মানসিক প্রতিবন্ধী শিশু
আমাদের আশপাশে একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে অনেক পরিবারেই মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছে৷ মানসিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে পরিবারের চিন্তার শেষ নেই৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, গড় হিসাবে পৃথিবীর শতকরা যেকোন দেশের ৩ শতাংশ মানুষ মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী৷
মানসিক প্রতিবন্ধী কী?
মানসিক প্রতিবন্ধীত্বের অর্থ হলো, বয়স অনুপাতে শিশুটির যে বুদ্ধি থাকার কথা ছিল তা থাকে কম মাত্রায়৷ বুদ্ধি বা আইকিউর(IQ) পরিমাণ কতটুকু কম তার ওপর ভিত্তি করে প্রতিবন্ধিত্বকে মৃদু, মাঝারি ও তীব্র এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়৷
মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর লক্ষণ:
*
জণ্মের পর থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের হামাগুড়ি দিয়ে হঁাটা, বসতে শেখা, দঁাত ওঠা, কথা বলা ইত্যাদি কিছুটা দেরিতে শুরু হয়৷ একটু বয়স হয়ে গেলেও তারা নিজেদের পোশাক নিজেরা পড়তে পারে না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পারে না, আকস্মিক বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না৷ কখনো কখনো আগুন শব্দ বলতে পারে না, পানি শব্দ বলতে পারে না, একটু দূরে ছেড়ে দিলে বাড়িতে একা একা ফিরে আসতে পারে না, রাস্তাঘাটে ঠিকঠাকমতো চলাচল করতে পারে না৷
*
মানসিক প্রতিবন্ধীদের মানসিক গঠন, মস্তিষ্কের গড়ন, মস্তিষ্ক বা ব্রেনের কাজ ইত্যাদি ধীর গতিতে হয়৷ অন্য সাধারণ দশটি শিশু থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের কথাবর্তা, চলাফেরা, শারীরিক গঠন, আচার-আচরণ ও ব্যবহার দ্বারা সহজেই পৃথক করা যায়৷
*
মানসিক প্রতিবন্ধী অল্প থেকে মাঝারি বা তীব্র মাত্রায় হতে পারে৷
মানসিক প্রতিবন্ধীত্বের কারণগুলো হলো -
সংক্রমণ -
শিশুর শৈশবকালীন বয়সে যে সংক্রমণ হয় তা যদি শশুর ওপর ভয়াবহ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে তবে তা শিশুকে মানসিক প্রতিবন্ধী করে ফেলতে পারে৷ সংক্রমণের মধ্যে রয়েছে নানা ধরণের সংক্রমণ৷ যেমন -
মেনিনজাইটিস:
মানবমস্তিষ্কে এবং স্পাইনাল কর্ড বা সুষুম্নাকাণ্ডকে ঘিরে এক ধরণের আবরণী পর্দা রয়েছে, একে বলা হয় মেনিনজেস৷ ব্যাকটেরিয়াল, ভাইরাল এবং প্রোটোজোয়াজনিত সংক্রমণের কারণে মানবমস্তিষ্কের সেই পর্দা আক্রান্ত হতে পারে৷ এভাবে মানবমস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে গেলে শিশু মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যেতে পারে৷
অপুষ্টি:
আমাদের দেশের অধিকাংশ লোকই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে থাকে৷ পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টি, যা মস্তিষ্ক বা নার্ভাস সিস্টেম গঠন করার জন্য এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন, তা থেকে এক বিশাল জনগোষ্ঠী বঞ্চিত৷ সে হিসেবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আমিষ, শর্করা ও স্নেহজাতীয় খাবারের স্বল্পতার জন্য অল্প বয়সে অনেক শিশুই মানসিক প্রতিবন্ধীত্বের শিকার হয়ে থাকে৷
বংশগত কারণে:
বংশগত বা জেনেটিক কারণেও ব্যক্তির মাঝে মানসিক প্রতিবন্ধীত্ব দেখা দিয়ে থাকে৷ এগুলো হলো-উইলসন্স ডিজিজ,ক্রমোজোমাল ডিজঅর্ডার, যেমন- ডাউন সিনড্রোম,ফিনাইল কেটোনইউরিয়া,নিউরাল টিউবের সমস্যা, যেমন- পলিজেনিক ডিজঅর্ডার,ক্লিনফেলটার্স সিনড্রোম,রুবেলা/সিফিলিস বা টক্সোপ্লাজমোসিসজণিত কারণে স্নায়ুতন্ত্র সম্পর্কীয় সমস্যা, যেমন- হাইড্রোকেফালাস, মাইক্রোকেফালি ইত্যাদি৷
প্রসবকালীন জটিলতা:
মায়ের গর্ভ থেকে বাচ্চা জণ্ম নেয়ার সময় মস্তিষ্কে কোন ধরনের আঘাত পেলে বাচ্চা মানসিক প্রতিবন্ধী হতে পারে৷ আবার অনেক বাচ্চা রয়েছে, যারা পূর্ণতা পাওয়ার আগেই পৃথিবীর আলো দেখে৷ এ ধরনের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে শারীরিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়৷ যেসব শিশু এ সমস্যায় ভোগে তাদের স্নায়ুতন্ত্র সম্পূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করে না৷ ফলে এরা পরে মানসিক প্রতিবন্ধীত্বের শিকার হয়৷
রাসায়নিক পদার্থ (ফিজিক্যাল ও রাসায়নিক এজেন্ট):
বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের কারণে শিশুর মানসিক প্রতিবন্ধিত্বের সৃষ্টি হতে পারে৷
সমাজ থেকে বঞ্চিত হওয়া:
সমাজ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলেও কোনও কোনও মানুষের মানসিক প্রতিবন্ধিত্বের সৃষ্টি হতে পারে৷
অজানা কারণ:
এমন অনেক কারণ রয়েছে, যা জানা নেই৷
মানসিক প্রতিবন্ধিদের মূল্যায়ন
বিভিন্ন প্রক্রিয়া, ইতিহাস ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক প্রতিবন্ধীত্বের মূল্যায়ন করা যায়৷ যেমন-
*
শিশুর কর্মদক্ষতার বিশ্লেষণ
*
আইকিউ বা বুদ্ধ্যন্ক
*
পেশি-চলত্শক্তির বিকাশ
*
শিশুর ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা
*
কানে কম শোনা
*
দৃষ্টিশক্তিহীনতা
*
সামাজিক বিকাশ এবং ব্যক্তিগত ও অন্যান্য শারীরিক ও সাইকিয়াট্রিক সমস্যার সামঞ্জস্য বিধান৷
*
শরীরের বিকলাঙ্গতা বের করতে পূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন৷
*
মেডিকেল ইতিহাস
শিশুর মা-বাবার কাছ থেকে বিভিন্ন মেডিকেল ইতিহাস নিতে হবে৷ এগুলো হলো -
*
প্রসবকালীন কোন জটিলতা হলো কি না
*
গর্ভাবস্থায় মেডিকেল ইতিহাস
*
বাচ্চার শারীরিক ও মানসিক বিকাশে ধাপ
*
বাচ্চা হওয়ার সময় মস্তিষ্কে আঘাত পেয়েছে কি না
*
শিশুর সংক্রামক ব্যাধি, যেমন - মেনিনজাইটিস
*
রক্তের সম্পর্ক রয়েছে এমন আত্মীয়স্বজনের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক ইত্যাদি৷
চিকিত্সা ব্যবস্থা
অপ্রিয় হলেও সত্য, মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের মা-বাবার অবগত হওয়া প্রয়োজন যে, পৃথিবীতে কোথাও এখনো কোন ওষুধ বা চিকিত্সা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি, যা দ্বারা এই মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের বুদ্ধি বাড়ানো যেতে পারে৷ তবে আশ্বস্ত হওয়ার মতো সংবাদ হলো, বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের মানসিক ও শারীরিক উন্নতি করা সম্ভব৷
ঔষুধ সেবনের ক্ষেত্রে রেজিষ্টার চিকিত্সকের পরামর্শ নিন৷ অন্যথায় কোন সমস্যার জন্য ডি.নেট দায়ী থাকবে না৷
তথ্য সূত্র :
দৈনিক প্রথম আলো