কর্মশক্তি কৌশল ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা
চলমান প্রযুক্তিগত বিপ্লব আমাদের অর্থনীতি, শিল্প, প্রশাসন ও কর্মজীবনে দ্রুত পরিবর্তন আনছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), রোবোটিকস, স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি একদিকে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে, অন্যদিকে অনেক প্রচলিত কাজের প্রয়োজনীয়তাও কমিয়ে দিচ্ছে। এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আন্তর্জাতিক অস্থিরতা শ্রমবাজারকে আরো জটিল করে তুলছে। তাই ভবিষ্যতে দরকার এমন দক্ষতা, যা শুধু প্রযুক্তি জানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে ধারণা, পাশাপাশি সৃজনশীলতা ও সমালোচনামূলক চিন্তার মতো মানবিক গুণও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতামূলক ও টেকসই রাখতে হলে এ পরিবর্তনগুলো আগেভাগে বুঝে কর্মশক্তি পরিকল্পনা নিতে হবে। নিয়োগকর্তা ও কর্মী দুই পক্ষকেই নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। সবচেয়ে জরুরি উচ্চ শিক্ষার সংস্কার, যাতে স্নাতকরা শুধু চাকরির যোগ্যতা নয়, বরং ভবিষ্যতের অর্থনীতির চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা ও মানসিকতা অর্জন করতে পারে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতাও ঝুঁকির মুখে পড়বে।
গত তিন দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মূলত তৈরি পোশাক, রেমিট্যান্স ও কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারে, যার মধ্যে ৮০ শতাংশেরও বেশি এসেছে পোশাক খাত থেকে। একটি মাত্র খাতের ওপর এত বেশি নির্ভরশীলতা নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে যখন বিশ্ব এরই মধ্যে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছে। তাই বাংলাদেশের জন্য এখন জরুরি নতুন খাত চিহ্নিত করা, যেখানে প্রযুক্তি, দক্ষতা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা অর্জন করা সম্ভব। ওষুধ শিল্প, তথ্য-প্রযুক্তি, কৃষি-প্রযুক্তি, ডিজিটাল সেবা এবং সবুজ উৎপাদন এসব খাত রফতানিকে বৈচিত্র্যময় করতে ও অর্থনীতিকে আরো স্থিতিশীল ভিত্তি দিতে পারে। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) এবং উদ্যোক্তা কার্যক্রমের নতুন পথ অনুসন্ধানও টেকসই সমাধান হতে পারে। সঠিকভাবে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের জন্য তৈরি পোশাকনির্ভর প্রবৃদ্ধির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে।
অন্যদিকে অনেক প্রচলিত কাজ ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে। তাই সৃজনশীলভাবে চিন্তা করা, দ্রুত অভিযোজিত হওয়া এবং নতুন দক্ষতা অর্জন অত্যন্ত জরুরি। ভবিষ্যতের কর্মজগৎ গড়ে উঠছে হাইব্রিড ওয়ার্ক, রিমোট জব, গিগ ইকোনমি ও উদ্যোক্তা বৃত্তির ওপর ভিত্তি করে। কর্মীদের তাই আরো নমনীয়, অভিযোজ্য ও স্বনির্ভর হতে হবে। পাশাপাশি চাকরি পরিবর্তন ও নতুন শিল্পে প্রবেশ করা সাধারণ ব্যাপার হয়ে উঠবে। এর মানে প্রতিটি ব্যক্তিকে সারাজীবন শেখা ও পুরনো ধারণা ভুলে নতুন দক্ষতা আয়ত্ত করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।
বিশেষভাবে গুরুত্ব পাওয়া ক্ষেত্র হলো সাইবার নিরাপত্তা। যত বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্লাউড কম্পিউটিং, ডিজিটাল লেনদেন ও রিমোট ওয়ার্কের মাধ্যমে অনলাইনে চলে যাচ্ছে, তত বেশি র্যানসমওয়্যার, ফিশিং, ডাটা চুরি এবং সাইবার হামলার ঝুঁকি বাড়ছে। প্রতিটি সংযুক্ত সিস্টেম নতুন দুর্বলতা তৈরি করছে। তাই সাইবার নিরাপত্তা ও নেটওয়ার্ক রক্ষা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন দক্ষতার একটি হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে। ভবিষ্যতের কর্মজগতে টিকে থাকতে পার্থক্য গড়ে দেবে—দৃঢ়তা, নমনীয়তা ও অভিযোজন ক্ষমতা, সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দক্ষতা, গুণগত মাননিয়ন্ত্রণ, প্রোগ্রামিং ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান। বাংলাদেশ যদিও এসব বিষয়ে পিছিয়ে আছে। এটা বড় সমস্যা নয়। বরং অগ্রণী দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে শেখার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরাসরি আধুনিক, সাশ্রয়ী ও সম্প্রসারণযোগ্য স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং সিস্টেমে প্রবেশ করতে পারে। সঠিক নীতি ও মানবসম্পদ বিনিয়োগ থাকলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাকের বাইরে রফতানি বৈচিত্র্য আনতে এবং বৈশ্বিক শিল্প ব্যবস্থায় নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশকে পুরনো ও ব্যয়বহুল স্বয়ংক্রিয়তা নয়, বরং আধুনিক ও নমনীয় স্মার্ট সমাধানের পথে এগোতে হবে। একই সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে এমন কর্মশক্তি, যারা সাংগঠনিক ও মানসিক দক্ষতা (বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা, সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধান, বহুভাষিকতা, পাঠ্য ও গাণিতিক জ্ঞান), প্রযুক্তিগত দক্ষতা (প্রযুক্তি সাক্ষরতা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও বিগ ডাটা, সাইবার নিরাপত্তা, প্রোগ্রামিং, ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা নকশা) এবং মানবিক দক্ষতা (দৃঢ়তা, অভিযোজন, নেতৃত্ব, সহমর্মিতা, জীবনব্যাপী শেখার মনোভাব, পরিবেশ-সচেতনতা ও বৈশ্বিক নাগরিকত্ব) অর্জন করবে। এ সমন্বিত দক্ষতা বাংলাদেশকে ভবিষ্যতের কর্মবাজারে প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে।
গত দুই দশকে ভিয়েতনাম, ভারত ও চীন শ্রমনির্ভর শিল্প থেকে উচ্চমূল্য সংযোজিত উৎপাদনের দিকে রূপান্তর করেছে। তাদের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশকে পথ দেখাতে পারে। ভিয়েতনাম দেখায় কীভাবে প্রযুক্তিনির্ভর প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণ করা যায়। ভারত শেখায় কীভাবে উদ্ভাবন ও দক্ষতাভিত্তিক ইকোসিস্টেম তৈরি করা যায়। চীনের অভিজ্ঞতা বলে দেয় কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি নীতি, গবেষণা ও উন্নয়ন এবং শিল্পকেন্দ্রিক গুচ্ছ তৈরি করে স্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব।
বাংলাদেশেও স্বয়ংক্রিয়তা, আইওটি রক্ষণাবেক্ষণ ও ডিজিটাল গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের মতো ক্ষেত্রে পুনঃদক্ষীকরণ ও দক্ষতা উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। শিল্প-বিশ্ববিদ্যালয় সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করলে তা কর্মশক্তিকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করবে।
বাংলাদেশের কর্মশক্তি কৌশল এগিয়ে নিতে তিনটি পদক্ষেপ জরুরি। প্রথমত, উচ্চ শিক্ষাকে শিল্পের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য করা। দ্বিতীয়ত, সারাজীবন শেখা ও পুনঃদক্ষীকরণের সুযোগ বাড়ানো। তৃতীয়ত, গবেষণা, উদ্ভাবন, সাইবার নিরাপত্তা ও ডিজিটাল অবকাঠামোয় নীতিগত বিনিয়োগ বাড়ানো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের পাঠ্যক্রম, শিক্ষণ পদ্ধতি ও শেখার প্রক্রিয়া আধুনিক করতে হবে, যাতে স্নাতকরা শুধু সনদ নয়, বরং ভবিষ্যতের চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারে।
এ পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি তৈরি পোশাক শিল্পের শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আরো বহুমুখী ও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। ফলে একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী জ্ঞানভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। পৃথিবী দ্রুত বদলাচ্ছে। টিকে থাকতে এবং সফল হতে হলে আমাদেরও বদলাতে হবে। শুধু বইয়ের পড়াশোনা নয়, প্রযুক্তি বোঝা, নতুন টুল ব্যবহার করা, সৃজনশীল হওয়া এবং নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতাই এখন সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি।
এমএম শহিদুল হাসান: ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও অধ্যাপক (অব.), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
Source:
https://bonikbarta.com/editorial/J6gXlsI4W3NYbKpJ