ইন্টারনেটে প্রতারনা আর আট দশটা প্রতারনার মতোই । শুধু পার্থক্য হলো, এক্ষেত্রে মাধ্যম (Tool) হিসেবে ব্যবহৃত হয় ইন্টারনেট । ইন্টারনেটে ভুল বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ব্যক্তিগত, আর্থিক বা সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করা বা প্রতারিত করাকে আমরা মোটা দাগে ইন্টারনেটে প্রতারনা হিসেবে দেখতে পারি । উদাহরণ স্বরূপ বল যায়, নাইজেরিয়ার সেই বিখ্যাত ফেক ইমেইল, যিনি কয়েক মিলিয়ন ডলার নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য দেশে সরানোর জন্য সাহায্য চেয়ে প্রথমে ই-মেইল পাঠান । কেউ তার ফাঁদে পা দিলে পরবর্তীতে সে ধাপে ধাপে তার কাছ থেকে টাকা নেয় । যতক্ষনে ভিকটিম বুঝতে পারে সে প্রতারিত ততো দিনে তার অনেক ক্ষতি হয়ে যায় ।
আরেকটা উদাহরন হতে পারে ইন্টারনেটে লটারী জেতা। এটাও একটা বিশাল প্রতারনা । এবিষয়ে বাংলাদেশে একটা নাটকও হয়েছিল। আমাদের দেশে অবশ্য এটার মোবাইল ভার্শন বেশ জনপ্রিয়, এক্ষেত্রে ভিকটিম মোবাইলে মেসেজ পান যে সে লাকি উইনার, সে একটা মোটর সাইকেল জিতেছেন। তবে তাকে কোন বিশেষ নম্বরে ১০০ বা ২০০ টাকা রিচার্জ করতে হবে । বাংলাদেশে অনেকেই এই ধরনের প্রতারনার শিকার হয়েছেন ।
কি কি ধরনের প্রতারণা হতে পারে ?
যে ধরনের প্রতারনার ঘটনা ঘটতে পারে তাকে আমরা মোটামোটি কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারি-
১. ব্যক্তিগত : এক্ষেত্রে ভিকটিমের ব্যক্তিগত ছবি বা মোবাইল নম্বর অথবা গোপনীয় কোন তথ্য ইন্টারনেটে প্রকাশ করে দেন । যার ফলে ভিকটিম ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হন, যেমন: মানসিক আঘাত।
২. আর্থিক ক্ষতি: এক্ষত্রে ভিকটিম অর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হন । যেমন : ভুয়া চাকরির বিজ্ঞাপন এবং চাকরিতে অবেদনের জন্য ২০০-৫০০ টাকার ড্রাফট দিতে বলা।
৩. সামাজিক ভাবমূর্তি: কোন লোকের কোন গোপনীয় তথ্য ইন্টারনেটে প্রকাশের কারনে সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া ।
৪. ই-মেইল অ্যাড্রেস স্প্যামারকে প্রদান : কোন সার্ভিস দেয়ার কথা বলে ই-মেইল অ্যাড্রেস নিয়ে পরবর্তীতে তা স্পামারদের কাছে বিক্রি করে দেয়া ।
৫. মানুষের সহানুভূতিকে পুঁজি করে উপার্জনের জন্য মিথ্যা অসুখ, অমানবিক নির্যাতনের কথা সাইবার স্পেসে উপস্থাপন ও এসংক্রান্ত জাল ও তৈরীকৃত প্রমাণ প্রদর্শন।
৬. কপিরাইট ছিনতাই: অন্যের ব্লগ পোস্ট/লেখা/মৌলিক অনলাইন কনটেন্ট যেমন অডিও, ভিডিও ও ফটো নিজের নামে চালানো এবং লেখকের নাম ও তথ্যসূত্র হিসাবে ওয়েবসাইটের লিংক প্রদান না করা।
বাংলাদেশে কি কি প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে ?
বাংলাদেশে মোটামটি ভাবে কম বেশি সবধরনের ইন্টারনেট প্রতারনার ঘটনাই ঘটেছে বা ঘটছে । তবে ইদানিং বিভিন্ন ফ্রিল্যাংসিং সাইটের নামে প্রতারনাই সবচেয়ে বেশি আলোচিত । বিভিন্ন ধরনের ওয়বে সাইট যেমন: ডুল্যান্সার, স্কাইল্যান্সার বা সাইটটক-এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন । তাছাড়া, ব্যক্তি পর্যায়ে বিশেষ করে মেয়েদের গোপনীর ছবি বা ভিডিও ওয়েবে প্রকাশ করা নিয়েও অনেক আলোচনা হচ্ছে । অনেক ছেলে ইন্টারনেটে বিশেষ করে ফেসবুকে মেয়ের নামে প্রোফাইল খুলে অনেককে প্রতারিত করছেন । আবার আনেক মেয়েও ইন্টারনেট ডেটিংয়ের নামে আনেক ছেলের কাছ থেকে টাকা পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এসব ক্ষেত্রে টাকা পয়সা মূলত মোবাইল রিচার্জের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে কি আছে?
২০০৬ বাংলাদেশ সরকার সাইবার আইন প্রনয়ন করে । এটি সাধারনত ’The Information and Communication Technology Act 2006′ নামে পরিচিত ।
ধারা ৫৪ তে বলা আছে-
জ) ইচ্ছাকৃতভাবে প্রেরক বা গ্রাহকের অনুমতি ব্যাতীত, কোন পণ্য বা সেবা বিপণনের উদ্দেশ্যে, স্পাম উৎপাদন বা বাজারজাত করেন বা করিবার চেষ্টা করেন বা অযাচিত ইলেক্ট্রনিক্স মেইল প্রেরণ করেন,
ঝ) কোন কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ বা কারসাজি করিয়া কোন ব্যাক্তির সেবা গ্রহণ বাবদ ধার্য চার্জ অন্যের হিসাবে জমা করেন বা করিবার চেষ্টা করেন,
তাহা হইলে উক্ত কার্য হইবে একটি অপরাধ।
(২) কোন ব্যাক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক দশ-বৎসর কারাদন্ডে, বা অনধিক দশ লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।
ধারা ৫৭ তে বলা আছে-
ইলেক্ট্রনিক কর্মে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানীকর প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও উহার দন্ড:- (১) কোন ব্যাক্তি যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্যকোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কোন প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট বিষয় বিবেচনায কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতি ভ্রষ্ট বা অসত কাজে উদ্ভুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন এর অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট ও ব্যাক্তির ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যাক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে বাধা প্রদান করা হয় তাহা হইলে তাহার এ কার্য হইবে একটি অপরাধ।
(২) কোন ব্যাক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে অনধিক দশ বছর কারাদন্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হইবেন।
ধারা ৬৩ তে বলা আছে,
গোপনীয়তা প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও উহার দন্ড:- (১) এই আইন বা আপাতত বলবত অন্যকোন আইনে ভিন্নরূপ কোন কিছু না থাকিলে, কোন ব্যাক্তি যদি এই আইন বা তদধীন প্রনীত বিধি প্রবিধানের কোন বিধানের অধীন কোন ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড, বই, রেজিস্টর, পত্র যোগাযোগ, তথ্য, দলিল বা অন্য কোন বিষয় বস্ততে প্রবেশাধীকার প্রাপ্ত হইয়া, সংশ্লিষ্ঠ ব্যাক্তির সম্মতি ব্যাতিরেকে কোন ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড, বই, রেজিস্টার, পত্র যোগাযোগ, তথ্য, দলিল বা অন্য কোন বিষয়বস্তু অন্য কোন ব্যাক্তির নিকট প্রকাশ করেন তাহা হইলে তাহার ঐ কার্য হইবে একটি অপরাধ।
(২) কোন উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক দুই বছর কারাদন্ডে বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।
ফ্রিল্যান্সিং নাকি প্রতারনা ?
এ বিষয়টি আলাদা ভাবে বলার উদ্দেশ্য হলো, ইদানিং ফ্রিল্যান্সিং আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে । তাছারা ফ্রিল্যান্সিং-এর মাধ্যমে বেকার বিশেষ করে তরুন সমাজ ব্যাপকভাবে উপক্রিত হচ্ছে । দেশেও প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করতে পারছে ।
কিন্তু কিছু অসাধু ব্যাক্তি, এই সুযোগে মানুষের অগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে অনেক টাকা পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে । বিশেষ করে এসব সাইটে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করার আগেই রেজিস্টেশনের নামে বড় অংকের টাকা নিয়ে নেয়া হচ্ছে এবং কমিশন প্রথার মাধ্যমে নতুন নতুন ক্রেতা ধরা হচ্ছে যার সাথে মূল ধারার ফ্রিল্যান্সিং কোন ভাবেই যায় না । এক্ষেত্রে আগ্রহী পাঠকরা এ বিষয়ে আমার আরেকটি লেখা পড়তে পারেন (Dolancer.com — সতর্ক হওয়ার এখনই সময়) ।
আমাদের কি করনীয় ?
১. প্রথমেই বলবো সতর্ক হতে। ইন্টারনেটের দুনিয়াতে একটি রুল অফ থাম্ব হলো, যা কিছু অবিশ্বাস্য মনে হবে তাকে প্রথমত অবিশ্বাস করা এবং ভালোভাবে যাচাই করে নেয়া । যেমন : কেউ ১০ লাখ টাকার লটারী জিতছে বলে ই-মেইল বা এসএমএস পেলে প্রথমেই সর্তক হতে হবে এবং যাচাই বাছাই করে নিতে হবে ।
২. কোন ওয়েব সাইটের চাক চমক দেখে বিভ্রান্ত না হওয়া । ওয়েব সাইটে দেয়া ফিজিক্যাল লোকেশনে খোঁজ নেয়া । কোন ল্যান্ডফোন থাকলে তাতে ফোন দিয়ে নিশ্চিত হওয়া ।
৩. ইন্টারনেটে ঐ সাইট বা ব্যক্তি সম্পর্কে রিভিউ পড়া বা কেউ কোন মন্তব্য করেছে কিনা তা দেখা । তবে এক্ষেত্রে আপনি যদি নিজে প্রতারিত হলে তা ইন্টারনেটে জাননো উচিৎ তাহলে অন্যরা প্রতারনার হাত থেকে বাঁচতে পারবে ।
৪. কোন পরিচিত বা অপরিচিত লোকের সাথে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় বা ছবি বা ভিডিও শেয়ার না করা । ইন্টারনেটে কোন কিছু একবার কিছু পোস্ট করার আগে কয়েকবার ভেবে নেয়া কারন ইন্টারনেটে কোন কিছু একবার প্রকাশ করে দিলে তা আর রোল ব্যাক করা সম্ভব হয় না ।
৫. বাসার ছোটদেরকে বিশেষ করে টিনেজারদেরকে ইন্টারনেটের বিভিন্ন থ্রেট সম্পর্কে জানানো উচিৎ তাদের বয়সের সাথে সামজস্যপূর্নভাবে ।
৬. সংশ্লিষ্ট আইনগুলোকে আরে হালনাগাদ করা বিশেষ করে আপরাধ প্রমানের বিষয়গুলো । সাথে সাথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাইবার ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্টা করাও জরুরী ।
৭. সাইবার থানা এবং জাতীয় সাইবার ক্রাইম সেল গঠন । যাতে ভিকটিম খুব সহজে আইনী সহয়তা পেতে পারে এবং এই ধরনের আপরাধ করলে আপরাধীকে ধরার টেকনিক্যাল সক্ষমতা থাকে ।
৮. বিভিন্ন ব্লগ ও ওয়েব সাইটের মডারেটর ও অ্যাডমিনদেরকে এবিষয়ে সতর্ক হতে হবে ।
উপসংহার
দিন দিন আমাদের নেট প্রেজেন্স বাড়ছে, সেইসাথে বাড়ছে বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনাও । তাই এ বিষয়ে সকলের বিশেষ করে সরকার, মিডিয়া এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানেগুলোর আরো বেশি নজর দেয়া উচিৎ। আর আমাদের সবার উচিৎ আরো বেশি সতর্ক হওয়া। ধন্যবাদ সবাইকে।