►মধ্য শাবানের রাত্রি ভাগ্য রজনী নয়, মূলতঃ এ রাত্রিকে ভাগ্য রজনী বলার পেছনে কাজ করছে সূরা আদ-দুখানের ৩ ও ৪ আয়াত দু’টির ভূল ব্যাখ্যা। তা হলোঃ
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ* فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ – سورة الدخان:3ـ4
আয়াতদ্বয়ের অর্থ হলোঃ “অবশ্যই আমরা তা (কোরআন) এক মুবারক রাত্রিতে অবতীর্ণ করেছি, অবশ্যই আমরা সতর্ককারী, এ রাত্রিতে যাবতীয় প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়â€।
এ আয়াতদ্বয়ের তাফসীরে অধিকাংশ মুফাসসির বলেনঃ এ আয়াত দ্বারা রমযানের লাইলাতুল ক্বাদরকেই বুঝানো হয়েছে। যে লাইলাতুল কাদরের চারটি নাম রয়েছে: ১. লাইলাতুল কাদর, ২. লাইলাতুল বারা’আত, ৩. লাইলাতুচ্ছফ, ৪.লাইলাতুল মুবারাকাহ। শুধুমাত্র ইকরিমা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, এ আয়াত দ্বারা শা’বানের মধ্যরাত্রিকে বুঝানো হয়েছে। এটা একটি অগ্রহণযোগ্য বর্ণনা।
আল্লামা ইবনে কাসীর (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, আলোচ্য আয়াতে ‘মুবারক রাত্রি’ বলতে ‘লাইলাতুল ক্বাদর বুঝানো হয়েছে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ – سورةالقدر:1
আমরা এ কোরআনকে ক্বাদরের রাত্রিতে অবতীর্ণ করেছি। (সূরা আল-কাদরঃ১)।
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেনঃ
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ- سورة البقرة:185
রমযান এমন একটি মাস যাতে কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। (সূরা আলবাকারাহঃ১৮৫)।
যিনি এ রাত্রিকে শা‘বানের মধ্যবর্তী রাত বলে মত প্রকাশ করেছেন, যেমনটি ইকরিমা থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি অনেক দূরবর্তী মত গ্রহণ করেছেন; কেননা কোরআনের সুস্পষ্ট বাণী তা রমযান মাসে বলে ঘোষণা দিয়েছে’। (তাফসীরে ইবনে কাসীর (৪/১৩৭)।
অনুরূপভাবে আল্লামা শাওকানীও এ মত প্রকাশ করেছেন। (তাফসীরে ফাতহুল ক্বাদীর (৪/৭০৯)।
►সুতরাং ভাগ্য রজনী হলো লাইলাতুল ক্বাদর যা রমযানের শেষ দশদিনের বেজোড় রাত্রিগুলো।
আর এতে করে এও সাব্যস্ত হলো যে, এ আয়াতের তাফসীরে ইকরিমা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) মতভেদ করলেও তিনি শা’বানের মধ্য তারিখের রাত্রিকে লাইলাতুল বারা’আত নামকরণ করেননি।
►শাবান মাসের মধ্য রজনীতে ইবাদাত সম্মন্ধে কিছু হাদিস◄
শাবান মাসের মধ্য রাত্রির ফযীলত সম্পর্কে কিছু হাদীস বর্ণিত হয়েছে:
১. আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন: এক রাতে আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে খুঁজে না পেয়ে তাঁকে খুঁজতে বের হলাম, আমি তাকে বাকী গোরস্তানে পেলাম। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বললেন: ‘তুমি কি মনে কর, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার উপর জুলুম করবেন?’ আমি বললাম: ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি ধারণা করেছিলাম যে আপনি আপনার অপর কোন স্ত্রীর নিকট চলে গিয়েছেন। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: ‘মহান আল্লাহ তা’লা শা‘বানের মধ্যরাত্রিতে নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হন এবং কালব গোত্রের ছাগলের পালের পশমের চেয়ে বেশী লোকদের ক্ষমা করেন।
►হাদীসটি ইমাম আহমাদ তার মুসনাদে বর্ণনা করেন (৬/২৩৮), তিরমিযি তার সুনানে (২/১২১,১২২) বর্ণনা করে বলেন, এ হাদীসটিকে ইমাম বুখারী দুর্বল বলতে শুনেছি। অনুরূপভাবে হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে (১/৪৪৪, হাদীস নং ১৩৮৯) বর্ণনা করেছেন। হাদীসটির সনদ দুর্বল বলে সমস্ত মুহাদ্দিসগণ একমত।
২. আবু মূসা আল আশ’আরী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ‘আল্লাহ তা‘আলা শাবানের মধ্যরাত্রিতে আগমণ করে, মুশরিক ও ঝগড়ায় লিপ্ত ব্যক্তিদের ব্যতীত, তাঁর সমস্ত সৃষ্টিজগতকে ক্ষমা করে দেন। হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে (১/৪৫৫, হাদীস নং ১৩৯০),এবং তাবরানী তার মু’জামুল কাবীর (২০/১০৭,১০৮) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।
►আল্লামা বূছীরি বলেন: ইবনে মাজাহ বর্ণিত হাদীসটির সনদ দুর্বল। তাবরানী বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে আল্লামা হাইসামী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) মাজমা‘ আয যাওয়ায়েদ (৮/৬৫) গ্রন্থে বলেনঃ ত্বাবরানী বর্ণিত হাদীসটির সনদের সমস্ত বর্ণনাকারী শক্তিশালী। হাদীসটি ইবনে হিব্বানও তার সহীহতে বর্ণনা করেছেন। এ ব্যাপারে দেখুন, মাওয়ারেদুজ জাম‘আন, হাদীস নং (১৯৮০), পৃঃ (৪৮৬)।
৩. আলী ইবনে আবী তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “যখন শা‘বানের মধ্যরাত্রি আসবে তখন তোমরা সে রাতের কিয়াম তথা রাতভর নামায পড়বে, আর সে দিনের রোযা রাখবে; কেননা সে দিন সুর্যাস্তের সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন: ক্ষমা চাওয়ার কেউ কি আছে যাকে আমি ক্ষমা করব। রিযিক চাওয়ার কেউ কি আছে যাকে আমি রিযিক দেব। সমস্যাগ্রস্ত কেউ কি আছে যে আমার কাছে পরিত্রাণ কামনা করবে আর আমি তাকে উদ্ধার করব। এমন এমন কেউ কি আছে? এমন এমন কেউ কি আছে? ফজর পর্যন্ত তিনি এভাবে বলতে থাকেনâ€।
►হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে (১/৪৪৪, হাদীস নং ১৩৮৮) বর্ণনা করেছেন। আল্লামা বূছীরি (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) তার যাওয়ায়েদে ইবনে মাজাহ (২/১০) গ্রন্থে বলেন, হাদীসটির বর্ণনাকারীদের মধ্যে ইবনে আবি সুবরাহ রয়েছেন যিনি হাদীস বানাতেন। তাই হাদীসটি বানোয়াট।
উল্লিখিত আলোচনায় এটা স্পষ্ট যে, শা‘বানের মধ্যরাত্রির ফযীলত বিষয়ে যে সব হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার সবগুলোই দুর্বল অথবা বানোয়াট, আর তাই গ্রাহ্যতারহিত।
►প্রথম হাদীসটি দুর্বল, দ্বিতীয় হাদীসটিও অধিকাংশ আলেমের মতে দুর্বল, যদিও কোন-কোন আলেম এর বর্ণনাকারীগণকে শক্তিশালী বলে মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কেবলমাত্র বর্ণনাকারী শক্তিশালী হলেই হাদীস বিশুদ্ধ হওয়া সাব্যস্ত হয়না।
►মোট কথাঃ প্রথম ও দ্বিতীয়, এ হাদীস দুটি দুর্বল। খুব দুর্বল বা বানোয়াট নয়। সে হিসেবে যৎকিঞ্চিৎ প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে এ রাত্রির ফযীলত রয়েছে।
►কিন্তু আমরা যদি উপরে উল্লিখিত প্রথম ও দ্বিতীয় হাদীসটি পাঠ করে দেখি তাহলে দেখতে পাব —আল্লাহ তা‘আলা নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আহবান জানাতে থাকেন — হাদীসদ্বয়ে এ বক্তব্যই উপস্থাপিত হয়েছে। মুলত সহীহ হাদীসে সুস্পষ্ট এসেছে যে, “আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষাংশে – শেষ তৃতীয়াংশে- নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হয়ে আহবান জানাতে থাকেন ‘এমন কেউ কি আছে যে আমাকে ডাকবে আর আমি তার ডাকে সাড়া দেব? এমন কেউ কি আছে যে আমার কাছে কিছু চাইবে আর আমি তাকে দেব? আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আর আমি তাকে ক্ষমা করে দেব?†[বুখারী, হাদীস নং ১১৪৫, মুসলিম হাদীস নং ৭৫৮]
সুতরাং আমরা এ হাদীসদ্বয়ে অতিরিক্ত কোন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। সুতরাং এ রাত্রির বিশেষ কোন বিশেষত্ব আমাদের নজরে পড়ছে না। এজন্যই শাইখ আব্দুল আজীজ ইবনে বায (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) সহ আরো অনেকে এ রাত্রির অতিরিক্ত ফযীলত অস্বীকার করেছেন।
►►শা‘বানের মধ্যরাত্রির পরদিন কি রোযা রাখা যাবে?
উত্তরঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বহু সহীহ হাদীসে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি শা‘বান মাসে সবচেয়ে বেশী রোযা রাখতেন। (এর জন্য দেখুনঃ বুখারী, হাদীস নং ১৯৬৯, ১৯৭০, মুসলিম, হাদীস নং ১১৫৬, ১১৬১, মুসনাদে আহমাদ ৬/১৮৮, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ২৪৩১, সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস নং ২০৭৭, সুনানে তিরমিঝি, হাদীস নং ৬৫৭)।
সে হিসাবে যদি কেউ শা‘বান মাসে রোযা রাখেন তবে তা হবে সুন্নাত। শাবান মাসের শেষ দিন ছাড়া বাকী যে কোন দিন রোযা রাখা জায়েয বা সওয়াবের কাজ। তবে রোজা রাখার সময় মনে করতে হবে যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেহেতু শা‘বান মাসে রোজা রেখেছিলেন তাকে অনুসরন করে রোযা রাখা হচ্ছে।
অথবা যদি কারও আইয়ামে বিদের (সকল মাসেই) নফল রোযা তথা মাসের ১৩,১৪,১৫ এ তিনদিন রোযা রাখার নিয়ম থাকে তিনিও রোযা রাখতে পারেন। কিন্তু শুধুমাত্র শা‘বানের পনের তারিখ রোযা রাখা বিদ‘আত হবে। কারণ শরীয়তে এ রোযার কোন ভিত্তি নেই।
আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর রাসূলের পরিপূর্ণ পদাঙ্ক অনুসরন করে চলার তৌফিক দিন। আমীন।