স্তন ক্যান্সারঃ সচেতনতা ও প্রতিরোধবাংলাদেশে স্তন ক্যান্সার রোধে প্রয়োজন সচেতনতা সৃষ্টি ১৫ কোটি জনগনের এই দেশে স্তন ক্যান্সারের ব্যাপারে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। এ রোগ প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিকার কিভাবে হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। অতিসত্ত্বর এ রোগের ব্যাপক বিস্তার রোধ করতে শীঘ্রই পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাস গ্রহন করতে হবে। এ রোগ নিরোধে সচেতনতা সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ ব্যবস্থা মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
যে কোন ধরনের ক্যান্সারের ফলে দেহের কোষগুলো বাড়তে থাকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কোষগুলো দেহের ভেতর অরাজকতা সৃষ্টি করতে থাকে। একইভাবে স্তনে যখন এভাবে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি চলে, মানে ক্যান্সারের সূচনা ঘটে, তখন স্তন ক্যান্সারের সূচনা হয়। স্তনেরও রয়েছে তিনটি অংশ, গ্রন্থি, নালি ও সংযোজক কলা। বাংলাদেশের মহিলাদের যে সমস্ত ক্যান্সারগুলো বেশি হয়ে থাকে তার মধ্যে স্তন ক্যান্সার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি ৮জনের মধ্যে একজন বা শতকরা ১২.৬ ভাগ নারী এই রোগে আক্রান্ত হয়। সারাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২২ হাজার মহিলা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। তাদের মধ্যে ১৭ হাজার রোগী প্রতিবছর মারা যায়। এ রোগের ব্যাপকতার অন্যতম কারন হলো লজ্জার কারনে ডাক্তারের শরনাপন্ন না হওয়া। ‘আন্তর্জাতিক স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাস(অক্টেবর’০৯)’ উপলক্ষে মিরপুর আহসানিয়া মিশন ক্যন্সার ডিটেকশন সেন্টার এন্ড হসপিটালে আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা এ তথ্য দেন।
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণত শতকরা ৮০ভাগ স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকে পঞ্চাশোর্ধ মহিলারা। তবে কারো এক স্তনে ক্যান্সার দেখা দিলে তা ধীরে ধীরে অন্য স্তনেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। সব নারীরই কমবেশি ঝুঁকি রয়েছে স্তন ক্যান্সার হওয়ার। পুরুষের স্তন ক্যান্সার হয় কদাচিৎ। তবে এমন কিছু বিষয় আছে, যে জন্য কোনো কোনো নারীর স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বাড়ে। এর মধ্যে বয়স একটি। বয়স বাড়তে থাকলে ঝুঁকিও বাড়ে। নিঃসন্তান নারী বা দেরি করে প্রথম সন্তান নেয়া; খুব কম বয়সে প্রথম ঋতুস্রাব দেখা দেয়া; দেরিতে রজঃনিবৃত্তি হওয়া; ঘনিষ্ঠ স্বজন, যেমন মা, বোন বা কন্যা কারো স্তন ক্যান্সার হয়ে থাকলে পাশাপাশি অন্যদেরও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে যায়।
সূচনাকালে এত ছোট গুটির মতো থাকে যে লক্ষণ-উপসর্গ তেমন থাকেই না। পরে ধীরে ধীরে এটি বাড়তে থাকলে স্তনের চেহারায় ও অনুভবে আসে পরিবর্তন। যেমন:
*স্তনে নতুন একটি গুটির আবির্ভাব।
*সেই গুটিতে আসে পরিবর্তন।
*স্তনের আকার-আয়তনে আসে পরিবর্তন)।
*স্তন ও স্তনবোটায় ব্যথা হয়, সে ব্যথা উপশম হয় না।
*স্তনে যত্রতত্র লালবর্ণ হওয়া, ফুলে ওঠা, স্তন খসে পড়া।
*প্রচণ্ড ব্যথা হয় স্তনবোটায় এবং এটি ভেতর দিকে চুপসে যায়।
*শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় দুধ না বেরিয়ে কষ বর্ণের কোনো তরল নির্গমন।এ রকম উপসর্গের কোনো একটি দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। ক্যান্সার না হয়ে অন্য কারণেও এ রকম হতে পারে। তবে চেকআপ করে নেওয়া জরুরি।
সম্প্রতি আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা দেহের ওজনের দিকে নজর দিয়ে, নিয়মিত ব্যায়াম করে, সন্তানকে বুকের দুধ দিয়ে, মদ পান না করে স্তন ক্যান্সার ঝুঁকি অর্ধেকের নিচে নামিয়ে আনতে পারেন। ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের পরিচালক সুসান হিগিনবোথাম বলেন, ৮০০ গবেষণার ২০০৭ সালের পুনর্মূল্যায়ন এবং সেই সঙ্গে আরও ৮১টি নতুন গবেষণা যোগ করে এমন ফলাফল পাওয়া গেছে। হিগিনবোথাম ক্যান্সার সৃষ্টিতে পুষ্টি, আহার ও জীবনযাপনের প্রভাব নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন। যেমন, প্রতিরোধক পদক্ষেপ নারীরা গ্রহণ করতে পারেন। এর মধ্যে হলো শরীরের স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা, প্রতিদিন ৩০-৬০ মিনিট শরীরচর্চা করা, মা হলে শিশু সন্তানকে স্তনের দুধ দেওয়া। পরিবারের মা, বোন বা কন্যা কারো স্তন ক্যান্সার হয়ে থাকলে পাশাপাশি অন্যদেরও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে যায়। সেখানকার বিশেষজ্ঞদের মতে অল্প বয়সে রজস্রাব হলে বা অধিক বয়সে রজস্রাব হলে এবং যাদের কোন সন্তান সন্ততি নেই তাদের এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অত্যধিক।
তাই প্রতিদিন আমাদের জীবনাচরণে যেসব পরিবর্তন আনা উচিত সেদিকে খেয়াল করে এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস রপ্ত করে ক্যান্সার থেকে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব। Breast self-examination (BSE) ও প্রতিনিয়ত স্তন পরিক্ষার মাধ্যমে এই রোগের হাত থেকে বাঁচা সম্ভব। তাছাড়া লিফটে না চড়ে সিঁড়ি ভেঙে উঁচু দালানে উঠলে, গাড়িতে না চড়ে হাঁটলে অনেক সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব। হিগিনবোথাম আরও বলেন, সাধারণভাবে সব ক্যান্সারকেই প্রতিরোধ করতে হলে আমাদের খাবার এমন হতে পারে, যাতে থাকবে প্রচুর শাকসবজি ও ফল; শিম, বিচি, বরবটি, গোটাশস্য ইত্যাদি। লাল গোশত খুব কম খেতে হবে, না খাওয়া গেলে আরও ভালো। এই জীবনাচরণে অভ্যস্ত হলে সার্বিক স্বাস্থ্যও ভালো হবে। বর্তমানে ক্যান্সার প্রতিরোধে আধুনিক সব চিকিৎসা ইতোমধ্যে উন্নত বিশ্বে সহজলভ্য হয়ে গেছে। তবে নোভালিস রেডিওসার্জারি এক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। উন্নত বিশ্বে এই চিকিৎসা সুবিধা ছড়িয়ে পড়লেও এশিয়ার মাত্র দুটি দেশে এটি চালু হয়েছে।
সুখের বিষয়, সমপ্রতি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এই চিকিৎসা সুবিধা চালু হয়েছে। এই যন্ত্রটির দাম অনেক বেশি বলে শুধু দিল্লি ও মুম্বাই শহরেই এটি চালু হয়েছে।
সমপ্রতি দিল্লির বিখ্যাত ম্যাক্স হেলথ কেয়ার তাদের নতুন ক্যান্সার ইউনিট ম্যাক্স ক্যান্সার কেয়ারে নেভোলিস টিক্স সেবা চালু করেছে। কম সময়ে বেশি ফল পাওয়ার সুবিধা থাকায় চিকিৎসার খরচও কম। দিল্লির ম্যাক্স হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে বলে জানা গেছে।
http://amarhealth.com/