পাচ্ছ। আর যদি দেখতে না পাও, তবে তিনি যেন তোমাকে দেখছেন’।
একাগ্রতাপূর্ণ ছালাতের ফযীলত:

খুশূ-খুযূ পূর্ণ সালাত আদায়কারীর মর্যাদা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন: ‘আল্লাহ তা‘আলা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। অতএব যে ভাল করে ওযূ করবে, সময় মত সালাত  আদায় করবে এবং রুকূ-সিজদা সঠিকভাবে আদায় করবে, আল্লাহর দায়িত্ব তাকে ক্ষমা করে দেওয়া। আর যে এমনটি করবে না, তার প্রতি আল্লাহর কোন দায়িত্ব নেই। তিনি শাস্তিও দিতে পারেন, ক্ষমাও করতে পারেন’।  [7]

রাসূল (সা:) আরো বলেন: ‘যে সুন্দরভাবে ওযূ করে, অতঃপর মন ও শরীর একত্র করে (একাগ্রতার সাথে) দু’রাক‘আত সালাত আদায় করে, (অন্য বর্ণনায় এসেছে- যে ছালাতে ওয়াসওয়াসা স্থান পায় না) তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়। (অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়)’।  [8]
খুশূ ও একাগ্রতা অর্জনের উপায়:

ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের উপায়গুলি দু’ভাগে বিভক্ত-

(১) একাগ্রতা সৃষ্টি ও তা শক্তিশালীকরণের পদ্ধতি গ্রহণ করা।
(২) ‘খুশূ’তে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বিষয়গুলো পরিহার করা।

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন, দু’টি বস্ত্ত ‘খুশূ’র জন্য সহায়ক। প্রথমটি হ’ল– মুছল্লী যা বলবে: ‘যা করবে; তা অনুধাবন করবে। স্বীয় তেলাওয়াত ও দো‘আসমূহ গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করবে। সর্বদা হৃদয়ে জাগরূক রাখবে যে, সে আল্লাহর সম্মুখে প্রার্থনারত এবং তিনি তাকে দেখছেন। কেননা সালাতরত অবস্থায় মুছল্লী আল্লাহর সাথেই কথপোকথন করে। হাদীছে জিবরীলে ইহসানের সংজ্ঞায় এসেছে, ‘আল্লাহর ইবাদত কর এমনভাবে, যেন তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। যদি তুমি দেখতে না পাও, তবে তিনি তোমাকে দেখছেন’।  [9]

এভাবে মুছল্লী যতই ছালাতের স্বাদ আস্বাদন করবে, ততই ছালাতের প্রতি তার আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। এটা নির্ভর করে তার ঈমানী শক্তির উপর। আর তা বৃদ্ধি করার অনেক উপকরণ রয়েছে। রাসূল (সা:) বলতেন: ‘আমার জন্য প্রিয়তর করা হয়েছে নারীও সুগন্ধি। আর সালাতকে করা হয়েছে আমার চোখের প্রশান্তি’  [10]

অন্য হাদীছে এসেছে রাসূল (সা:) বেলাল (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলছেন: ‘হে বেলাল, ছালাতের এক্বামত দাও, আমাদেরকে প্রশান্তি দাও’।  [11]

দ্বিতীয়টি হ’ল– প্রতিবন্ধকতা দূর করা। অন্তরের একাগ্রতা বিনষ্টকারী বস্ত্ত ও অপ্রয়োজনীয় চিন্তা-ভাবনা পরিহার করা এবং ছালাতের মৌলিক উদ্দেশ্য ব্যাহতকারী সকল আকর্ষণীয় বস্ত্তকে পরিত্যাগ করা। [12]
একাগ্রতা সৃষ্টি ও শক্তিশালী করণের উপায়সমূহ:

(১) ছালাতের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ

ছালাতে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য প্রথমতঃ নিজেকে ছালাতের জন্য প্রস্ত্তত রাখতে হবে। যেমন মুওয়াযযিন আযান দিলে তার জওয়াব দেওয়া, আযান শেষে নির্দিষ্ট দো‘আ পড়া, অতঃপর বিসমিল্লাহ বলে সঠিকভাবে ওযূ করা, ওযূর পরে দো‘আ পড়া ইত্যাদি। মুখ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য মিসওয়াকের প্রতি যত্নশীল হওয়া আবশ্যক। রাসূল (সা:) বলেছেন: ‘বান্দা যখন ছালাতের জন্য দন্ডায়মান হয় এবং তেলাওয়াত করে, ফেরেশতা তার পিছনে দাঁড়িয়ে তেলাওয়াত শুনতে থাকে এবং শুনতে শুনতে তার নিকটবর্তী হয়। অবশেষে সে তার মুখকে বান্দার মুখের সাথে লাগিয়ে দেয়। ফলে সে যা কিছু তেলাওয়াত করে, তা ফেরেশতার মুখগহবরেই পতিত হয়। অতএব, ‘তোমরা (ছালাতে) কুরআন তেলাওয়াতের জন্য মুখকে পরিচ্ছন্ন কর’।  [13]

অতঃপর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুগন্ধিযুক্ত পোষাক পরিধান করে ছালাতের জন্য বের হবে। যা মুছল্লীর হৃদয়ে অনাবিল প্রশান্তি বয়ে আনে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘তোমরা ছালাতের সময় সুন্দর পোষাক পরিধান কর’। [আ‘রাফ ৭/৩১]

এছাড়া ছালাতের স্থানকে পবিত্র করা, ধীর-স্থিরভাবে মসজিদে গমন, পায়ে পা, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাতার সোজা করে দাঁড়ানো প্রভৃতি বিষয়গুলিও ছালাতে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য কার্যকর।

(২) ধীর-স্থিরতা অবলম্বন করা

“ছালাতে একাগ্রতা আনার জন্য ধীর-স্থিরতা অবলম্বন করা আবশ্যক। রাসূল (সা:) প্রত্যেক অঙ্গ নিজ নিজ স্থানে ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন।” [14]

“ছালাতে ভুলকারী ব্যক্তিকে তিনি ধীরে-সুস্থে সালাত আদায় করার শিক্ষা দিয়ে বলেন, ‘এভাবে আদায় না করলে তোমাদের কারো সালাত শুদ্ধ হবে না’।”  [15]

আবু ক্বাতাদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (সা:) বলেছেন: ‘নিকৃষ্টতম চোর হ’ল সেই ব্যক্তি, যে ছালাতে চুরি করে। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! ছালাতে কিভাবে চুরি করে?  তিনি বললেন, ‘যে রুকূ-সিজদা পূর্ণভাবে আদায় করে না’। [16]

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন: ‘যে ব্যক্তি পূর্ণভাবে রুকূ করে না এবং সিজদাতে শুধু ঠোকর দেয়, সে ঐ ক্ষুধার্ত ব্যক্তির ন্যায়, যে দু’তিনটি খেজুর খেল, কিন্তু পরিতৃপ্ত হ’ল না’। [17]

এছাড়া রাসূল (সা:) সংক্ষেপে সালাত আদায় করতে নিষেধ করেছেন। [18] সাথে সাথে তিনি দীর্ঘ সালাতকে সর্বোত্তম সালাত বলে আখ্যায়িত করেছেন। [19]

ধীর-স্থিরতা ব্যতীত একাগ্রতাপূর্ণ সফল সালাত আদায় করা অসম্ভব। কাকের ন্যায় ঠোকর দিয়ে আদায়কৃত ছালাতে একদিকে যেমন একাগ্রতা থাকে না, অন্যদিকে তেমনি নেকী অর্জনও সুদূর পরাহত হয়ে পড়ে।

(৩) ছালাতে মৃত্যুকে স্মরণ করা

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: ‘তুমি ছালাতে মৃত্যুকে স্মরণ কর। কারণ যে ব্যক্তি ছালাতে মৃত্যুকে স্মরণ করবে, তার সালাত যথার্থ সুন্দর হবে। আর তুমি সেই ব্যক্তির ন্যায় সালাত আদায় কর, যে জীবনে শেষবারের মত সালাত আদায় করে নিচ্ছে’। [20]

রাসূল (সা:)-এর নিকটে জনৈক ব্যক্তি সংক্ষিপ্ত উপদেশ কামনা করলে তিনি তাকে বললেন: ‘যখন তুমি ছালাতে দন্ডায়মান হবে, তখন এমনভাবে সালাত আদায় কর, যেন এটিই তোমার জীবনের শেষ সালাত’। [21]

মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু তার সময়-ক্ষণ অনিশ্চিত। তাই বান্দাকে তার প্রতিটি সালাতকেই ‘বিদায়ী সালাত’ হিসাবে আদায় করতে হবে। মনে করতে হবে যে, এটাই তার জীবনের শেষ সালাত; প্রভুর সাথে একান্ত আলাপের শেষ সুযোগ। সর্বদা এ চিন্তা অন্তরে জাগরূক রাখতে পারলে তার প্রতিটি সালাতই এক বিশেষ ছালাতে পরিণত হবে।

(৪) পঠিত আয়াত ও দো‘আ সমূহ গভীরভাবে অনুধাবন করা

ছালাতে পঠিত প্রতিটি আয়াত ও দো‘আ গভীর মনোযোগে অর্থ বুঝে পড়তে হবে এবং শুনতে হবে। বিশেষতঃ পঠিত দো‘আ সমূহের অর্থ একান্তভাবেই জানা আবশ্যক। কুরআনের আয়াত সমূহ শ্রবণে যেসব বান্দা প্রভাবিত হয়, তাদের প্রশংসা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘আর যারা তাদের রবের আয়াতসমূহ স্মরণ করিয়ে দিলে বধির ও অন্ধদের মত পড়ে থাকে না’ [ফুরক্বান ২৫/৭৩]

এতদ্ব্যতীত শিক্ষিত ব্যক্তিদের জন্য কুরআনের তাফসীর পাঠ করা উচিত। খ্যাতনামা মুফাসসির ইবনু জারীর ত্বাবারী বলেন: ‘আমি আশ্চর্যান্বিত হই সেই সব পাঠককে দেখে, যারা কুরআন পাঠ করে অথচ তার মর্ম জানে না। সে কিভাবে এর স্বাদ পাবে’? [22]

একটি আয়াত বার বার পাঠ করা এবং সে সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করাও ছালাতে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আবু যর গিফারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত: “রাসূল (সা:) একদিন তাহাজ্জুদ ছালাতে কেবলমাত্র ‘যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করেন তবে তারাতো আপনারই বান্দা, আর তাদেরকে যদি ক্ষমা করেন, তবে নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’’ (মায়েদাহ ৫/১১৮)। -এই আয়াতটি পড়তে পড়তেই রাত শেষ করেছিলেন। [23]

হুযায়ফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন: ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সাথে কোন এক রাতে সালাত পড়েছিলাম। লক্ষ্য করলাম, তিনি একটি একটি করে আয়াত পড়ছিলেন। যখন আল্লাহর প্রশংসামূলক কোন আয়াত আসত, আল্লাহর প্রশংসা করতেন। যখন প্রার্থনা করার আয়াত আসত, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন। যখন আশ্রয় চাওয়ার আয়াত আসত, আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইতেন’।  [24]

ছালাতে  আয়াত  সমূহ  অনুধাবন  করা  ও তার ফলাফলের বাস্তবতা জানার জন্য নিম্নোক্ত হাদীছটিও প্রণিধানযোগ্য।

আত্বা (রাঃ) বলেন, একদা আমি ও উবাইদ ইবনে ওমায়ের (রাঃ) আয়েশা (রাঃ)-এর নিকটে গমন করি। উবাইদ আয়েশাকে অনুরোধ করলেন, আপনি আমাদেরকে রাসূল (সা:)-এর একটি অতি আশ্চর্যজনক ঘটনা শুনান। আয়েশা (রাঃ) এ কথা শুনে কেঁদে ফেললেন। অতঃপর বললেন, এক রাতে উঠে রাসূল (সা:) আমাকে বললেন, আয়েশা তুমি আমাকে ছাড়, আমি প্রভুর ইবাদতে লিপ্ত হই। আমি বললাম, আল্লাহর কসম, আমি আপনার নৈকট্য যেমন পসন্দ করি এবং আপনার পসন্দের জিনিসও তেমনি পসন্দ করি। আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সা:) উঠে ওযূ করলেন এবং ছালাতে দাঁড়ালেন। অতঃপর কাঁদতে আরম্ভ করলেন। কাঁদতে কাঁদতে তার বক্ষ ভিজে গেল। এমনকি এক পর্যায়ে (পায়ের নীচের) মাটি পর্যন্ত ভিজে গেল। বেলাল তাঁকে (ফজরের) ছালাতের সংবাদ দিতে এসে দেখেন তিনি কাঁদছেন। বেলাল বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা:)! আপনি কাঁদছেন, অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বের ও পরবর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন? রাসূল (সা:) বললেন, হে বেলাল! আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? আজ রাতে আমার উপর কয়েকটি আয়াত …(আলে-ইমরান ১৯০-২০০) নাযিল হয়েছে। ‘যে ব্যক্তি এগুলো পড়বে, কিন্তু চিন্তা-ভাবনা করবে না, সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’। [25]

(৫) প্রতিটি আয়াত তেলাওয়াতের পর ওয়াকফ করা

এ পদ্ধতি একদিকে যেমন পঠিত আয়াত সম্পর্কে চিন্তা ও উপলব্ধি করতে সহায়ক হয়, অন্যদিকে তেমনি তা একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য অত্যন্ত কার্যকর। রাসূল (ছাঃ)-এর কুরআন তেলাওয়াতের ধরন ছিল এরূপ। তিনি প্রতিটি আয়াতের শেষে ওয়াকফ করতেন।[26]

(৬) মধুর স্বরে স্থিরতার সাথে তেলাওয়াত করা

আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কুরআন তেলাওয়াত কর’। [মুযযাম্মিল ৪]

রাসূলুল্লাহ (সা:) প্রতিটি সূরা তারতীল সহকারে তেলাওয়াত করতেন। [27]

মধুর স্বরে ধীরগতির পড়া খুশূ বা একাগ্রতা সৃষ্টিতে যেমন সহায়ক ভূমিকা পালন করে, তাড়াহুড়ার সাথে দ্রুতগতির পড়া তেমনি একাগ্রতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। রাসূল (সা:)-এর বলেন: ‘তোমরা সুমধুর স্বরে কুরআন তেলাওয়াত কর। কারণ সুন্দর আওয়াজ কুরআনের সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করে’। [28]

তবে এখানে সৌন্দর্যের অর্থ গভীর ভাবাবেগ এবং আল্লাহভীতি সহকারে সুন্দরভাবে তেলাওয়াত করা। যেমন রাসূল (সা:) অন্য হাদীছে বলেন: ‘সবচেয়ে সুন্দর আওয়াজে কুরআন তেলাওয়াতকারী ঐ ব্যক্তি, যার তেলাওয়াত শুনে তোমার মনে হবে যে, সে আল্লাহকে ভয় করছে’।  [29]

(৭) আল্লাহ বান্দার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন একথা স্মরণ করা

ছালাতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটাই মূলতঃ মহান প্রতিপালকের কাছে বান্দার একান্ত প্রার্থনা। তাই মুছল্লীকে সর্বদা মনে করতে হবে যে, আল্লাহ তার প্রতিটি প্রার্থনায় সাড়া দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে রাসূল (সা:)-এর নিম্নোক্ত হাদীছটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি সালাত কে আমার এবং আমার বান্দার মাঝে দু’ভাগে ভাগ করেছি। বান্দা আমার কাছে যা কামনা করবে তাই পাবে।
যখন আমার বান্দা বলে, (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি সারা জাহানের মালিক)।
তখন আল্লাহ বলেন, (বান্দা আমার প্রশংসা করল)।
যখন বলে, (পরম করুণাময় অসীম দয়াবান) আল্লাহ বলেন, (বান্দা আমার গুণগান করল)।
যখন বলে, (বিচার দিবসের মালিক) আল্লাহ বলেন, (বান্দা আমার যথাযথ মর্যাদা দান করল)।
যখন বলে, (আমরা কেবলমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং কেবলমাত্র আপনারই সাহায্য প্রার্থনা করি)।
আল্লাহ বলেন, (এটি আমার ও আমার বান্দার মাঝে, আর আমার বান্দা যা চাইবে, তাই পাবে)।
যখন বলে, (আপনি আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করুন। এমন ব্যক্তিদের পথ, যাদেরকে আপনি পুরস্কৃত করেছেন। তাদের পথ নয়, যারা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট হয়েছে)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, (এটা আমার বান্দার জন্য, আর আমার বান্দা যা প্রার্থনা করবে তাই পাবে)। [30]

রাসূল (সা:) অন্য হাদীছে বলেন: ‘তোমাদের কেউ ছালাতে দাঁড়ালে সে মূলতঃ তার প্রভুর সাথে কথোপকথন করে। তাই সে যেন দেখে, কিভাবে সে কথোপকথন করছে’। [31]

উপরোক্ত হাদীছ দু’টি স্মরণে থাকলে ছালাতে একাগ্রতা বজায় রাখা সহজ হয়ে যায়।

(৮) সিজদার স্থানেই দৃষ্টি নিবন্ধ রাখা

ছালাতে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য মুছল্লীকে দৃষ্টি অবনত রাখতে হবে এবং আশেপাশে দৃষ্টি দেওয়া যাবে না। রাসূল (সা:) ছালাতের সময় মস্তক অবনত রাখতেন এবং দৃষ্টি রাখতেন মাটির দিকে। [32]

আর যখন তাশাহহুদের জন্য বসবে, তখন শাহাদত আঙ্গুলের প্রতি দৃষ্টি রাখবে। রাসূল (সা:) যখন তাশাহহুদের জন্য বসতেন, শাহাদত আঙ্গুলের মাধ্যমে কিবলার দিকে ইশারা করতেন এবং সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতেন। [33]

(৯) ভিন্ন ভিন্ন সূরা ও দো‘আ সমূহ পাঠ করা

ছালাতে সবসময় একই সূরা ও একই দো‘আ না পড়ে, বিভিন্ন সূরা ও হাদীছে বর্ণিত বিভিন্ন দো‘আ পাঠ করলে, এর দ্বারা নতুন নতুন প্রার্থনা ও ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়। এজন্য মুছল্লীকে অধিক সংখ্যক দো‘আ এবং কুরআনের আয়াত মুখস্থ করা যরূরী।

(১০) আয়াতে তেলাওয়াতের সিজদা থাকলে সিজদা করা

সিজদায়ে তেলাওয়াত ছালাতে একদিকে যেমন একাগ্রতা বৃদ্ধি করে, অন্যদিকে শয়তানকে দূরে সরিয়ে দেয়। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (সা:) বলেন: “বনূ আদম যখন তেলাওয়াত শেষে সিজদা করে, শয়তান তখন কাঁদতে কাঁদতে দূরে সরে যায়। আর বলে, আফসোস! আদম সন্তান সিজদার নির্দেশ পেয়ে সিজদা করেছে- তার জন্য জান্নাত। আর আমি সিজদার নির্দেশ পেয়ে অমান্য করেছি- আমার জন্য জাহান্নাম“। [34]

(১১) শয়তান হ’তে আল্লাহর নিকট পানাহ চাওয়া

শয়তান মানুষের চিরশত্রু। যার প্রধান কাজই হ’ল ইবাদতে বান্দার একাগ্রতা নষ্ট করা এবং এতে সন্দেহ সৃষ্টি করা। একদিন ওছমান বিন আবুল ‘আছ (রাঃ) রাসূল (সা:)-কে বললেন: ‘হে আল্লাহর রাসূল! ‘শয়তান আমার এবং আমার সালাত  ও ক্বিরাআতের মাঝে প্রতিবন্ধকতা এবং ছালাতে সন্দেহ সৃষ্টি করে। রাসূল (ছাঃ) বললেন,  ‘এ শয়তানটিকে ‘খিনযাব’ বলা হয়। যখন তুমি এর প্ররোচনা বুঝতে পারবে, আল্লাহর কাছে পানাহ চাইবে এবং বাম দিকে তিনবার থুক মারবে। তিনি বলেন, আমি এমনটি করেছি, আল্লাহ তা‘আলা আমার থেকে শয়তানের ওয়াসওয়াসা দূর করে দিয়েছেন’। [35]

রাসূল (সা:) বলেন: ‘তোমাদের কেউ ছালাতে দাঁড়ালে শয়তান ভুল-ভ্রান্তি ও সন্দেহ সৃষ্টির জন্য নিকটবর্তী হয়, ফলে এক পর্যায়ে সে রাক‘আত সংখ্যা ভুলে যায়। কারো এমন হ’লে বসা অবস্থায় দু’টি সিজদা করে নিবে’। [36]

(১২) একাগ্রতার গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে জানা

রাসূল (সা:) বলেন: ‘যে ব্যক্তি ছালাতের সময় হ’লে সুন্দরভাবে ওযূ করে এবং একাগ্রতার সাথে সুন্দরভাবে রুকূ-সিজদা করে সালাত  আদায় করে, তার এ সালাত  পূর্বের সকল গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে কোন কবীরা গুনাহে লিপ্ত হয়। আর এ সুযোগ তার সারা জীবনের জন্য’। [37]

জানা আবশ্যক যে, একাগ্রতা ও খুশূর পরিমাণ অনুপাতে ছালাতে ছওয়াব অর্জিত হয়। রাসূল (সা:) বলেন: ‘মুছল্লী সালাত  আদায় করে, কেউ পায় দশভাগ নেকী, কেউ নয়ভাগ, আটভাগ, সাতভাগ, ছয়ভাগ, পাঁচভাগ, চারভাগ, তিনভাগ আবার কেউ অর্ধেক নেকী অর্জন করে’। [38]

(১৩) ছালাতের পরে বর্ণিত দো‘আসমূহ ও নফল সালাত গুলি আদায় করা

সালাত  পরবর্তী মাসনূন দো‘আ সমূহ পাঠ এবং সুন্নাতে রাতেবা সমূহ আদায় করলে ছালাতের মধ্যে যে একাগ্রতা, বরকত ও খুশূ অর্জিত হয়, পরর্তীতে তা বিদ্যমান থাকে। সেকারণ সম্পাদিত ইবাদতের কার্যকারিতা বজায় রাখার জন্য পরবর্তী ইবাদতগুলি অতীব গুরুত্ববহ। তাই ছালাতের পরে মুছল্লী মাসনূন দো‘আগুলি পাঠ করবে। অতঃপর সারাদিনে মোট ১২ অথবা ১০ রাক‘আত সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহসহ বেশী বেশী নফল সালাত  আদায় করার চেষ্টা করবে।  কারণ নফল সালাত  দ্বারা ফরযের ত্রুটি-বিচ্যুতি মোচন করা হয়। [39]

(১৪) বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করা

অধিক কুরআন তেলাওয়াত হৃদয় জগতে সদাসর্বদা দ্বীনি চেতনা জাগরূক রাখে। সাথে সাথে মনের গভীরে এক ধরনের এলাহী প্রশান্তির আবহ সৃষ্টি করে। যা ছালাতের একাগ্রতার জন্য একান্ত প্রয়োজন। তাই মুছল্লীকে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াতে অভ্যস্ত হ’তে হবে।

উপরোক্ত আলোচনায় একাগ্রতা সৃষ্টির উপায় সমূহ স্পষ্ট করা হয়েছে। এক্ষণে আমরা একাগ্রতা সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করব।

(১) ছালাতের স্থান হ’তে একাগ্রতায় বিঘ্ন সৃষ্টিকারী বস্ত্তসমূহ দূর করা

আয়েশা (রাঃ) অর্থাৎ কারুকার্য খচিত কিংবা রঙ্গিন এক জাতীয় পর্দার কাপড় দ্বারা ঘরের পার্শ্ব ঢেকে রেখেছিলেন। তা দেখে রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন: ‘এগুলো আমার নিকট থেকে সরাও। কারণ এর কারুকার্যগুলি আমার ছালাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে’। [40]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, একদিন রাসূল (সা:) কা‘বা গৃহে সালাত  আদায়ের জন্য প্রবেশ করলেন। অতঃপর সালাত  শেষে ওছমান বিন ত্বালহা (রাঃ)-কে বললেন: ‘আমি কা‘বা গৃহে প্রবেশ করার সময় দুম্বার দু’টি শিং দেখেছিলাম। কিন্তু তোমাকে শিং দু’টি ঢেকে দেওয়ার নির্দেশ দিতে ভুলে গিয়ে ছিলাম। অতএব তা ঢেকে দাও। কা‘বা গৃহে এমন বস্ত্ত থাকা উচিত নয়, যা মুছল্লীর একাগ্রতা বিনষ্ট করে’। [41]

তাই মুছল্লীর জন্য উচিত হবে, ছালাতের স্থান হ’তে একাগ্রতা বিনষ্টকারী সকল বস্ত্ত সরিয়ে ফেলা এবং মানুষের চলাচলের রাস্তা, গান-বাজনার স্থান ইত্যাদি পরিহার করা। সাথে সাথে সম্ভবপর প্রচন্ড গরম ও কনকনে শীতের স্থান এড়িয়ে সালাত  আদায় করা। কারণ গরম বা ঠান্ডার প্রচন্ডতা মুছল্লীর একাগ্রতাকে বিনষ্ট করতে পারে। প্রচন্ড গরমের কারণে রাসূল (ছাঃ) যোহর সালাত  একটু দেরী করে ঠান্ডায় পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। [42]

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন: প্রচন্ড গরম মুছল্লীকে একাগ্রতা ও খুশূ থেকে দূরে রাখে। ফলে সে অপ্রসন্ন ও অনীহভাব নিয়ে ইবাদত করে। এজন্যই রাসূল (ছাঃ) সালাত  দেরীতে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে গরম কমে যায় এবং মুছল্লী একাগ্রচিত্তে সালাত  আদায় করতে পারে। এতে মুছল্লীর জন্য ছালাতের প্রকৃত উদ্দেশ্য তথা খুশূ ও আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করা সম্ভব হয়। [43]

এছাড়া দৃষ্টি আকর্ষণকারী পোষাক পরিধান করা উচিত নয়, যা নিজের বা অন্য মুছল্লীদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। [44]

সাথে সাথে অধিক সৌন্দর্যমন্ডিত মসজিদও একাগ্রতা বিনষ্ট করে। তাই রাসূল (সা:) মসজিদকে সৌন্দর্যমন্ডিত করার ব্যাপারে সাবধান করেছেন।[45] ওমর (রাঃ) মসজিদে নববী নতুনভাবে নির্মাণ করার সময় তা সৌন্দর্যমন্ডিত করা থেকে নিষেধ করে বলেন, ‘তোমরা লাল-হলুদ রং করা থেকে বিরত থাক। কারণ এতে মুছল্লীগণকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেবে’।

ইবনু আববাস বলেন: অচিরেই তোমরা তোমাদের মসজিদগুলোকে এমনভাবে সৌন্দর্যমন্ডিত করবে, যেমনভাবে ইহুদী-নাছারারা করে থাকে। [46]

(২) যাবতীয় ছগীরা ও কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকা

ছালাতে একাগ্রতা আনার অন্যতম মাধ্যম ছগীরা ও কবীরা গুনাহ থেকে মুক্ত থাকা। পাপ মানুষের হৃদয়কে কলুষিত করে। এরূপ হৃদয়ে একাগ্রতা সৃষ্টি অলীক কল্পনা মাত্র। তাই একাগ্রতা অর্জনের জন্য ছোট-বড় সকল পাপ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। এভাবে ধীরে ধীরে একাগ্রতা অর্জন করতে সক্ষম হ’লে এক পর্যায়ে এই সালাত ই তাকে পাপ থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করবে। সূরা আনকাবূতের ৪৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সালাত  যাবতীয় অশ্লীলতা ও অন্যায় থেকে বিরত রাখে’।

(৩) খাবারের চাহিদা নিয়ে সালাত  না পড়া

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: ‘খাদ্যের উপস্থিতিতে কোন সালাত  নেই’। [47]

সুতরাং যখন খাবার প্রস্ত্তত হয়ে যায় এবং সামনে উপস্থিত করা হয়, তখন উচিত হবে আগে খাদ্য গ্রহণ করা। কারণ এমতাবস্থায় ছালাতে একাগ্রতা আসে না। রাসূল (সা:) বলেন: ‘যখন তোমাদের কারো সামনে রাতের খাবার উপস্থিত হয়। আর ছালাতেরও সময় হয়ে যায়, তখন আগে খাদ্য গ্রহণ কর। খাবার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাড়াহুড়া করো না’। [48]

(৪) প্রাকৃতিক কর্মের বেগ চেপে রেখে সালাত  না পড়া

প্রাকৃতিক প্রয়োজন অর্থাৎ পেশাব-পায়খানার বেগ থাকলে ছালাতে কখনোই একাগ্রতা আসে না। এজন্যই রাসূল (সা:) এরূপ অবস্থায় সালাত আদায় করতে নিষেধ করেছেন। [49]

যদি ছালাতের কিছু অংশ ছুটেও যায়, তবুও প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে নেওয়াই যরূরী। রাসূল (সা:) বলেন: ‘তোমাদের মধ্যে যদি কেউ টয়লেটে যেতে চায়, অথচ তখন ছালাতের সময় হয়ে গেছে, সে যেন আগে টয়লেট সেরে নেয়’। [50]

(৫) তন্দ্রাভাব নিয়ে সালাত  আদায় না করা

আনাস বিন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন: ‘তোমাদের কারো ছালাতের মধ্যে তন্দ্রাভাব আসলে সে যেন ঘুমিয়ে নেয়। যাতে সে (ছালাতে) যা পাঠ করে তা বুঝতে পারে’। [51]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা:) বলেন: ‘যখন তোমাদের কেউ সালাত রত অবস্থায় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, সে যেন ঘুমিয়ে নেয়। যতক্ষণ না তার ঘুম চলে যায়। কারণ ছালাতে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় হয়তো সে নিজের অজান্তে ক্ষমা প্রার্থনার সময় নিজেকে অভিসম্পাত করে বসবে’। [52]

এ অবস্থা সাধারণতঃ তাহাজ্জুদের ছালাতের ক্ষেত্রে হ’তে পারে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই ঘুমিয়ে নিতে হবে। তবে ফরয ছালাতের ক্ষেত্রে ওয়াক্ত যেন অতিক্রান্ত না হয়ে যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

(৬) আলাপরত বা ঘুমন্ত ব্যক্তির নিকটে সালাত  আদায় না করা

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন: ‘তোমরা কেউ ঘুমন্ত ব্যক্তি কিংবা আলাপচারিতায় রত ব্যক্তির পিছনে সালাত  আদায় করবে না’। [53]

কারণ আলাপরত ব্যক্তির কথোপকথন মুছল্লীর ছালাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। আর ঘুমন্ত ব্যক্তি হ’তে এমন কিছু প্রকাশ পেতে পারে, যার দ্বারা ছালাতের একাগ্রতা বিনষ্ট হবে।

(৭) সিজদার জায়গা হ’তে ধূলা-বালি সরাতে ব্যস্ত না হওয়া

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: ‘সালাত রত অবস্থায় সিজদার জায়গা মুছবে না। যদি একান্তই করতে হয় তবে কংকর সরাতে একবারই করতে পার’। [54]

এর দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল ছালাতের মধ্যে এমন একাগ্রতা বজায় রাখা, যাতে এর ভেতর অন্য কোন কাজ প্রাধান্য না পায়। তাই উচিত হবে ছালাতের পূর্বেই সিজদার স্থান পরিষ্কার করে নেওয়া।

(৮) উচ্চৈঃস্বরে তেলাওয়াত করে অন্যের ছালাতে ব্যাঘাত ঘটানো থেকে বিরত থাকা

মুছল্লীর স্বীয় ছালাতের প্রতি যেমন যত্নবান থাকা যরূরী, তেমনি অন্যের ছালাতে বিঘ্ন সৃষ্টি হ’তে পারে এমন কাজ থেকে বিরত থাকাও যরূরী। রাসূল (সা:) বলেন: ‘স্মরণ রেখ! তোমরা সকলেই (সালাত রত অবস্থায়) আল্লাহর সাথে কথোপকথন কর। অতএব কেউ কাউকে কষ্ট দিবে না। কেউ অপরের চেয়ে উঁচু আওয়াজেও ছালাতে তেলাওয়াত করবে না। [55]

অপর এক বর্ণনায় এসেছে, ‘একে অপরের চেয়ে উঁচু কণ্ঠে তেলাওয়াত করবে না’। [56]

(৯) সালাত রত অবস্থায় আশেপাশে দৃষ্টিপাত না করা

আবু যর গিফারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (সা:) বলেন: ‘বান্দা (সালাত রত অবস্থায়) যতক্ষণ পর্যন্ত আশেপাশে দৃষ্টিপাত না করে, আল্লাহ তার প্রতি মনোনিবেশ করে থাকেন। যখন আশেপাশে তাকায় তখন আল্লাহ দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন’। [57]

তিনি আরো বলেন: ‘সালাত  আদায়ের সময় তোমরা আশেপাশে দৃষ্টিপাত কর না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা ছালাতের সময় বান্দার মুখের দিকে স্বীয় দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখেন, যতক্ষণ না সে আশেপাশে দৃষ্টিপাত করে’। [58]

সালাত রত অবস্থায় এদিক-ওদিকে তাকানো সম্পর্কে রাসূল (সা:)-কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন: ‘এটা শয়তানের এমন এক লুটতরাজি, যার মাধ্যমে সে বান্দার ছালাতের নেকী লুট করে নেয়’। [59]

পরিশেষে বলা যায়, সালাত  ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ‘খুশূ-খুযূ’ ছালাতের প্রাণ। ‘খুশূ-খুযূ’ বিহীন সালাত  প্রাণহীন দেহের মত। আল্লাহর রহমতে আজকের সমাজে নিয়মিত সালাত  আদায়কারীর সংখ্যা খুব কম নয়, কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, ছালাতের প্রকৃত হক আদায় করে সালাত  আদায়কারীর সংখ্যা অতি অল্পই। সে কারণে ছালাতের মৌলিক উদ্দেশ্য যেমন আদায় হচ্ছে না, তেমনি ছালাতের বাস্তব ফলাফল আমাদের জীবনে সেভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। সুতরাং সালাত কে অর্থবহ ও মহান আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য করতে হ’লে এবং জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ছালাতের বাস্তব প্রভাব লাভ করতে হ’লে ‘খুশূ-খুযূ’সহ সালাত  আদায়ের বিকল্প নেই। আর এজন্য প্রয়োজন নিয়তের খুলূছিয়াত, আল্লাহভীতি, কঠোর অধ্যবসায়, সর্বোপরি আল্লাহর সাহায্য। আল্লাহ আমাদেরকে এসব বৈশিষ্ট্য অর্জনের তাওফীক দান করুন।

আমীন!


Source:https://quraneralo.net/importance-of-khushu-in-salah/
Mrs, Anjuara Khanom
Library Assistant Officer,
Daffodil International University
DSC Campus
02224441833/34