নবীজির নিয়মিত অভ্যাস ‘কায়লুলা’র উপকারিতা
দুপুরের খাবারের পর আমাদের অনেক সময় ক্লান্তি ও আলস্য পায়, তখন অনেকে স্বল্প সময় বিশ্রাম নেন। এ বিশ্রামকে হাদিসের ভাষায় বলে কায়লুলা। বাংলায় ‘ভাতঘুম’ বললে এর কাছাকাছি অর্থ হয়।
কায়লুলা আমাদের দিনের পরবর্তী অংশকে প্রাণবন্ত ও সক্রিয় করে তোলে। বর্তমানে বিজ্ঞান কায়লুলার অনেক উপকারিতা উল্লেখ করছে। এটি নবীজি (সা.) ও সাহাবিগণের নিয়মিত অভ্যাস ছিল। তারা কখনও জোহরের নামাজের আগে আবার কখনও জুমার নামাজের পর কায়লুলা করতেন।
কায়লুলার উপকারিতা
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, দুপুর বেলায় স্বল্প সময়ের ঘুম মানুষের শরীর ও মনকে সতেজ করে, চিন্তা ও মনোযোগ পুনসঞ্চয় ঘটায় ও কাজের সক্রিয়তা বৃদ্ধি করে।
‘সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স’ জার্নালে ২০০২ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় গবেষকরা উল্লেখ করেন, দুপুরে ১০ থেকে ৪০ মিনিটের নিদ্রা শরীরকে যথেষ্ট বিশ্রাম দেয় এবং দিনের শুরুতে মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রমের ফলে রক্তে বেড়ে যাওয়া চাপ-হরমোনের (stress hormones) মাত্রা কমায়। এটা সর্বোচ্চ ৪০ মিনিট হলে তাতে রাতের ঘুমে কোনো প্রকার প্রভাব পড়ে না। কিন্তু এর চেয়ে বেশি হলে রাতে অনিদ্রা ও ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে।
‘কায়লুলা’ যেমন দিনের বাকি অংশের কর্মশক্তি বৃদ্ধি করে, তেমনি রাতের ইবাদতেও সহযোগিতা করে। শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করা সহজতর হয়। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা সাহরি খাওয়ার মাধ্যমে দিনের রোজার ব্যাপারে এবং দিনের বিশ্রামের মাধ্যমে রাতের নামাজের জন্য সাহায্য নেবে। (সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস: ১৬৯৩)
মুসলিম জীবনে কায়লুলা
কায়লুলা সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা গুরুত্বের দাবি রাখে। তবে মুসলিম জীবনে তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল এটি নবীজির সুন্নাহ। মুসলিমগণ নবীজির এই সুন্নাহ পালনের মাধ্যমের সওয়াব লাভের পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা লাভ করেন।
নবীজির সময়ে মুসলিমগণ গ্রীষ্মকালে জোহরের নামাজের আগে কায়লুলা করতেন। কায়লুলার পর জামাতের সঙ্গে জোহরের নামাজ পড়তেন। নবীজি (সা.) গ্রীষ্মকালে দেরিতে জোহরের নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
আমরা জুমার নামাজ আদায়ের পরেই দুপুরের খাবার খেতাম এবং বিশ্রাম করতাম।
সাহল ইবনে সাদ (রা.) , সুনানে ইবনে মাজা
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন গরমের তীব্রতা বেড়ে যায়, তখন তোমরা জোহরের নামাজ দেরীতে আদায় করবে। কেননা গরমের প্রখরতা জাহান্নামের উত্তাপ থেকে সৃষ্টি হয়। (সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস: ৬৭৮)
তবে তারা জুমার দিনে নামাজ পড়তেন আগে, দুপুরের খাবার গ্রহণ ও কায়লুলা করতেন জুমার নামাজের পর।
আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, আমরা প্রথম ওয়াক্তেই জুমার নামাজে যেতাম এবং জুমার পরে কায়লুলা করতাম। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮৫৯)
সাহল ইবনে সাদ (রা.) বলেন, আমরা জুমার নামাজ আদায়ের পরেই দুপুরের খাবার খেতাম এবং বিশ্রাম করতাম। (সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস: ১০৯৯)
নিয়মিত কায়লুলা করা সাহাবিদের দৈনন্দিন অভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারা কখনও ঘরে কায়লুলা করতে না পারলে মসজিদে কায়লুলা করতেন।
সাহল ইবনে সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি তাঁর কন্যা ফাতিমার ঘরে এলেন, কিন্তু হজরত আলীকে ঘরে পেলেন না। তিনি ফাতিমা (রা.)–কে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার চাচাতো ভাই (মানে আলী) কোথায়? তিনি বললেন, আমার ও তাঁর মধ্যে কিছু ঘটেছে। তিনি আমার সঙ্গে রাগ করে বাইরে চলে গেছেন। আমার কাছে দুপুরের বিশ্রামও করেন নি।
তারপর রাসুল (সা.) এক ব্যক্তিকে বললেন, দেখ তো সে কোথায়? সে ব্যক্তি খুঁজে এসে বলল, আল্লাহর রাসুল, তিনি মসজিদে শুয়ে আছেন। রাসুল (সা.) এলেন, তখন আলী (রা.) কাত হয়ে শুয়ে ছিলেন। তাঁর শরীরের এক পাশের চাদর পড়ে গিয়েছে এবং তাঁর শরীরে মাটি লেগেছে। রাসুল (সা.) তাঁর শরীরের মাটি ঝেড়ে দিতে দিতে বললেন, ওঠ, আবু তুরাব, ওঠ, আবু তুরাব। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪২৮)
‘তুরাব’ মানে মাটি। আলী (রা.)–এর গায়ে মাটি লেগে থাকায় আল্লাহর রাসুল তাকে ‘আবু তুরাব’ বলে সম্বোধন করছিলেন। এই হাদিস থেকে কায়লুলার প্রতি সাহাবিগণ কতটা গুরুত্ব প্রদান করতেন, তা সহজে অনুমান করা যায়।
নিয়মিত কায়লুলা করা সাহাবিদের দৈনন্দিন অভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারা কখনও ঘরে কায়লুলা করতে না পারলে মসজিদে কায়লুলা করতেন।
কায়লুলা নবীজির সুন্নাহ
আনাস (রা.)-এর খালা উম্মে হারাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসুল (সা.) আমাদের ঘরে এলেন এবং আমাদের এখানেই মধ্যাহ্ন বিশ্রাম করলেন। তারপর তিনি যখন জাগলেন তখন হাসছিলেন...। (সহিহ মুসলিম, হাদিস, ৪৭৮২)
এই হাদিস থেকে প্রমাণ হয়, কায়লুলা নবীজির সুন্নাহ, এটি ছিল তাঁর নিয়মিত অভ্যাস।
কায়লুলা যেমন আমাদের শরীর ও মনকে প্রফুল্ল ও সক্রিয় করে তোলে, তেমনি ইবাদতের প্রতি একাগ্রতা বৃদ্ধি করে। আলস্যহীন নামাজ, ক্লান্তিহীন দোয়া, মনোযোগী তেলাওয়াত আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম।
মুমিন জীবনে কায়লুলা কেবল শারীরিক ও মানসিক উপকারিতার উপায় নয়, বরং এটি নবীজির অনুকরণীয় গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ।
Source:
https://www.prothomalo.com/religion/islam/htsgxpooie