মনোভঙ্গি পরিবর্তনের প্রত্যাশা
চিন্তা থেকে যেহেতু কাজের উৎপত্তি সেহেতু কতিপয়ের নয়, সবার দেশগত ভালোবাসার ইতিবাচক মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনায় স্বচ্ছতার শক্তি ও প্রেরণার সংস্কৃতি গড়ে ওঠা নতুন বাংলাদেশে এখন সময়ের দাবি।
মনোভঙ্গি পরিবর্তনের প্রত্যাশা
সেই প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে গত বছর ৫ আগস্টের পট-পরিবর্তন এবং বিগত এক বছরে বাংলাদেশের জনগণের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক উত্থান-পতনের পথপরিক্রমা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সার্বিকভাবে সবার দৃষ্টিভঙ্গি বা মনোভঙ্গি (attitude) পরিবর্তনের প্রত্যাশাই সবার চিন্তা-চেতনার চৌহদ্দিতে, উপলব্ধির উপলব্ধিতে উঠে আসছে। চিন্তা থেকে যেহেতু কাজের উৎপত্তি সেহেতু কতিপয়ের নয়, সবার দেশগত ভালোবাসার ইতিবাচক মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনায় স্বচ্ছতার শক্তি ও প্রেরণার সংস্কৃতি গড়ে ওঠা নতুন বাংলাদেশে এখন সময়ের দাবি। যুগে যুগে মহামারী যেমন মানব মূূল্যবোধে ও আর্থসামাজিক ভাগ্যে ভোল পাল্টানোর, মনোভঙ্গি পরিবর্তনের সুযোগ এনে দিলেও তা যথাযথ কার্যকর না হওয়ায় গড়পড়তায় প্রতি ১০০ বছর পরপর মহামারী (১৭২০ সালে প্লেগ, ১৮২০ সালে কলেরা, ১৯২০ সালে ফ্লু এবং ২০২০ সালে কোভিড-করোনা) নতুন আকারে ও আঙ্গিকে বিশ্বজনতাকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে জাগাতে এসেছে। ২০২০ সালে করোনার অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল- ‘যুগ যুগ ধরে মানবতার অবমাননা, বৈষম্য, লোভ-লালসা, মিথ্যাবাদিতা ও অহমিকার যে পাপাচার বিশ্বকে গ্রাস করছিল তার সমুদয় দূর করতে গোটা বিশ্বময় একটি প্রবল ঝাঁকুনি দিতেই।’ করোনার কাছ থেকে আত্মশুদ্ধি ও অনুশোচনার শিক্ষা গ্রহণে শুধু দুই হাতকে নয়, বিবেককে বারবার ধৌত করার তাগিদ ছিল। অথচ করোনাকাল শেষ হওয়ার পরপরই বিগত বছরগুলোতে বিশ্ববাসী ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, ফিলিস্তিন-ইরান-ইসরাইল সংঘর্ষ, সুদান, তুরস্ক, জাপান, ইরান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে মানাবাধিকার আদায় ও প্রত্যাশা প্রত্যয়ে রক্তক্ষয়ী পট-পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করে চলেছে। তেমনি ১৫ বছর (১৯৭৫, ১৯৯০, ২০০৬, ২০০৯-২৪) পরপর বাংলাদেশের সব জনগণের কাছে বা মধ্যে মনোভঙ্গি পরিবর্তনের সুযোগগুলো সমুপস্থিত হয়েছে।
বিভেদ-বিভাজনের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগজাতিকে বিভক্তকরণে দীর্ঘদিনের একদেশদর্শিতা, একক ব্যক্তিবন্দনা, অসংখ্য গোয়ার্তুমি, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও ভুল (political blunder, mistakes etc), আত্মশ্লাঘা, অহংবোধ ও অপশক্তির অপব্যবহার ও স্বার্থ হাসিলের জন্য রাজনৈতিক উৎকোচ (political bribing) প্রথার অতি অপব্যবহারের দ্বারা সৃষ্ট নৈরাজ্য দূর করতে বিভেদ-বিভাজন, বিভ্রান্তি-বিচ্যুতির পরিবর্তে অন্তর্র্ভুক্তির চিন্তা ও চেতনায় জাগ্রত হওয়ার আহ্বান ছিল জুলাই বিপ্লবের মর্মবাণী। বৈষম্যবিহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে প্রথমেই ছিল পারস্পরিক দোষারোপের দ্বারা আমরাই যেন আর আমাদের শত্রু না হই। এক নতুন বাংলাদেশের পতাকাতলে সমবেত হয়েছিল সবাই।
ভূ-রাজনীতির কূটক্রীড়াকৌশলে দেশ অভ্যন্তরে বিভেদ-বিভাজন সৃষ্টির প্রয়াস দুরারোগ্য ব্যাধির মতো গেঁড়ে বসেছিল। দগদগে ঘা যেমন, তেমনি ৫৩ বছর বয়েসী বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তির শিরোনামে বিভক্ত করা হয়েছিল। সেই ভিত্তিতে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যেকার দেয়াল উধাও, দ্বিধাবিভক্ত প্রশাসন জনসেবা আইনের শাসন সবই। বাংলাদেশের জনপ্রশাসন দলীয়করণ গ্রেশাম সিনড্্েরামের কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত। পিএসসিতে সর্বোচ্চ পদে নিয়োগের সুপারিশ পেয়েও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রার্থী নিয়োগই পায়নি অদৃশ্য কারণে। মেধার অবমূল্যায়নের দ্বারা প্রকারান্তরে দেশ ও জাতিকে মেধাশূন্য করার, বৈষম্যের বিরোধী কণ্ঠরোধ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের এমন উদগ্র বাসনা ছিল ঘরে-বাইরের কারোর না কারো স্বার্থে। এই বিভেদ ও বিভাজনের, বৈষম্যের বেড়াজালে আটকানোর চেষ্টা চলে, রাজনীতি-দুর্বৃত্তায়ন-দলীয়করণের দ্বারা বিভেদ সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভ- বিচার বিভাগ, সংসদ বা আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে। এমনকি চতুর্থ স্তম্ভ মিডিয়ার মধ্যেও। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণের দ্বারা, রাষ্ট্রীয় চাকরিতে সরকারের ওএসডি কালচারের নামে প্রশাসনের মেধাবী ও করিৎকর্মাদের সরিয়ে হাজার হাজার কর্মকর্তাকে বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিয়ে পাবলিক মানির ক্ষতিসাধনসহ প্রশিক্ষিত মানবসম্পদকে অকর্মণ্য করে অপচয় এবং তদস্থলে দলীয় অদক্ষ প্রার্থীদের রাষ্ট্রীয় বড় বড় পদে নিয়োগের পাঁয়তারাটি ছিল দীর্ঘমেয়াদি ষড়যন্ত্রের স্বরূপ। চব্বিশের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত, অন্যের ভেদ বুদ্ধি, প্ররোচনা ও প্রযোজনায় নিজের নাক কেটে (নিজের ভবিষ্যৎ মানবসম্পদ ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ধ্বংস করে) হলেও বিভেদ-বিভাজন ও বৈষম্যের শিকার জনগণের কণ্ঠরোধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও কোণঠাসা এমনকি গুম (আয়নাঘরে আটকিয়ে) হত্যার তৎপরতাই ছিল একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনাকে দলীয় রাজনীতিকরণের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাঠঘাট পয়মাল করতেই এই বিভেদ-বিভাজন, বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয় বাংলাদেশের জনগণ।
সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি বিভেদ-বিভাজনের বেড়াজাল, যা সমতাভিত্তিক সমাজ ও সহজাত সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য ব্যবধান বেড়েছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য সর্বত্র, সিন্ডিকেট এত শক্তিশালী যে, তারা রাষ্ট্র ও সরকার সামলানোর ভূমিকাতে (এমনকি এখনো নেপথ্যে সক্রিয়) অবতীর্ণ। এর প্রতিকারার্থে জবাবদিহিতার পরিবেশে নাগরিকের সব মৌলিক অধিকার ও দাবি পূরণে রাষ্ট্রের স্বচ্ছতাসুলভ আচরণ ও সেবা প্রাপ্তি সুনিশ্চিত হলেই বিভেদ-বিভাজন, বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে মুক্তি মিলবে। নতুন বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি সবই এখন সবার। দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করে নয়- ছাত্র, শিক্ষক, বার কাউন্সিল, ট্রেড ইউনিয়ন, ব্যবসায়-বাণিজ্য সংগঠন, রাষ্ট্রীয় সংস্থা, পেশাজীবীদের সমিতির রাজনীতি যদি হয় বাংলাদেশপন্থী, তাহলেই মিলবে প্রকৃত মুক্তি।
বর্তমানের প্রতি মনোযোগবর্তমান হচ্ছে অতীতের আলোকে এই মুহূর্তের অবস্থান যা ভবিষ্যতের ভিত্তি নির্মাণ করে। বর্তমান মুহূর্তের মধ্যে অতীত হয়ে যায় এবং ভবিষ্যতের পথ নির্মাণ করে। বর্তমানের ভালো-মন্দ অতীতের বিচার্য বিষয় হয়ে যায় এবং ভবিষ্যৎ কেমন হবে তার একটি দিক-নির্দেশনা নির্ধারিত হয়ে যায়। বর্তমানকে বাদ দিয়ে তাই অতীত হয় না এবং ভবিষ্যৎ ভাবা যায় না। বর্তমানের প্রতি মনোযোগী না হলে বর্তমানের কর্মকাণ্ড বা ফলাফল ভবিষ্যতের ইতিহাসে অতীতের ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হবে। আর বর্তমানের অমনোযোগিতার খেসারত দিতে হবে ভবিষ্যতে। সে কারণে সবারই বর্তমানের ব্যাপারে মনোযোগী হওয়ার বিকল্প নেই। টলস্টয় যথার্থই বলেছেন-‘The most important time is Now’.
যার যার কাজে ফিরে যাওয়া, দায়িত্বশীল আচরণে নিষ্ঠাবান হওয়াবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত সরকারি চাকরিতে মেধার কোটা বাড়ানোকে কেন্দ্র করে। মেধার অবমূল্যায়ন ও তদস্থলে বিশেষ কোটার আওতায় নিয়োগের সুযোগ থাকায় চাকরি বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হতো মেধাবীদের। মানবিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টির কারণ ও উপলক্ষ এটিই। ’২৪-এর জুলাই আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচার পতনের পর্বটি সমাপ্ত হয়। এখন সেই বিজয়কে অর্থবহ করতে সবাইকে যার যার ক্ষেত্রে দায়িত্ব কর্তব্য পালনে অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে আপাতত আন্দোলনের দুই মাসের শিক্ষা ও আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা, যথা সচেতন ও সবেগে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থ খাতে অতীতের ক্ষরণ কাটিয়ে-মাড়িয়ে নিরাপদ ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথে ওঠা বা প্রাগ্রসরমান থাকা। বিপ্লবোত্তর এই সফল সময়ে হঠাৎ করে দীর্ঘদিনের অপ্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা চটজলদি পেতে চাওয়া, দাবি দাওয়া পেশের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় ও সামর্থ্যরে ওপর চড়াও হওয়া, সরকারকে সুস্থির থাকার পথে এ ব্যাপারে তাদের বিব্রত করা আদৌ দায়িত্বশীল আচরণের পর্যায়ে পড়বে না। পরিবহন ও যাতায়াতে বিঘ্ন ঘটিয়ে কিংবা রাষ্ট্রীয় সেবা বা সম্পদের ক্ষতিসাধন করে দাবি আদায়ের চেষ্টা রীতিমতো আত্মঘাতী। নিজেকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার কাজে পড়াশুনায় ফিরে না গিয়ে বিনা পরীক্ষায় পাস কিংবা পেশাদারিত্বে পারঙ্গমতা লাভে তাৎক্ষণিক প্রতিকার পেতে চাওয়ার মতো আত্মঘাতী প্রবণতা প্রতিরোধে সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে।
একসাথে পাঁচ ইঁদুর ধরতে চেষ্টা না করাএটি একটি জাপানি প্রবাদ। পাঁচ ইঁদুর একসাথে ধরতে চাইলে চালাক ইঁদুর ফসকে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্যায়-অনিয়ম, দুর্নীতি কিংবা বৈষম্য দূর কিংবা সর্বত্র সমতা বিধান তথা সংস্কার প্রণয়ন প্রচেষ্টার অনেকগুলো দাবি পূরণের কর্মসূচি একসাথে না নিয়ে যে কাজ এই মুহূর্তে সুচারুরূপে সম্পাদনের সামর্থ্য আছে সেটির প্রায়োরিটি ঠিক করা উচিত। অনেকগুলো কাজ একত্রে করার সক্ষমতা ও দক্ষতা না থাকলে কোনো কাজই সুচারুরূপে শেষ করা যায় না। ফলে একপর্যায়ে হতাশা চলে আসে, হতোদ্যম হয়ে পড়তে হয়। যে পরিমাণ খাবার খাওয়া এবং হজম করার শক্তি আছে প্লেটে তত পরিমাণ খাবার নেয়া উচিত।
প্রতিপক্ষ যেন জিতে না যায়, প্রতিবিপ্লব যেন মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারেসংস্কার, সংশোধন, প্রতিকার, প্রতিরোধ কাজে সবসময় প্রতিপক্ষের গতিপ্রকৃতি ও অস্তিত্বের ধারণা রাখতে হয়। শয়তান যেমন খোদাবিশ্বাসী বান্দাকে বিপথে নেয়ার সার্বক্ষণিক প্রয়াস প্রচেষ্টায় থাকে। তেমন দীর্ঘসময়ে অন্যায়-অনিয়মে নিয়োজিত কোনো শক্তিকে পরাস্ত, প্রতিরোধ করার কাজটিকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রতি ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের গতিবিধির দিকে, ষড়যন্ত্র পাকানোর দিকে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কড়া নজর রাখতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শোচনীয় পরাজয়ের পর জার্মানিকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথে প্রধান বাধা ছিল, ঘাপটি মেরে থাকা নিকট প্রতিপক্ষ, ভোল পাল্টানো সুযোগসন্ধানীরা, পরাশক্তি প্রথিত গুপ্তচর বা এজেন্ট।
যে লাউ সেই কদু যেন না হয়রাষ্ট্র মেরামতের অতি প্রয়োজনীয়তার তাগিদের মুখে যদি দেখা যায়, আগের অপশক্তি ভিন্ন নামে ভিন্ন কায়দায় একই অপকর্ম, অপচেষ্টা, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেটেড তৎপরতা, দখলদারিত্বের মনোভাব নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েও তৎপর, এমনকি ভাবিকালে ক্ষমতাধর হওয়ার আগেই নিজেদের মতো করে সব কিছু খবরদারি বা প্রত্যাবর্তনের ভূমিকায় নামে তাহলে দিনের শেষে দেখা যাবে, অবস্থার একই পরিণতি অর্থাৎ- যে লাউ সেই কদু পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে। তাতে মনে হবে, নতুন বোতলে পুরনো মদ ঢালা হয়েছে মাত্র। এটি পরিবর্তন প্রত্যাশাকে মারাত্মকভাবে বিভ্রান্ত করতে পারে। অতীতে ব্যক্তি বন্দনার, উন্নয়ন বয়ান এবং পাড়া-মহল্লায় ক্ষমতার কাছাকাছি দেন ‘পরিচিতি’ তুলে ধরার জন্য বড় মাঝারি ছোট বিলবোর্ড, ড্যাশবোর্ড, পোস্টারের ছড়াছড়ি ছিল। এসব মুদ্রণ ও প্রচারের খরচ চাঁদাবাজির মাধ্যমে মেটানো হতো, প্রতিপক্ষের বিলবোর্ড তো দূরের কথা- পুচকে পোস্টার পর্যন্ত প্রচারে বিরোধিতা ছিল। এখন আবার যদি পাড়ায়-মহল্লায় গলির মুখে নতুন সাজে নতুন করে পোস্টার, বোর্ড প্রদর্শনের মহড়া শুরু হয় তাতে ঘাড়ের ওপর নয়া দৈত্য ও অপশক্তির উদ্ভব ঘটবে। কেউ অধম ছিল বলে আমি কেন উত্তম হবো না, এ মূল্যবোধ ও চেতনা সবার মধ্যে জাগা আবশ্যক।
গৃহস্তকে সবসময় সজাগ থাকতেই হবেব্রিটিশ প্রবাদ ‘চোর তো চুরি করবেই গৃহস্থকে সজাগ থাকতে হবে’। অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি দুঃশাসন শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে নিজের প্রতিরক্ষা ব্যূহ যদি ভেঙে পড়ে খাঁটি বাংলা প্রবাদের মতো ‘বেড়ায় যদি ফসল খায়’ কিংবা ‘রক্ষক যদি ভক্ষক হয়’ তাহলে তার মতো দীর্ঘস্থায়ী দুর্যোগ আর হতে পারে না। এক্ষেত্রে গৃহস্থ অর্থাৎ জাতীয় স্বার্থ রক্ষাকারী সবারই অয়োময় প্রত্যয়ী হতে হবে যে, অন্যায়ের প্রশ্রয় কেউ পাবে না, প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত হবে দুর্নীতিবাজের, কর ফাঁকিবাজের, সিন্ডিকেটের, দলবাজির বিরুদ্ধে। সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে ভোটাধিকার প্রয়োগসহ সামাজিক আন্দোলনে সচেতন সক্রিয় ও সজাগ থাকলে সবার ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের বিপরীতে মহা দুর্নীতি প্রশ্রয়দানকারীও পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
আত্মসমালোচনার সুযোগ সৃষ্টিনিজের ভালো-মন্দ জ্ঞান সজাগ রাখতে হলে সবসময় নিজের দোষগুণ নিজেকে বুঝতে হবে। ঘরে-বাইরের ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় এবং স্বনির্ভর স্বদেশ গড়তে সব নাগরিককেই তার একক ও দলগত শক্তি (Strength), দুর্বলতা (weakness), সুযোগ (opportunity) এবং ঝুঁকি (threats) সম্পর্কে সজ্ঞান অনুধাবন করতে হবে ।
প্রবাসে নিউ ইয়র্কে অবস্থানরত ব্যান্ডশিল্পী বিপ্লব গত বছর বাঁধা তার একটি নতুন গানে যেমনটি চেয়েছিলেন, ‘দ্বিধাদ্বন্দ্ব, বৈষম্য, দলমত-নির্বিশেষে একটি সুন্দর বাংলাদেশ। আর কোনো রক্তপাত নয়, নয় কোনো হানাহানি। সবাই মিলে বাংলাদেশটিকে নিয়ে এগিয়ে নিতে চাই, আমাদের কাছে কোনো দল মুখ্য নয়। দেশটা যারা সুন্দরভাবে পরিচালিত করবে, তাদের সাথেই আছি। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার বিপ্লবে নতুন একটি বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি। নতুন এই বাংলাদেশে আমার যে চাওয়া, প্রত্যাশা তা-ই এই গানে তুলে ধরেছি। একজন শিল্পী হিসেবে এটুকুই আমি করতে পারি।’ সবারই যার যা অবস্থান থেকে যা করা উচিত বা সম্ভব সে মর্মে মনোভঙ্গির পরিবর্তন প্রত্যাশা সবার।
Source:
https://dailynayadiganta.com/printed-edition/f4i79kD3kWbd