« on: July 12, 2015, 04:40:33 PM »
‘গেল গেল, দেশটা রসাতলে গেল’। ‘জামদানির প্যাটেন্ট ভারত নিয়ে গেছে’—খবরটি পড়ার পর আমিও এই কথাটি বলতে পারতাম। সেদিন সকালে খবরের কাগজ পড়ে যখন ভৌগোলিক নির্দেশক আইন সম্পর্কে জানতে পারলাম, তখন অন্য সবার মতো দেশটা নিয়ে আক্ষেপ করে আমিও বলতে পারতাম, এই দেশের কিচ্ছু হবে না। খবরের কাগজটি ছুড়ে ফেলে বিরক্তি ভরে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দেখতে পারতাম দেশটা ছেড়ে বিদেশে চলে যাওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু না।
এসব কিছুই ভাবিনি, বলিনি বা করিনি আমি; বরং ব্যাপারটা কী, তা জানতে বসে পড়ি ইন্টারনেটে। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, ভৌগোলিক নির্দেশক আইন একটি বিশেষ আইন, যার আওতায় একটি দেশ তার ঐতিহ্যবাহী প্রসিদ্ধ পণ্যগুলোর স্বত্ব নিশ্চিত করতে WTO-এর TRIPS চুক্তির আওতায় রেজিস্ট্রেশন নিয়ে থাকে। বাংলাদেশও আইনটি করার উদ্যোগ নিয়েছিল, খসড়া আইন হয়ে গেছে, তারপর কোনো কারণে সব স্থবির হয়ে আছে। আইনটি সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে শিল্প মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে রাখা ছিল জনমত যাচাইয়ের জন্য। কিন্তু এত দিন লাগবে কেন জনমত নিতে?
চলে গেলাম সরাসরি শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার (তৎকালীন) কাছে। সত্য কথা বলতে বাংলাদেশের মন্ত্রীদের সম্পর্কে খুব একটা ভালো ধারণা আমার ছিল না। সে রকমই না-বাচক মনোভাব নিয়ে কোনো ধরনের কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই তাঁর সাক্ষাৎ চেয়ে বসি। তিনিও দেখা করলেন। জানাই বিষয়টি নিয়ে আমাদের গভীর উদ্বেগের কথা। আসলে সেদিন কোত্থেকে এত সাহস পেয়েছিলাম আমি জানি না, তবে সাহসটি যে দেশের প্রতি টান থেকেই এসেছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আর তা না হলে আমার পড়াশোনার বিষয় না, অ্যাসাইনমেন্টও না, রিসার্চও না, শুধু শুধু কেন বিষয়টা নিয়ে এত উৎকণ্ঠা আমার? ব্যাপারটি তখন ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো বিষয়’।
যা-ই হোক, একজন মন্ত্রী যখন কনফেস করেই ফেলেন, তখন আর কিছুই বলার থাকে না। কিন্তু তার পরও চাপা একটি ক্ষোভ ছিল তাঁদের ওপর, যাঁরা বিষয়টির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সরকারকে দোষারোপ না করে কেন তাঁরা নিজেরা উদ্যোগ নিলেন না? কেন সাত বছরের বেশি সময় ধরে সরকারি টেবিলে ঘুরছিল আমার দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বিষয়ের আইনের খসড়াটি? দেশটি নিয়ে গর্ব করার মতো আছেই বা কী? এই ঐতিহ্যবাহী পণ্য বা সংস্কৃতিই তো। না? তাহলে এসব নিয়ে কেন আমাদের এত অবহেলা?
আমাদের সমস্যাটা কোথায় জানেন? এই দেশের কোনো কিছুকেই আমরা আমাদের করে ভাবতে পারি না, নিজের বাঁধা কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজকে আমার কাজ বলে মনে হয় না। আর এ কারণেই কোথায় যেন থমকে আছে দেশটি।
আমার উদ্দেশ্য ছিল শুধু জামদানি নয়, দেশের সব ঐতিহ্যবাহী ও প্রসিদ্ধ পণ্যগুলোর প্যাটেন্ট নিশ্চিত করা। কাজটা খুব একটা সহজ ছিল না। আমি প্রথমেই যা করলাম, তা হলো আমার বন্ধুদের উদ্বুদ্ধ করা। মজার ব্যাপার, আমার বন্ধুরা ছিল আমার মতোই পাগলাটে। হাসিব ভাই, মশিউর, তুহিন, ফারহানা, তৃষা, ফুজায়েল—সবাই একবাক্যে রাজি হয়ে গেল। আমার মনে আছে, মন্ত্রীর সঙ্গে যেদিন সাক্ষাৎ করি, সেদিন আমরা সবাই ক্লাস মিস করেছিলাম। আমার অন্য বন্ধুরা আবার বন্ধুত্বের পরিচয় দিতে গিয়ে সবার প্রক্সি দিয়ে দেয়। ধরাও খেয়ে যাই স্যারের হাতে। শাস্তি হিসেবে সবার ১০ নম্বর করে কেটে নেওয়া হয়। কিন্তু সেদিন কারও চোখেমুখে আমি সেই নম্বরের জন্য আফসোস দেখিনি। মন্ত্রীর সাক্ষাৎ পেয়েছি, কাজ এগোচ্ছে, এতেই তারা খুব খুশি! কী হবে এই নম্বর দিয়ে? খুব ভালো সিজিপিএ? ভালো একটা চাকরি? কিন্তু এখানে তো দেশের ব্যাপার। কোনো আপস না, কোনো ছাড় না।
মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর আমরা যখন তাঁকে বলি, জনসম্মুখে তাঁকে ব্যাপারটা খোলাসা করতে হবে, প্রমিজ করতে হবে যে খুব শিগগির আইনটি সংসদে পাস করানো হবে, তিনি একবাক্যে রাজি হয়ে গেলেন। এর পর থেকেই আসলে আমাদের কাজ শুরু হয়। মন্ত্রী নাহয় আইন পাস করাবেন, কিন্তু WTO-তে তো ডেটাবেইস উপস্থাপন করতে হবে, প্রমাণ করতে হবে জামদানিসহ এসব পণ্য একমাত্র বাংলাদেশেই বিখ্যাত। নেমে পড়ি তথ্যভান্ডার তৈরির কাজে। দেশের পরিস্থিতি তখন ভালো না। আমি ২০১৩ সালের মার্চ-এপ্রিলের কথা বলছি। পুরোদমে তখন হরতাল-অবরোধ চলছে। এত সব বাধা থাকা সত্ত্বেও আমাদের কাজ থেমে থাকেনি। সারা বাংলাদেশের সাতটি বিভাগ থেকে ৪০টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৭০টিরও বেশি পণ্যের তালিকা সংগ্রহ করি। পরিকল্পনা হলো, এই তথ্যভান্ডার আমরা শিল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেব, যাতে সংসদে আইনটি পাসের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ WTO-তে এসব পণ্যের বিস্তারিত পাঠিয়ে স্বত্ব দাবি করতে পারে।
এর মধ্যে প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার শিল্প মন্ত্রণালয়ে হানা দেওয়াও আমার রুটিন হয়ে গিয়েছিল। প্রথম প্রথম তাঁরা বিরক্ত হলেও একটা পর্যায়ে আমার এই হানা দেওয়ার প্রতি অভ্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁরা। ‘জামদানি আপা’ বা ‘জি-আই আপা’ বলে ডাকতেন অনেকে। তবে অনেকে এ কথাও বলতেন, ‘পড়ালেখা নাই তোমাদের?’ হেসে উত্তর না দিয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করতাম, আইন পাসের কাজ কত দূর এগোল?
অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ৬ নভেম্বর ২০১৩ সাল। সকালে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে ফোন এল। বলা হলো, ‘আজ আইনটি সংসদে উত্থাপন করা হবে, মন্ত্রী মহোদয় আপনাকে সংসদে থাকার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন’। আমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি কেন?’ বলা হলো, ‘আইনটি পাস হচ্ছে আপনার তোড়জোড়ে, আর আপনি থাকবেন না? নিজ চোখে দেখবেন না আপনার কাজের ফল?’
দৈনিক একটি পত্রিকায় আমার দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম, ‘আমার স্বপ্ন, আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চাই’। সেদিন সংসদে বসে, অনেকটা সেই স্বপ্নই বাস্তব হচ্ছে—এ রকম মনে হচ্ছিল। আমি আসলেই সেদিনের অনুভূতি বলে বা লিখে বোঝাতে পারব না। শুধু বলতে পারব, মাননীয় স্পিকার যখন তিনবার বললেন, ‘হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে, হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে, হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে,’ সঙ্গে সঙ্গে আমার গায়ের সব লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল এবং চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছিল। খুব শক্ত ধরনের মেয়ে আমি, এত সহজে কেঁদে ফেলব বুঝতে পারিনি। কিন্তু কীইবা করব? চোখের সামনে দেখছি ইতিহাস।
সেদিন প্রথম অদ্ভুত এক ভালো লাগা এবং আত্মবিশ্বাস আমার মনে জন্মেছিল। আমি আগে ভাবতাম, এই দেশে সাধারণ মানুষের বলার কোনো ভয়েস নেই, যতই গণতান্ত্রিক দেশ বলুক না কেন, আমরা জনগণেরা নয়, এই দেশের সরকার বা নেতারাই ঠিক করেন—কী হবে না হবে। কিন্তু সেদিন প্রথম আমি বিশ্বাস করি, আমি একটি গণতান্ত্রিক দেশে বাস করছি, যেখানে আমার বলার অধিকার আছে, আমার কথার মূল্য আছে। শুধু বিশ্বাস রাখতে হবে নিজের প্রতি এবং এই দেশটার প্রতি।
আইনটি পাস হয়েছে। আমার স্বপ্ন এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু না। এখনো আইনের বিধিমালার কাজ বাকি, তারপর চ্যালেঞ্জ করা বাকি। বাকি আরও অনেক কাজ। শুরু যেহেতু করেছি, শেষটাও দেখে ছাড়ব।
দেশটার জন্য আরও অনেক দেশপ্রেমিক যোগ্যতাসম্পন্ন কারিগর তৈরি করতে শিক্ষকতা পেশা বেছে নিয়ে বর্তমানে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেছি।
আমার স্বপ্ন এখানেও থেমে থাকবে না। দেশের অন্য অনেক সমস্যা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আমার। আর তাই নিজের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শুরু করেছি। কাজ আমি করবই। আমার সঙ্গে থাকবেন তো সবাই?
বিপাশা মতিন: শিক্ষক, জামদানি প্যাটেন্ট নিয়ে কাজ করছেন।
Logged
Sabiha Matin Bipasha
Senior Lecturer
Department of Business Administration
Faculty of Business & Economics
Daffodil International University