১১
আকাশে আজ কোন্ চরণের আসা-যাওয়া ।
বাতাসে আজ কোন্ পরশের লাগে হাওয়া ।।
অনেক দিনের বিদায়বেলার ব্যাকুল বাণী
আজ উদাসীর বাঁশির সুরে কে দেয় আনি–
বনের ছায়ায় তরুণ চোখের করুণ চাওয়া ।।
কোন্ ফাগুনে যে ফুল ফোটা হল সারা
মৌমাছিদের পাখায় পাখায় কাঁদে তারা ।
বকুলতলায় কাজ-ভোলা সেই কোন্ দুপুরে
যে-সব কথা ভাসিয়ে দিলেম গানের সুরে
ব্যথায় ভরে ফিরে আসে সে গান-গাওয়া ।।
১২
নিদ্রাহারা রাতের এ গান বাঁধব আমি কেমন সুরে ।
কোন্ রজনীগন্ধা হতে আনব সে তান কন্ঠে পূরে ।।
সুরের কাঙাল আমার ব্যথা ছায়ার কাঙাল রৌদ্র যথা
সাঁঝ-সকালে বনের পথে উদাস হয়ে বেড়ায় ঘুরে ।।
ওগো, সে কোন্ বিহান বেলায় এই পথে কার পায়ের তলে
নাম-না-জানা তৃণকুসুম শিউরেছিল শিশিরজলে ।
অলকে তার একটি গুছি করবীফুল রক্তরুচি,
নয়ন করে কী ফুল চয়ন নীল গগনে দূরে দূরে ।।
১৩
আমার কন্ঠ হতে গান কে নিল ভুলায়ে,
সে যে বাসা বাঁধে নীরব মনের কুলায়ে ।।
মেঘের দিনে শ্রাবণমাসে যূথীবনের দীর্ঘশ্বাসে
আমার প্রাণে সে দেয় পাখার ছায়া বুলায়ে ।।
যখন শরৎ কাঁপে শিউলিফুলের হরষে
নয়ন ভরে যে সেই গোপন গানের পরশে ।
গভীর রাতে কী সুর লাগায় আধো-ঘুমে আধো-জাগায়,
আমার স্বপন-মাঝে দেয় যে কী দোল দুলায়ে ।।
১৪
যায় নিয়ে যায় আমায় আপন গানের টানে
ঘর-ছাড়া কোন্ পথের পানে ।।
নিত্যকালের গোপন কথা বিশ্বপ্রাণের ব্যাকুলতা
আমার বাঁশি দেয় এনে দেয় আমার কানে ।।
মনে যে হয় আমার হৃদয় কুসুম হয়ে ফোটে,
আমার হিয়া উচ্ছলিয়া সাগরে ঢেউ ওঠে ।
পরান আমার বাঁধন হারায় নিশীথরাতের তারায় তারায়,
আকাশ আমায় কয় কী-যে কয় কেই বা জানে ।।
১৫
দিয়ে গেনু বসন্তের এই গানখানি–
বরষ ফুরায়ে যাবে, ভুলে যাবে জানি ।।
তবু তো ফাল্গুনরাতে এ গানের বেদনাতে
আঁখি তব ছলোছলো, এই বহু মানি ।।
চাহি না রহিতে বসে ফুরাইলে বেলা,
তখনি চলিয়া যাব শেষ হলে খেলা ।
আসিবে ফাল্গুন পুন, তখন আবার শুনো
নব পথিকেরই গানে নূতনের বাণী ।।
১৬
গান আমার যায় ভেসে যায়–
চাস্ নে ফিরে, দে তারে বিদায় ।।
সে যে দখিনহাওয়ায় মুকুল ঝরা, ধুলার আঁচল হেলায় ভরা,
সে যে শিশির-ফোঁটার মালা গাঁথা বনের আঙিনায় ।।
কাঁদন-হাসির আলোছায়া সারা অলস বেলা–
মেঘের গায়ে রঙের মায়া, খেলার পরে খেলা ।
ভুলে-যাওয়ার বোঝাই ভরি গেল চলে কতই তরী–
উজান বায়ে ফেরে যদি কে রয় সে আশায় ।।
১৭
সময় কারো যে নাই, ওরা চলে দলে দলে–
গান হায় ডুবে যায় কোন্ কোলাহলে ।।
পাষাণে রচিছে কত কীর্তি ওরা সবে বিপুল গরবে,
যায় আর বাঁশি-পানে চায় হাসিছলে ।।
বিশ্বের কাজের মাঝে জানি আমি জানি
তুমি শোন মোর গানখানি ।
আঁধার মথন করি যবে লও তুলি গ্রহতারাগুলি
শোন যে নীরবে তব নীলাম্বরতলে ।।
১৮
এই কথাটি মনে রেখো, তোমাদের এই হাসিখেলায়
আমি যে গান গেয়েছিলেম জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায় ।।
শুকনো ঘাসে শূন্য বনে আপন-মনে
অনাদরে অবহেলায়
আমি যে গান গেয়েছিলেম জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায় ।।
দিনের পথিক মনে রেখো, আমি চলেছিলেম রাতে
সন্ধ্যাপ্রদীপ নিয়ে হাতে ।
যখন আমায় ও পার থেকে গেল ডেকে ভেসেছিলেম ভাঙা ভেলায়
আমি যে গান গেয়েছিলেম জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায় ।।
১৯
আসা-যাওয়ার পথের ধারে গান গেয়ে মোর কেটেছে দিন ।
যাবার বেলায় দেব কারে বুকের কাছে বাজল যে বীণ ।।
সুরগুলি তার নানা ভাগে রেখে যাব পুষ্পরাগে,
মীড়গুলি তার মেঘের রেখায় স্বর্ণলেখায় করব বিলীন ।।
কিছু বা সে মিলনমালায় যুগলগলায় রইবে গাঁথা,
কিছু বা সে ভিজিয়ে দেবে দুই চাহনির চোখের পাতা ।
কিছু বা কোন্ চৈত্রমাসে বকুল-ঢাকা বনের ঘাসে
মনের কথার টুকরো আমার কুড়িয়ে পাবে কোন্ উদাসীন ।।
২০
গানের ভেলায় বেলা-অবেলায় প্রাণের আশা
ভোলা মনের স্রোতে ভাসা ।।
কোথায় জানি ধায় সে বাণী, দিনের শেষে
কোন্ ঘাটে যে ঠেকে এসে চিরকালের কাঁদা-হাসা ।।
এমনি খেলার ঢেউয়ের দোলে
খেলার পারে যাবি চলে ।
পালের হাওয়ার ভরসা তোমার–করিস নে ভয়
পথের কড়ি না যদি রয়, সঙ্গে আছে বাঁধন-নাশা ।।