Recent Posts

Pages: 1 ... 3 4 [5] 6 7 ... 10
41
🧒👨‍👩‍👧 প্যারেন্টিং: শিশুর আচরণ পরিবর্তন করার আগে নিজেকে পরিবর্তন করুন

সন্তান আমাদের প্রতিচ্ছবি। আমরা যেমন আচরণ করি, তারা তেমনই শিখে নেয়। তাই শিশুর চরিত্র গঠনে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন অভিভাবকের নিজেকে পরিবর্তন করা।

কি করবেন

১। ভালো কাজের জন্য শিশুকে উৎসাহ দিন বা পুরস্কৃত করুন – এতে সে আত্মবিশ্বাসী হবে।
২। শিশুকে প্রশংসা করুন – এতে সে অন্যকেও প্রশংসা করতে শিখবে।
৩। শিশুকে নৈতিকতা শিক্ষা দিন – সে সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত নাগরিক হবে।
৪। শিশুকে স্নেহ ও ভালোবাসা দিন – সে অন্যকে ভালোবাসতে শিখবে।
৫। শিশুর সাথে বন্ধুভাবাপন্ন হোন – তার নিজের জগৎ গড়ে তুলতে পাশে থাকুন।

কি করবেন না

১। শিশুকে নিন্দা করবেন না – এতে তার মনে ঘৃণা তৈরি হবে।
২। শিশুকে মারবেন না – এতে তার মধ্যে অবাধ্যতা জন্ম নেবে।
৩। শিশুকে উপহাস করবেন না – এতে তার মধ্যে হীনমন্যতা তৈরি হবে।
৪। শিশুকে সকলের সামনে লজ্জা দিবেন না – এতে সে অপরাধী মানসিকতায় ভুগবে।
৫। শিশুর সামনে কোনো অপরাধ করবেন না বা অপরাধের পক্ষ নেবেন না – এতে সে অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে।
৬। শিশুর সামনে দাম্পত্য কলহ করবেন না – এতে তার ভবিষ্যৎ পারিবারিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
৭। শিশুর সামনে শিক্ষক বা পরিচিত কারো নিন্দা করবেন না – এতে তার শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট হবে।

👉 মনে রাখবেন, শিশু আপনার কথায় নয়, আপনার আচরণে গড়ে ওঠে।
42
মাথার চুল কাটার স্টাইল বা ডিজাইন নিয়ে ইসলাম কি বলে?

মাথার চুল কাটা

মহিলারা মাথার চুল কাটা অথবা ফ্যাশনের জন্য চুলকে ছোট ছোট করা, ডানে-বামে, সামনে-পিছনের যে কোন দিক থেকে হোক না কেন তা পুরুষের সঙ্গে সাদৃশ্য হওয়ার কারণে নাজায়েয ও গোনাহ।

এ সম্পর্কে হাদীসে কঠোর নিষেধাজ্ঞা এসেছে। হুজুর সাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম ইরশাদ করেন, "আল্লাহ তা'আলার অভিসম্পাত সে সকল পুরুষের উপর যারা মহিলাদের সাদৃশ্য অবলম্বন করে এবং সমভাবে সে সব মহিলাদের উপরও আল্লাহর অভিসম্পাত প্রযোজ্য যারা পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণ করে।”

অতএব মহিলাদের জন্য মাথার চুল কাটা জায়েয নেই। স্বামীর জন্য নির্দেশ দিলেও স্ত্রীর জন্য এ আদেশ পালন করা নাজায়েয। কেননা আল্লাহ তা'আলার অবাধ্য হয়ে স্বামীর অনুগত্য করা হারাম। এমতাবস্থায় স্ত্রীর উচিত নম্রতা ও ভদ্রতার সঙ্গে অসম্মতি প্রকাশ করা। স্বামীকে শরীয়তের নির্দেশ জানিয়ে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করা। এতে আমি আশাবাদী যে, স্বামী যেহেতু একজন মুসলমান তাই শরীয়তের নির্দেশ অমান্য করবেনা, এবং শরীয়ত বিরোধী কাজে বাধ্য করতে স্ত্রীর উপর চাপ সৃষ্টি করবেনা। (বুখারী, আবু দাউদ, মেশকাত- ৩৮০ পৃ)

বব কাটিং চুল

মহিলাদের জন্য বব কাটিং চুল রাখা সম্পূর্ণ নাজায়েয সুতরাং তা থেকে বিরত থাকা অত্যাবশ্যক।

চুল ছাঁটা

মাথার চুল কাটার যে হুকুম উপরে আলোচনা করা হয়েছে চুল ছাঁটার হুকুমও তাই। সুতরাং বেকলমাত্র ফ্যাশনের জন্য মাথার চুল ছাঁটা জায়েয নেই। তবে যদি চুলের অগ্রভাগ ফেটে শাখা-প্রশাখার সৃষ্টি হয়, যার দরুন চুলের মধ্যে জটিলতা দেখা দেয়, সে ক্ষেত্রে চুলের 'অগ্রভাগ ছাঁটার অনুমতি আছে। তাছাড়া সাধারণ ভাবে যদি উঁচু বা নীচু হয়ে যায়, অর্থাৎ চুলের অগ্রভাগে সামান্য কটা চুল অসমভাবে লম্বা বা খাটো অবস্থায় থাকে তাহলে অগ্রভাগ থেকে ছেঁটে সমান করার অবকাশ আছে।

চুলে ডিজাইন করা

মহিলাদের জন্য চুল না কেটে বিভিন্ন ডিজাইন করে রাখা জায়েয। তবে এক্ষেত্রে সর্বদা নিম্নোল্যেখিত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।

(১) এর দ্বারা যেন কাফের বা পাপাচারী মহিলাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা না হয়।
(২) তা হতে হবে শুধুমাত্র আপন স্বামীর মনোরঞ্জন করার উদ্দেশ্যে।
(৩) এ কাজে এত সময় নষ্ট করা যাবে না, যার প্রেক্ষিতে অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।

চুল বৃদ্ধির জন্য কাটা

অনেক মহিলাদের চুলের শেষপ্রান্তে দু'তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে চিকন চুলে রুপান্তরিত হয়, ফলে চুলের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় তখন যদি সে চুলের অগ্রভাগ কেটে দেয়া হয়, তাহলে আবার নতুন করে সে চুল বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। তাহলে এ অবস্তায় চুল বাড়ানোর জন্য অগ্রভাগ ছেটে দেয়া নিঃসন্দেহে জায়েয।

রোগ-ব্যাধির কারণে চুল কাটা

কোন মহিলার মাথায় যদি রোগের কারণে চুল কাটার প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে অপারগতার কারণে অর্থাৎ শরয়ী ওযরের ভিত্তিতে চুল কাটা জায়েয আছে। কিন্তু যখনই এ সমস্যা দূর হয়ে যাবে তখন চুল কাটার এ অনুমতিও থাকবেনা। অর্থাৎ এর পর আর চুল কাটা জায়েয হবেনা।"

মেয়েদের চুল কাটা

বালেগা (প্রাপ্ত বয়স্কা) বা নিকটবর্তী বালেগা মেয়েদের চুল কাটা জায়েয নেই। উপরে চুল কাটার ব্যাপারে যে সব হুকুম লেখা হয়েছে সে সব বিষয়াবলী তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। কিন্তু, যারা ছোট এখনো প্রাপ্ত বয়স্কা হয়নি অর্থাৎ যাদের বয়স নয় বছরের কম, তাহলে সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য বা অন্য কোন ভাল উদ্দেশ্যে তাদের চুল কাটার অনুমতি আছে। তবে কাফের, ফাসেকদের বাহ্যঃ সাদৃশ্য অবলম্বন থেকে বিরত থাকবে, কেননা শরীয়ত তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করতে নিষেধ করেছে।

চুল রাঙ্গানো

বিউটি পার্লারে মেয়েদেরকে ব্লিচ করা হয়। পরে অন্য রঙ্গে রঙ্গিন করা হয়। এগুলো যদি শরীয়তের পরিসীমার মধ্যে থেকে হয় তাহলে শরয়ী দিক থেকে কোন প্রকার নিষেধাজ্ঞা নেই। শরয়ী সীমারেখা কিতাবের প্রারম্ভে বর্ণনা করা হয়েছে। (আল আশ্বাহ ওয়ান্নাযায়ের ২:১৭০, ফতোয়া খানিয়া ৩:৪)

ভ্রু চিকন করা

আজকাল মহিলারা ভ্রু সুন্দর ও আকর্ষণীয় করার উদ্দেশ্যে ভ্রুর কিছু লোম উপড়ে ফেলে। তাঁর ফলে ভ্রুদ্বয় অর্ধবৃত্ত রেখায় পরিণত হয়। এটা শরীয়তের দৃষ্টিতে না জায়েয। কেননা শরীর আল্লাহ প্রদত্ত আমানত। শরয়ী ও প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া এ শরীরের কোন অংশেই পরিবর্তন বা রূপান্তর করা জায়েয নেই। সঙ্গত কারণেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য দাতের মধ্যে ফাঁকা সৃষ্টি করা, শরীরে চিত্রাঙ্কন করা বা চিত্রাঙ্কন করানোকে না জায়েয, অভিসম্পাতের উপযুক্ত এবং আল্লাহ তা'আলার সৃষ্টির মাঝে পরিবর্তন করা আখ্যা দিয়েছেন। তিনি শরীর থেকে লোম উপড়ে ফেলার ব্যাপারে কঠোর ভাবে নিষেধ করেছেন। সুতরাং ভ্রুর মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করা যা আজকাল সাধারণ ফ্যাশনের পরিনত হয়েছে সম্পূর্ণ নাজায়েয।

স্বামীকে খুশী করার উদ্দেশ্যে ও এরূপ করা জায়েয নেই। তবে যদি ভ্রুর লোম অতিরিক্ত লম্বা হয়ে যায় এবং বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে থাকার কারণে খারাপ দেখা যায়, তাহলে তা কেটে কিছুটা ছোট করা নিঃসন্দেহে জায়েয।

চেহারার লোম পরিষ্কার করা

মুখমন্ডলের লোম পরিষ্কা করা জায়েয। তবে তা উপড়ে ফেলা উচিৎ নয়। কেননা এতে শারীরিক কষ্ট হয়ে থাকে, তাই পাউডার জাতীয় (হেয়ার রিমোভার) বস্তু দ্বারা পরিষ্কার করা শ্রেয়।(মেশকাত শরীফ- ৩৮১ পৃঃ)

গোঁফ-দাড়ী পরিষ্কার করা

কোন মহিলার মুখে যদি গোঁফ-দাড়ী গজায়, তা পরিষ্কার করা শুধু জায়েযই নয় বরং অতি উত্তম। কিন্তু উপড়াতে কষ্ট হওয়ার কারণে তা করা ঠিক নয়। বরং কোন প্রকার পাউডার দ্বারা পরিষ্কার করা উচিত।

ঠোঁটের লোম পরিষ্কার করা

যদি কোন মহিলার ঠোঁটের উপর লোম গজায় তাহলে তা পরিষ্কার করা নিষেধ নয়। বরং তা পরিষ্কার করা মহিলাদের জন্য উত্তম ও মুস্তাহাব।

হাত পায়ের লোম পরিষ্কার করা

মহিলাদের জন্য হাত ও পায়ের লোম পরিষ্কার করা জায়েয। কেননা তাদের জন্য সৌন্দয্য অর্জন করা ন্যায়সঙ্গত অধিকার। তাছাড়া এতে সৃষ্টির মধ্যে কোন প্রকার পরিবর্তন বলা যাবেনা। এবং এ ক্ষেত্রে ধোকা দেয়ারও অর্থ বুঝায়না। সুতরাং হাত পায়ের লোম না উপড়িয়ে উপরোল্লিখিত পদ্ধতিতে পরিষ্কার করা উত্তম।

শরীরে চিত্রাংকন করা

শরীরে যে কোন ধরণের চিত্রাঅংকন করা বা করানো জায়েয নেই, হারাম। এর পদ্ধতি হলো শরীরে সূঁই জাতীয় কোন কিছু দ্বারা গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে এর মধ্যে সুরমা বা নীল ভরে দেয়া এবং এভাবে শরীরে জীব-জন্তু বা অন্য কোন জিনিসের চিত্র আঁকা। এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে কঠিন ধমক দেয়া হয়েছে :

“আল্লাহ তা'আলার অভিসম্পাত সে মহিলার উপর পতিত হোক যে শরীরে চিত্রাংকন করে এবং চিত্রাংকন করায়।” (ফতোয়ায়ে শামী- ৬:৩৭৩ পৃঃ (৮) মেশকাত ৩৮১ পৃঃ, বোখারী ও মুসলিম)

43

কা'বা হল আজরের পুত্র ইব্রাহীম খলিলের বানানো, আর মানুষের হৃদয় হল মহান আল্লাহ্ অবস্থানের পথ

আমরা জানি, কা'বা শরীফ মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র স্থান, যার নির্মাণ নবী ইব্রাহীম (আঃ) এর হাতে সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু কেন একটি মানব হৃদয়কে সেই পবিত্র কা'বার থেকেও অধিক মূল্যবান বলা হচ্ছে? এর কারণটি নিহিত রয়েছে উভয়ের উৎপত্তির মহিমায় এবং উদ্দেশ্যের গভীরতায়।

কা'বা শরীফ, নিঃসন্দেহে, আল্লাহর এক বিশেষ নিদর্শন। এটি সেই কিবলা, যেদিকে মুখ করে সারা বিশ্বের মুসলমানগণ সালাত আদায় করেন। এর ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় তাৎপর্য অপরিসীম। নবী ইব্রাহীম (আঃ), যিনি আল্লাহর একনিষ্ঠ বন্ধু (খলিল) ছিলেন, তিনি স্বহস্তে এই ঘর নির্মাণ করেছিলেন আল্লাহর ইবাদতের জন্য। এটি আল্লাহর একত্ববাদের প্রতীক এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু।

কিন্তু যদি আমরা গভীরভাবে চিন্তা করি, তবে দেখব যে কা'বা একটি কাঠামো, যা পাথর ও অন্যান্য উপাদান দিয়ে নির্মিত। এর একটি নির্দিষ্ট স্থান এবং আকার রয়েছে। এটি আল্লাহর ইবাদতের জন্য একটি পবিত্র স্থান হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে, যেখানে মানুষ একত্রিত হয়ে তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে।

অন্যদিকে, মানুষের হৃদয় – এটি কোনো বস্তু নয়। এটি মহান আল্লাহ্ তায়ালার এক বিশেষ সৃষ্টি, যেখানে তিনি স্বয়ং অবস্থান করেন। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, "আমার আকাশ ও পৃথিবী কিছুই আমাকে ধারণ করতে পারে না, কিন্তু মুমিনের হৃদয় আমাকে ধারণ করতে পারে।" (আল-হাদীস আল-কুদসী)।

এই হাদীস থেকে আমরা বুঝতে পারি, মানুষের হৃদয় আল্লাহর এক বিশেষ আবাসস্থল। যখন কোনো মুমিনের হৃদয় ঈমান, ভালোবাসা, এবং আল্লাহর স্মরণে পরিপূর্ণ থাকে, তখন সেই হৃদয় আল্লাহর নূরে আলোকিত হয়। সেই হৃদয় যেন এক জীবন্ত কা'বা, যেখানে সর্বদা আল্লাহর জিকির ও মহিমা ধ্বনিত হয়।

নবী ইব্রাহীম (আঃ) কর্তৃক নির্মিত কা'বা যেমন আল্লাহর ইবাদতের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থান, তেমনি প্রতিটি মুমিনের হৃদয় আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি ব্যক্তিগত ক্ষেত্র। বাহ্যিক কা'বার দিকে মুখ করে আমরা যেমন আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করি, তেমনি আমাদের ভেতরের হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করি।

একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, বাহ্যিক ইবাদতের গুরুত্ব কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। কা'বা শরীফের সম্মান ও মর্যাদা আমাদের হৃদয়ে সর্বদা অক্ষুণ্ণ থাকবে। কিন্তু এর পাশাপাশি আমাদের অন্তরের দিকেও নজর দিতে হবে। যদি আমাদের হৃদয় কলুষিত থাকে, হিংসা-বিদ্বেষে পরিপূর্ণ থাকে, তাহলে শুধু বাহ্যিক ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা কঠিন।

আমরা আমাদের বাহ্যিক ইবাদতের পাশাপাশি আমাদের অভ্যন্তরীণ জগতকে সুন্দর ও পবিত্র করি। আমাদের হৃদয়কে আল্লাহর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করি। কারণ যে হৃদয় আল্লাহর মহব্বতে পূর্ণ, সেই হৃদয় নিঃসন্দেহে হাজার হাজার কা'বার থেকেও উত্তম। এটি মহান আল্লাহর অবস্থানের পথ, যেখানে তিনি সর্বদা বিরাজমান।

আমাদের লক্ষ্য হোক এমন একটি হৃদয় গড়ে তোলা, যা সর্বদা আল্লাহর স্মরণে সজীব থাকে, যা অন্যের কষ্টে ব্যথিত হয় এবং অন্যের সুখে আনন্দিত হয়। এই প্রকার হৃদয়ই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় এবং এটাই হল আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ শিখর।

44
সমালোচনা করতে যোগ্যতা লাগে না, সমালোচিত হতে যোগ্যতা লাগে

ধরুন, আপনি সারাক্ষণ অযথা একজন প্রার্থীর সমালোচনা করছেন বা অপ: প্রচার করছেন কিন্তু আপনি জানেনই না যে প্রতিহিংসা করতে গিয়ে বরং ওনার বেশ উপকারই করলেন। কেননা এমন আলোচনা সমালোচনার মধ্য দিয়ে অন্যরা তথা ভোটাররা  ভাবতে থাকবে - ওয়াও! ওয়াও! উনি তো দেখি বেশ বিখ্যাত, সবজায়গায় তাকে নিয়ে আলোচনা সমালোচনা চলছে। তাহলে তো উনিই আমাদের লীডার, উনিই তো এখন সেরা । 

এদিকে ঐ প্রার্থীও ভাবছে, বাহ! মাঠ গুছানো হয়ে গেলো, সমালোচক করিল উন্মুক্ত দ্বার। প্রবাদ আছে "গাইতে গাইতেই গায়েন" হলেন ঘাটের মাঝি। এপ্রসঙ্গে আব্রাহাম লিঙ্কনও হাসতে হাসতে বলেছিলেন, আপনি সমালোচক নিজেকে ক্ষয় করে আমাকে গড়লেন, আমি কিন্তু আমি আপনার দ্বারা উপকৃত।

আসলেই তাই, আপনি ভাবছেন প্রতিহিংসা করে তাকে পেছনে ফেললেন ? কিন্তু না! বরং আপনার কৃতকর্মই হাস্যকর! আপনিই অধম! প্রকৃতপক্ষে আপনার ঐ প্রতিহিংসা, আপনার ঐ হীনমন্যতা বিনা পয়সায় কারো কারো প্রচার প্রচারণা হয়ে গেলো। একরকম তিনি বিখ্যাতও হয়ে গেলেন।

আর আপনি নোংরা ডাস্টবিনেই পড়ে রইলেন, সবাই কিন্তু সারাক্ষণ আপনাকেই ছি! ছি! করছে। কেননা সবাই জেনে গেছে আপনি নিম্ন ক্যাটাগরির কার্যকলাপে লিপ্ত।

আর এটাও মনে রাখবেন যে লোক অন্যের বদনাম আপনার কাছে করবে, ঐ লোক কিন্তু আপনার বদনামও অন্য লোকের কাছে বলাবলি করবে। সুতরাং গীবতকারী, হীনমন্য লোকদের দূরে রাখুন, ধুর! ধুর! করে তাড়িয়ে দিন। কবিও বলেছিলেন, হিংসুকের ঘরে বাতি দিবি কে রে, হিংসার আগুনে পুড়িলে বাঁচাবি কে রে।

-- রানা চৌধুরী
45
হরিধান: হরিপদের সোনালী সন্তান

বেশি ফলন দেয়—ধানের এমন একটি নতুন জাত আবিষ্কার হয়​ ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কৃষক হরিপদ কাপালির হাত ধরে। যা পরে ‘হরি ধান’ হিসেবে পরিচিতি পায় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে এর চাষাবাদ শুরু হয়। ২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর সেই সংবাদ উঠে আসে প্রথম আলোর ‘আলোকিত দক্ষিণ’ ক্রোড়পত্রে। পরে ২০০৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর শুক্রবারের বিশেষ প্রতিবেদন হিসেবে হরি ধানের কথা প্রকাশিত হয় প্রথম আলোতে।  বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটও ‘হরি ধান’কে স্বীকৃতি দিয়েছে।

ঝিনাইদহ জেলার পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে নাম না জানা এক জাতের ধান চাষ হচ্ছে ব্যাপক হারে। আসাদ নগর বংকিরাসহ পাশ্ববর্তী গ্রামগুলোর কৃষকরা তাদের শত শত একর জমিতে এই ধান চাষ করে বাম্পার ফলন ফলাতে সক্ষম হয়েছেন। অল্প খরচে অধিক ফলনে এই ধান দেখতে ও বীজ সংগ্রহে প্রতিদিন দূর-দূরান্তের অসংখ্য লোক গ্রামগুলোতে আসছে।
কৃষি বিভাগ অজানা এই ধানের ফলন ভালো হচ্ছে বলে জানালেও ধানের জাত বলতে পারেননি। তারা দ্রুত পরীক্ষার মাধ্যমে জাত বাছাই করার ব্যবস্থা করবেন বলে জানিয়েছে।
তবে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার আসাদনগর গ্রামের হরিপদ কাপালী এই নাম না জানা জাতের ধান প্রথম চাষ করেন। তার কাছ থেকে বীজ নিয়ে অন্যরা ওই ধান করছে। ফলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এলাকার লোকজন ধানের নাম দিয়েছেন ‘হরি ধান’। কৃষকরা জানান আশপাশের দশ-বারো গ্রাম ছাড়িয়ে বর্তমানে অন্য জেলায়ও এই ধানের চাষ শুরু হয়েছে। কম খরচে অধিক ফলন তুলতে দেখে সবাই এই ধান চাষে ঝুঁকে পড়েছে। হরি ধানে চিটা কম ও বিচালীর দামও বেশি।

সরেজমিন আসাদ নগর গ্রামে গিয়ে হরিপদ কাপালীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ছয়-সাত বছর আগে তিনি জমিতে অত্র অঞ্চলে প্রচলিত বিআর১১ জাতের ধান চাষ করেন। ওই ধান ক্ষেতে আগাছা পরিষ্কার করার সময় চার-পাঁচটি মোটা ধান গাছ দেখতে পান যা আগাছা হিসেবে কেটে না ফেলে তিনি রেখে দেন। তার ধারণা ছিল এই গাছে হয়তো বা ধান হবে না কিন্তু অন্যান্য ধান গাছের সঙ্গে এই গাছগুলোও বাড়তে থাকে এবং ভালো ধান হয়। ধানের গাছগুলো মোটা ও লম্বা হয়।

হরিপদ ওই গাছ থেকে পাওয়া ধানগুলো আলাদা করে রেখে দেন। পরের বছর তিনি দুই থেকে তিনশ গ্রামের ওই ধান বীজের জন্য আলাদা বীজতলা তৈরি করেন এবং আলাদা জমিতে রোপণ করেন। বাকিতে জমিতে করেন অন্য ধান। কিন্তু সমান ভাবে উভয় ধানের পরিচর্যা করেন। আচার্য অন্যান্য ধান থেকে অজানা জাতের ধানের ফলন ভালো হয়। এরপর ধান কাটার সময় তিনি স্বর্ণা জাত ও নাম না জানা ওই জাতের উত্পাদন পরীক্ষা করেন। নিজের দুই জাতের সমপরিমাণ জমির ধান কেটে দেখতে পান অজানা জাতের ধানের ফলন বেশি হয়েছে। এর পরের বছর তিনি দশ কাঠা জমিতে এই ধানের চাষ করেন। তার ক্ষেতের ধানগাছ দেখে এলাকার লোকজন মুগ্ধ হন। আশপাশের লোকজন ধানের ক্ষেত দেখতে আসতে শুরু করেন। পরে ধান কাটার সময় ফলন দেখে অন্য কৃষকরা বীজ নেওয়ার জন্য তার কাছে ধন্যা দেন। বীজ দিতে না পারায় অনেকে তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন।

হরিপদ জানান প্রথম বছর তার দশ কাঠা জমিতে যে ধান উত্পাদন হয়েছিল তার সবই বীজ করে গ্রামের কৃষকদের দিয়েছি এভাবে একে ওপরের কাছ থেকে বীজ নিয়ে এই ধানের চাষ শুরু করেছে। গত দুই/তিন বছরের ব্যবধানে পুরো এলাকায় এই ধান ছড়িয়ে পড়েছে। এ জাতের কোনো সন্ধান না পাওয়ায় কৃষকরা এই ধানকে তার নাম অনুসারে ‘হরিধান’ নামকরণ করেছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ধানের চাষ সম্পর্কে কৃষকরা জানান, অন্যান্য ধান চাষের মতো হরিধানের চাষ করতে হয়। বিআর১১ বা স্বর্ণা জাতের ধান রোপণের সময় এই ধান রোপণ করা যায়। একই সময় কাটাও যায়। এক বিভাগ জমিতে স্বর্ণা জাতের ধান চাষ করলে সাধারণত ১৮ থেকে ২০ মণ ধান উত্পাদন হয়ে থাকে। আর হরি ধান উত্পাদন হচ্ছে ২০ থেকে ২২ মণ। কৃষকরা জানান, এই ধানের উত্পাদন খরচও কম। তাদের ভাষায় অন্য যেকোনো জাতের ধান এক জমিতে চাষ করতে খরচ হয় প্রায় এক হাজার পাঁচশ টাকা আর হরি ধান চাষ করতে তার অর্ধেক খরচ হয়।

ধানের ক্ষেতে সার এবং ওষুধ উভয় কম লাগে। স্বর্ণা ও বিআর১১ জাতের ধান দুই থেকে তিনবার ইউরিয়া সার দিতে হয়। হরিধানের ক্ষেত্রে একবার সার দিলেই চলে।

কৃষকরা জানান, এই ধানের গাছ এমনিতে বড় ও মোটা হয়। তাছাড়া ধান গাছের কাণ্ড খুব শক্ত ও মোটা হওয়ায় সহজে পোকায় আক্রমণ করতে পারে না। কৃষকরা জানান, গত বছর এই ধান চাষে আগ্রহী চাষিদের মধ্যে বীজ নিয়ে কাড়াকাড়ি হয়েছে। অনেকেই এসে বীজ না পেয়ে ফিরে গেছেন। কৃষকরা আরও জানান, হরিধানের গাছ লম্বা হওয়ায় এর বিচালীর (খড়) কদরও বেশি। এই বিচালী পাঁচশ টাকা দরে হাজার বিক্রি হয়। যা অন্যান্য বিচালীর দামের থেকে দেড়গুণ বেশি।

হরিধান চাষ করেছেন আসাদনগর গ্রামের কিতাবদী মণ্ডলের পুত্র শুকুর আলী। তিনি জানান, আড়াই বিঘা জমি আছে তার। যার সবটুকুতেই হরিধানের চাষ করেছেন। গত বছর এক বিঘা চাষ করেন। ফলন ভালো দেখে এবার পুরো জমিতেই চাষ করেছেন। শুকুর বলেন, জাত বুঝি না, ফলন ভালো দেখে তিনি এই ধানের চাষ করেছেন। এবং আগামীতেও করবেন। তিনি জানান, ইতিমধ্যে তার কাছ থেকে অনেক আত্মীয়স্বজন এই ধানের বীজ নিয়ে গেছেন। আরও অনেকে চেয়ে রেখেছেন। তারা এটা হরি ধান বলেই চেনেন।

শুকুর আলী জানান, পাশ্ববর্তী ভূটলে, নবীনগর, যাদবপুর, শাহপুর, বোয়ালীয়া, কুমড়াডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা জেলার ফকিরডাঙ্গাসহ ১১/১২টি গ্রামে এই ধানের চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু তাদের গ্রাম আসাদনগরের ছয়শ একর জমিতে এই হরি ধানের চাষ হয়েছে। পাশ্ববর্তী বংকিরা গ্রামের সুধীর কুমার জানান, প্রতিবছর তিনি ছয় বিঘা জমিতে ধান চাষ করেন। এবার সবটুকুতেই হরিধান চাষ করেছেন। অন্যজাতের ধান চাষ করেননি। তিনি জানান, তাদের গ্রামের প্রায় সবাই এই হরিধানের চাষ করেছেন। তিনি আরও জানান, ধানটা দেখতে মোটা হলেও চাল ভালো হয়। যা ভাত রান্না করে খেতেও সাধ লাগে। অন্যান্য চালের ভাতের থেকে এই ধানের ভাতের সাধ বেশি।

আসাদনগর গ্রামের সামাদ শেখের স্ত্রী আরজিনা খাতুন জানিয়েছেন, চাউল দেখতে একটু মোটা হলেও রান্নার পর দেখতে খুব ভালো লাগে। আর খেতে ভালো। তাছাড়া (বরকত!) ভাতও বেশি হয়। মুজিবুর রহমানের স্ত্রী বৃষ্টি পারভিন বলেন, এই চালের ভাত খেতে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এখন অন্য চালের ভাত খেতে ভালো লাগে না। একই গ্রামের সফিকুল ইসলামের স্ত্রী বিউটি খাতুন জানান, ধানের চিটা খুবই কম হয়, যে কারণে কাটার পর পরিষ্কার করতে কষ্টও কম।

হরিধান সম্পর্কে কৃষি বিভাগের ওই এলাকার ব্লক সুপারভাইজার তোফাজ্জল হোসেন মোল্লার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে ধানটির জাত কী তা তারা বলতে পারছেন না। তবে ধানের ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকরা এটার চাষ করছেন এবং তারাও চাষের পরামর্শ দিচ্ছেন। তিনি হরি ধানের ফলন সম্পর্কে বলেন, গত ১৭ নভেম্বর তার ব্লকের সাধুহাটি ধর্মতলা পাড়ার কৃষক আতর আলীর ক্ষেতে দুই ধরনের ধান কেটে তারা ফলন পরীক্ষা করেছেন। যেখানে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হরিবুল্লাহ সরকার উপস্থিত ছিলেন।

উভয় ক্ষেতের দশ মিটার করে জায়গা ধান কাটার পর তারা হিসাব করে দেখতে পান স্বর্ণা হয়েছে হেক্টরে কাঁচা পাঁচ দশমিক সাত মেট্রিক টন। আর শুকনা হয়েছে চার দশমিক পাঁচ মেট্রিক টন। অন্যদিকে হরি ধান উত্পাদন হয়েছে হেক্টরে কাঁচা পাঁচ দশমিক ৭৫ মেট্রিক টন ও শুকনা চার দশমিক ছয় মেট্রিক টন।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হরিবুল্লাহ সরকার জানান, তারা জাতটির পরীক্ষার জন্য ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে প্রেরণ করবেন। এখন পর্যন্ত ব্লক সুপারভাইজার ও কৃষিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ধানের ফলন ভালো বলে উল্লেখ করেন। জেলা কৃষি বিভাগের উপপরিচালক হাকিম উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, ধানটির জাত তারা যাচাই করবেন। সে লক্ষে তিনি এলাকায় গিয়েছেন এবং কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। দ্রুত ধানের জাত পরীক্ষা করবেন বলে কৃষকদের জানান।

এ ব্যাপারে স্থানীয় সাধু হাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান জানান, কৃষি বিভাগ ধানটি পরীক্ষা করে বীজ বাজারজাত করবে এটা তিনি আশা করেন। তিনি দাবি করেন যেহেতু অল্প খরচে হরিধানের অধিক ফলন হচ্ছে সেহেতু এর নামকরণ ঠিক রেখে সারা দেশে কৃষকদের মাঝে এই ধান চাষ ছড়িয়ে দেওয়া উচিত।

হরিপদ কাপালীর সাক্ষাত্কার

আমার স্মৃতি ধরে রাখবে হরি ধান


ঝিনাইদহ সদর উপজেলার আসাননগর গ্রামের মত ঈশ্বর কুণ্ডু কাপালীর পুত্র হরিপদ কাপালী। বয়স ৭০ বছর। বিয়ে করেছেন বাল্য বয়সে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সন্তান আসেনি তার ঘরে। স্ত্রী সুনীতি রানী কাপালীকে নিয়ে ভালোই চলছে তার সংসার। বসে আলাপকালে হরিপদ জানান, ‘লেখাপড়া জানিনে, তবে মাঝ বয়সে নাম লেখা শিকিচি’। তবে এসব এখন কোনো বড় বিষয় নয়। বড় বিষয়, একটা বিরাট অঞ্চলের লোক হরিপদকে চেনেন। তিনি যে হরি ধানের জনক।

প্রশ্ন: কৃষিকাজে যুক্ত হলেন কবে?

হরিপদ: বাল্য বয়স থেকে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করতে যেতাম। অসচ্ছল পরিবারে জন্ম হওয়ায় পড়ালেখা হয়ে ওঠেনি। প্রথম জীবনে অনেক কষ্ট করত হয়েছে। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে ঘাড়ে। কিছুদিনের মধ্যে সংসার পৃথক হয়ে যায় তাদের। মাত্র দেড় বিঘা জমি আছে আমার।

প্রশ্ন: এখন কেমন আছেন?

হরিপদ: বয়স অনেক হয়েছে। এখন মরণের জন্য অপেক্ষা। এই সময় আমার সাধনায় হরি ধান মাঠে এসেছে। খুব ভালো লাগছে। তিনি বলেন কত লেখাপড়া জানা মানুষেরে লোকে চেনে না। অথচ আমাকে সবাই চিনছে। এটা আমার বড় শান্তি।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলাকে দেখিয়ে বলে, ওই হচ্ছে আমার স্ত্রী। নাম সুনীতি রাণী কাপালী। আমাদের বুড়োবুড়ির সংসার ভালোই চলছে।

প্রশ্ন: হরিধান কিভাবে পেলেন?

হরিপদ: পাঁচ/ছয় বছর পূর্বে আষাঢ় মাসে ইরি ধানের ক্ষেতে ঘাস পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখি চার/পাঁচটি গাছ। সেগুলো অন্যগুলোর চেয়ে মোটা ও বড়। তখন চিন্তা করি গাছ যখন মোটা ও বড় তখন ধানও ভালো হবে। তাই আগাছা হিসেবে কেটে না ফেলে ধানগুলো রেখে দেই। পরে ওই গাছগুলো থেকে ধান বুনি। ভালো ফলন দেখে মানুষেও বীজ চায়। একজন/দুজন করে পর্যায়ক্রমে আর সব এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। জাত না চিনতে পারলেও কম খরচে ফলন ভালো দেখে সবাই চাষ করতে শুরু করেছেন।

প্রশ্ন: এটাতো এখন হরি ধান নামে পরিচিত। নাম কে দিয়েছেন?

হরিপদ: এটা আমার নামেই হয়েছে। তবে এটার নাম দিয়েছে লোকজন। এখন শুনতে আমারও বেশ ভালো লাগে। মনে হচ্ছে এই ধানটা আমি সৃষ্টি করলাম। কৃষি বিভাগের লোকজন বাড়িতে আসছেন। দামি দামি গাড়িতে করে তারা যখন আসছেন, তখন নিজের মধ্যে গর্ববোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে পাড়া গাঁয়ের অশিক্ষিত হরিকে আজ সবাই চিনে ফেলেছেন। তাছাড়া বিভিন্ন গ্রাম থেকে কৃষকরা বীজের জন্য এসে হরি লোকটি কে তার খোঁজ করছেন। এটাও আমাকে খুব আনন্দ দিচ্ছে।

প্রশ্ন: এই ধান নিয়ে আপনার কোনো পরিকল্পনা আছে?

হরিপদ: আমাদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। এখন মনে হচ্ছে হরি ধানটি আমাদের জীবনের আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এই ধান আমার মনের সব কষ্ট দূর করে দিয়েছে। ধানটি যে জাতেরই হোক কৃষকের দেওয়া নামটি যেন থাকে। আমার বংশে যেহেতু কেউ নেই তাই হরি ধানের মাধ্যমেই আমি বেঁচে থাকতে চাই।

প্রশ্ন: সরকারের কাছে কি আপনার কিছু চাওয়ার আছে?

হরিপদ: সরকারের কাছে দাবি—এই ধানটির ফলন ভালো এবং উত্পাদন খরচও কম, তাই কৃষকরা যাতে এই ধানের চাষ করে সে ব্যবস্থা যেন সরকার করে। তাদের দেওয়া নামটি অক্ষুণ্ন রেখে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ুক এই ধান।

Source: https://www.prothomalo.com/special-supplement/%E0%A6%B9%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%B9%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%AA%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%80-%E0%A6%B8%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%A8
46
খাদ্য নিরাপত্তা: হরিধান ও কৃষির রূপান্তর

গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে বিশাল পরিবর্তন হয়েছে, অগ্রগতি হয়েছে তা বহুল আলোচিত। সেই তুলনায় কৃষির যে পরিবর্তন, গ্রামীণ দৃশ্যপটের যে পরিবর্তন, তার আলোচনা হয়েছে কম। আরো কম মনোযোগ পাচ্ছে সামনের কয়েক দশকে এ পরিবর্তন কি সরলরৈখিকভাবে চলতে থাকবে, নাকি নতুন বাঁক নেবে সেই প্রসঙ্গটি। কৃষির পরিবর্তন অর্থ আসলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষি ও অকৃষির গুরুত্বের পরিবর্তন, সেসব ক্ষেত্রে প্রযুক্তির পরিবর্তন। এখন থেকে পাঁচ দশক আগে এ দেশের কৃষি বলতে ধান-পাট চাষকেই বোঝাত। তার মধ্যে আধিপত্যে ছিল ধান। পাঁচ দশক আগে এ দেশে যেসব স্থানীয় প্রজাতির ধান চাষ হতো, সেগুলের নাম কিন্তু ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে চলে যাচ্ছে। তার পরিবর্তে নতুন উচ্চফলনশীল ধান এসেছে। সেগুলোর চাষের পদ্ধতি ভিন্ন। তাতে ফলন বেড়েছে এত বেশি, যেটা এক সময় ছিল অকল্পনীয়। ফলে এ দেশের জনসংখ্যা যখন বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে, খাদ্যশস্যের অভাব নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয়নি। এ ধানের সুফল এবং সঙ্গে যেসব পরিবর্তন হয়েছে, সেই প্রসঙ্গ তাই গুরুত্বপূর্ণ।

ঝিনাইদহের কৃষক শ্রী হরিপদ কাপালীর হাতে হরি ধানের আবিষ্কার দুই দশক  আগে  যার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ  হয়নি কেবল দারিদ্রতার কারনে । এখানে উল্লেখ্য যে হরিপদ কাপালী ১৯২২ সালে ঝিনাইদহ  জেলার সদর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন এবং  ২০১৮ সালের ৬ই জুলাই নিজ শ্বশুরালয় আহসান নগর গ্রামে মৃত্যু বরন করেন । মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী সুনিতী কাপালী ও এক দত্তক সন্তান রুপ কুমার কাপালীকে রেখে যান । জনাব হরিপদ কাপালীর শেষকৃত্য সম্পন হয়  চুয়াডাঙ্গা জেলার আলীয়ারপুর শ্বাশান ঘাটে যেখানে স্থানীয়  কৃষি অফিসের কমকর্র্তাসহ  আত্মীয় স্বজন উপস্থিত ছিলেন ।

শ্রী হরিপদ কাপালীর গবেষনা ধর্ম্মী কাজ শুরু হয়  মূলত ২০০২ সালে যেখানে ইরি ধানের খেতে কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখেন তিন-চারটি ধানের গাছ, যা অন্যগুলোর থেকে মোটা ও আকারে বড়।এই চিন্তা থেকে ভালো ফলন হতে পারে এমন আশায় সেগুলো রেখে  দেন এই কৃষক গবেষক। পরবর্তী সময়ে এর বীজ থেকে চারা তৈরি করে ছোট্ট এক জায়গায় পরীক্ষামূলক চাষ করেন। সেখানেও ফলন ভালো হয়। এরপর থেকে এ ধানের চাষ বাড়াতে থাকেন হরিপদ কাপালী এবং পরে স্থানীয়ভাবে ও আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে বিন্তর লাভ করে দেন এ ধান। এটি ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ করে হরি ধান হিসেবে। বর্ষা মৌসুমে চাষকৃত মোটা জাতের এ ধানের বিঘাপ্রতি ফলন হয় গড়ে ১৫-১৬ মণ হারে। কিন্তু উৎপাদন খরচ তুলনামূলক অনেক কম এবং ভাত খেতে অনেক সুস্বাদু হওয়ায় একসময় ধানটি স্থানীয় কৃষকের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর থেকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ধানটি নিয়ে গবেষণা শুরু করে। গবেষকরা বলছেন, হরি ধান মূলত ধানের জিনগত মিউটেশন সৃষ্ট জাত। ইনব্রিড জাত, হাইব্রিড নয়। হাইব্রিডের ক্ষেত্রে বীজ বারবার কিনতে হয়। পরের বছরের জন্য বীজ করে চারা করলে উৎপাদন প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যায়। কিন্তু ইনব্রিড ধানে প্রায় শতভাগ উৎপাদন ধরে রাখা সম্ভব । এই সফল আবিস্কারটি নিয়ে  প্রথমে  বেসরকারী টিভি চ্যানেল আই এর পরিচালক ও গনমাধ্যম ব্যক্তিত্ব সাইক সিরাজ প্রচারে নিয়ে আসে যা সকল কৃষিগবেষক মহলে ব্যাপক উৎসাহের বিষয়ে পরিণত হয় ।।বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকগনের একটি দল  শ্যী হরিপদ কাপালীর  গবেষনার ক্ষেত্র পরিদর্শন করেন এবং বিভিন্ন যুক্তি তর্কে অবতির্ণ  হয়  এই বলে যে এটি কোন নূতন আবিস্কার নয় যাকে বলা হয় ভ্যারইটেল ট্রায়েল  যা এর আগে অনেক দেশেই  হয়েছে । কিন্তু  মিডিয়া ব্যক্তি সাইক সিরাজের প্রচারনায় বিষয়টি সরকারের নজরে আসে এবং  সরকারের কৃষি বিভাগ  পরীক্ষামূলক হিসাবে জামালপুর জেলাকে বেছে নয় এবং হরিধান চাষে কৃষকদের পরামশর্ দেয়  । বিষয়টি যখন  ধীরেধীরে এগুতে থাকে  তখন প্রতিযোগিতার  প্রশ্নটি  সামনে চলে আসে এবং কৃষি বিভাগ ব্রি-১১, ব্রি-৫৬ জাতের চেয়ে হরি ধানের ফলন কম বলে যুক্তি দিচ্ছে। তারা দেখিয়েছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হেক্টরপ্রতি হরি ধানের উৎপাদন হার যেখানে ৪ দশমিক ২ টন, সেখানে ব্রি-৫৬র উৎপাদন হার তার চেয়েও বেশি যা হেক্টরপ্রতি ৪ দশমিক ৭৪ টন অথচ স্বাধীন গবেষণায় উল্টো তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়,  হরি ধান আমন মৌসুমের উচ্চফলনশীল জাত ব্রি-৫৬-এর চেয়েও বেশি ফলন দেয়। প্রতি হেক্টর জমিতে ব্রি-৫৬-এর গড় উৎপাদন যেখানে ৫ দশমিক ৫১ টন, সেখানে প্রতি হেক্টর জমিতে হরি ধান উৎপাদন হয় ৬ দশমিক শূন্য ৮ টন। কাজেই হরি ধান ফলন কম দেয় তাদের এমন দাবি কতটা যুক্তিসংগত, তা পর্যালোচনার দাবি রাখে।

এখন হরিধানের বীজ সম্প্রসারন ও  অনুমোদনের যে প্রশাসনিক  পদ্বতি তার  জালে আটকে গেছে এই হরি ধানের ভবিষ্যত । তথ্য  উপাত্ব বলছে   উচ্চফলনশীল জাতটির উদ্ভাবক হরিপদ কাপালী সরকারি জেলা পর্যায়ের কিছু পুরস্কার পেয়েছেন যেমন জেলা প্রশাসক পুরস্কার, কৃষি সম্প্রসারন পুরস্কার,গনস্বাস্থ্য পুরস্কার,রোটাারি কক্লাব পুরস্কার,চ্যানেল আই পুরস্কার ইথ্যাদি। কিন্তু ২০১৮ সালে হরিপদ কাপালীর মৃত্যুর পর হরি  ধানটি এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি পায়নি। নিয়ম অনুযায়ী স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কিছু নিয়ম  ও নানা শর্ত পূরণের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। প্রথমে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিতে আবেদন করতে হয়, এরপর পরীক্ষা করা হয়, টিকলে সেটা বীজ বোর্ডে আবেদন করলেই অনুমোদন মেলে। বীজ বোর্ডে এখন বীজ ব্যবসায়ীদের একটা আধিপত্যের খবর মিলছে, হরি ধান জাত হিসেবে স্বীকৃত না হওয়ার পেছনে তাদের একটা প্রভাব থাকতে পারে বলে অনেকের অভিমত। স্থানীয় কৃষকের ভাষ্যে গুণে-মানে হরিধান এগিয়ে থাকলেও বীজকেন্দ্রিক রাজনীতিতে এর স্বীকৃতি না পাওয়াটা দুঃখজনক।

আরও বিষয় হলো স্বাভাবিকভাবে হরি ধানের  বাজারও সম্প্রসারণ ঘটেনি। এর পেছনে যথাযথ সংরক্ষণের ঘাটতি, প্রাতিষ্ঠানিক শৈথিল্য, অনীহা, মাঠ সম্প্রসারণে তদারকির অভাবসহ আরো ফ্যাক্টরের কথা উঠে এসেছে। একটা সময় ধান বীজের পুরো উৎস ছিল গ্রামের কৃষক। কৃষক নিজে বীজ সংরক্ষণ করতেন, সে বীজ বিক্রি করতেন অন্য কৃষকের কাছে। সময়ের ব্যবধানে বীজ নিয়ে গবেষণা, উন্নয়ন ও উৎপাদনে যুক্ত হয় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান আমদানি শুরু করে। নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে তারা বরাবরই স্থানীয় জাতগুলোকে বাজার ব্যবস্থাপনায় আসতে নানাভাবে বাধা গ্রস্থ করে। হরি ধানের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ রয়েছে, দেশীয় প্রজাতির উদ্ভাবিত এ উচ্চফলনশীল জাত সুকৌশলে একটি মহল বাজার থেকে উঠিয়ে দিয়েছে। জাতটির আবাদ সম্প্রসারণ না করে উল্টো মানুষকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ধানটির চাষাবাদ কমেছে। হারিয়ে গেছে স্থানীয় পর্যায়ে হরি ধানের মত উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল অনেক ধানবীজ, বিলীনের পথে আরো কিছু জাত। এর মধ্যে হরি ধান অন্যতম। বিভিন্ন গবেষণায় এ ধানের উচ্চ উৎপাদনশীলতা ও কম সার লাগার তথ্য মিলেছে। দীর্ঘ সময় পেরোলেও এ ধানের আবাদ সম্প্রসারণ করা যায়নি। এমনকি এখন পর্যন্ত বীজের জাত হিসেবে এর সরকারি স্বীকৃতিও মেলেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় এ জাতটির বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এর সম্ভাবনা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। কৃষি ক্ষেত্রে নানা অগ্রগতি হলেও ফলন বাড়াতে গুণগত মানের বীজের ঘাটতি আমাদের দেশে একটা বড় সমস্যা। সেক্ষেত্রে হরি ধানের মতো মোটামুটি পরীক্ষিত একটা ভালো বীজের প্রায় অবলুপ্তির সংকট তৈরি হওয়াটা ভীষণ উদ্বেগজনক। জাতটি সংরক্ষণ ও বাজার সম্প্রসারণে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে । কারন দেশের কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হাইব্রিড বীজের পাশাপাশি স্থানীয় প্রজাতির উচ্চফলনশীল জাতগুলোও বড় ভূমিকা রেখেছে। নতুন নতুন জাত উন্মোচন হলেও হরি ধানের মতো সেগুলো বাজার কাঠামোয় অনেকটা সংকুচিত। নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে বড় বীজ প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় উন্নত বীজগুলোর স্বীকৃতি প্রক্রিয়া থেকে শুরুকরে বাজার সম্প্রসারণ ব্যাহত করছে। এটা বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় উচ্চফলনশীল ধানবীজগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ, বাজার ও আবাদ সম্প্রসারণ করতে হবে। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের সক্রিয়তায় স্থানীয় বীজের প্রসার নির্বিঘ্ন হবে বলে প্রত্যাশা।

লেখক
ড:মিহির কুমার রায়
অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও
সাবেক ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি, ঢাকা  ও
সাবেক জ্যাষ্ট সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি,ঢাকা





47
পাট চাষে আগ্রহ হাড়াচ্ছে কৃষক


পাট বাংলাদেশের সোনালি আঁশ। বর্তমানে দেশে পাট চাষির সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় চার কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার সংস্থান হচ্ছে পাট চাষে। পাট শিল্পে ও পাটপণ্য রপ্তানির কাজে জড়িত আছেন প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক। জিডিপিতে পাটের অবদান প্রায় শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। কৃষি জিডিপিতে পাটের শরিকানা প্রায় ১ শতাংশ। মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ২ শতাংশ উপার্জন হয় পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি থেকে। তৈরি পোশাক শিল্পের পর এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। পাট থেকে আহরিত মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে কাঁচা পাট রপ্তানি থেকে। এক সময় পাট ও পাটজাত পণ্যই ছিল বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত। পাট থেকে আহরিত মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে কাঁচা পাট রপ্তানি থেকে। এক সময় পাট ও পাটজাত পণ্যই ছিল বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে মোট বৈদেশিক আয়ে পাটের অংশ ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা নেমে এসেছে ১ দশমিক ৮৮ শতাংশে। ১৯৫৮ সালে এ দেশে সাদা পাটের আওতাধীন জমির পরিমাণ ছিল শতকরা ৭৫ দশমিক ৪৮ ভাগ এবং তোষা ২৪ দশমিক ৫২ ভাগ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তোষা পাট শতকরা প্রায় ৮৯ ভাগ, সাদা পাট প্রায় ৪ ভাগ এবং মেস্তা ও কেনাফ প্রায় ৭ ভাগ জমিতে চাষ করা হয়। তোষা পাটের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ১৩ দশমিক ৬৪ বেল, সাদা পাটের উৎপাদন ৯ দশমিক ৭৩ বেল এবং মেস্তা ও কেনাফের গড় উৎপাদন ১০ দশমিক শূন্য ৬ বেল। সারাদেশে হেক্টরপ্রতি পাটের গড় উৎপাদন ১৩ দশমিক ২৪ বেল। নব্বইয়ের দশকে এ দেশে পাটের চাষ হতো প্রায় ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। ক্রমেই তা নেমে আসে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ হেক্টরে।

মাঠ গবেষণায় দেখা যায় একসময় রংপুর অঞ্চলের অর্থনীতির মূল প্রাণ ছিল পাট। কিন্তু এখন সেই ঐতিহ্য হারাচ্ছে। গত ২০ বছরে পাট চাষ কমেছে প্রায় ৭০%, ফলে হাজার হাজার কৃষক বেকার হয়েছেন। এর প্রধান কারণ বন্যা, ভালো বীজের অভাব এবং বাজারের অনিশ্চয়তা। তবে এবার নতুন পাট বাজারে ওঠায় এবং ভালো দাম পাওয়ায় কৃষক খুশি। রংপুর কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর (খরিফ-১ মৌসুমে) রংপুর বিভাগের আট জেলার (রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী) মোট ৫৪ হাজার ৬৬৯ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। প্রত্যাশা ৭ লাখ ৯ হাজার ৭৯৯ বেল পাট উৎপাদন হবে। উল্লেখ্য, গত তিন বছরে এই অঞ্চলে প্রতি বছর গড়ে দুইশ থেকে চারশ হেক্টর জমিতে পাট চাষ কমেছে। ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নীলফামারী জেলায় মোট ৫১ হাজার ৬২৭ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছিল। এ উৎপাদনে প্রায় ৭০ হাজার কৃষক যুক্ত ছিলেন। ২০২২ সালে, ৫৬ হাজার ৪১২ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়। ওই প্রায় ৭৫ হাজার কৃষক এতে জড়িত ছিলেন। গত ১০ বছরে এই অঞ্চলে পাট চাষের পরিমাণ প্রায় ৪০% কমেছে। আর গত ২০ বছরের হিসাবে এই হ্রাসের পরিমাণ ৭০%।

পাট চাষ কৃষি শ্রমিকদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করে। কৃষকরা পাট কাটার পর আমন ধানের চারা রোপণ করেন। এরপর প্রায় এক থেকে দেড় মাস তাদের হাতে কোনো কাজ থাকে না। এই সময়ে পাট জাগ দেওয়া ও আঁশ ছাড়ানোর কাজ করে কৃষি শ্রমিকরা কর্মসংস্থান পান।তবে পাট চাষ কমে যাওয়ায় কাজের সুযোগও কমে গেছে। কৃষি শ্রমিকের বাজারও ছোট হয়ে আসছে। তবে আশার কথা, এই বছর নতুন পাট বাজারে উঠতে শুরু করেছে। প্রতি মণ পাট মানভেদে ৩,০০০ থেকে ৩,২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে কৃষকরা কিছুটা লাভবান হচ্ছেন। এছাড়াও, প্রতি মণ পাটকাঠি ৭০০ থেকে ১,০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাটকাঠি এখন আর শুধু জ্বালানি নয়, এটি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। পাটকাঠি দিয়ে হার্ডবোর্ড তৈরি হয়। এছাড়াও, বিশেষ প্রক্রিয়ায় পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করা হয়, যা গুঁড়ো করে কার্বন ও ডিজিটাল প্রিন্টারের কালি বানানো হয়। পাট চাষ এখন কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক ফসল।

লালমনিরহাটের কৃষক মো. আশরাফ দুই একর জমিতে ৪৫ মণ পাট উৎপাদন করে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা আয় করেছেন। ৭০ মণ পাটকাঠি বিক্রি করে আরও ৪৯ হাজার টাকা আয়ের আশা করছেন তিনি। চাষের সব খরচ বাদ দিয়ে তার ৫০ হাজার টাকা লাভ হবে। কৃষক আব্দুস সাত্তার (৫০) জানান, একসময় উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল পাট। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই ফসলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। কিন্তু আধুনিকতার প্রভাব, চাষের খরচ বৃদ্ধি এবং ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় পাট চাষ এখন বিলুপ্তির পথে। তবে এই সংকট মোকাবিলায় সরকার পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করায় বাজারে কিছুটা গতি ফিরেছে। ভবিষ্যতে পাট চাষ বাড়াতে হলে কৃষকদের উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে এবং পাটের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে।

রংপুর পাট গবেষণা ও উন্নয়ন বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বন্যা, বীজের অভাব, পর্যাপ্ত পানির সংকট এবং বাজারের অনিশ্চয়তার কারণেই রংপুর বিভাগে পাট চাষের জমি ও উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমে আসছে। তবে আশার কথা হলো, চলতি খরিফ মৌসুমে উঁচু জমিতে পাট চাষের পর্যাপ্ত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অনাবৃষ্টির কারণে পাট জাগ দেওয়া (পচানো) নিয়ে একসময় কৃষকের মনে ভয় ছিল। কিন্তু আষাঢ় মাসের শেষের দিকে বৃষ্টি হওয়ায় খাল-বিলে পানি জমে যায় এবং শেষ পর্যন্ত পাট পচন নিয়ে বড় ধরনের কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক, কৃষিবিদ ড. মো. আবু সাইখুল আরিফিন জানান, পাট এখন কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক ফসল। কৃষক এই অঞ্চলে দুটি প্রধান ফসলের মাঝে পাট চাষ করতে পারেন। কারণ পাট কাটার পর আমন ধানের চারা রোপণ করা যায় । তিনি জানান, এই অঞ্চলের কৃষকরা এখনও সনাতন পদ্ধতিতে পাট আঁটি করে জাগ দেন। এতে পাটের মান ও রং খারাপ হয়ে যায়, শ্রমিক বেশি লাগে এবং উৎপাদন খরচও বাড়ে। তিনি কৃষকদের সনাতন পদ্ধতির বদলে ‘ফিতা রেটিং’ পদ্ধতিতে পাট জাগ দিতে উৎসাহিত করেন। এই পদ্ধতিতে কম পানি লাগে, প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজে আঁশ ছাড়ানো যায় ও উৎপাদন খরচও কমে।

এখন নীতিনির্ধারণী ও গবেষণা পর্যায়ে অনেক কিছু করার রয়েছে। পাট গবেষণার ক্ষেত্রে এ নাগাদ সাদা পাটের ১২টি উচ্চ ফলনশীল জাত পাওয়া গেছে। তোষা পাটের আটটি, কেনাফের চারটি ও মেস্তার তিনটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও অবমুক্ত করা হয়েছে। এগুলোর সম্প্রসারণ চলছে মাঠ পর্যায়ে। বর্তমানে পাটের গড় ফলন পৃথিবীর পাট উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই বেশি। এর পেছনে কৃষি বিজ্ঞানীদের এবং বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের অবদান অনস্বীকার্য। সম্প্রতি পাটের বংশ গতি বিন্যাস (জেনোম সিকুয়েন্স) উদ্ভাবন হয়েছে। তাতে রোগ ও পোকা প্রতিরোধক আরো উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে। হচ্ছে। এখন আমাদের এমন পাটের জাত উদ্ভাবন করতে হবে যা খরা, লবণাক্ততা ও শীতসহিষ্ণু। সারা বছর উৎপাদন উপযোগী পাটজাত উদ্ভাবন এখন সময়ের দাবি। এরই মধ্যে বছরে দুবার অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি ও মে মাসে পাট বোনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাতে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। তবে গবেষণার মাঠে নতুন উদ্ভাবিত পাট জাতের ফলন যত বেশি, কৃষকের মাঠে তত বেশি নয়। গবেষণা ও কৃষকের মাঠে প্রাপ্ত উৎপাদনে প্রায় ৪০ শতাংশ ফারাক বিদ্যমান। এটি কমাতে হবে। এর জন্য গবেষণা ও সম্প্রসারণের মধ্যে জোরাল সমন্বয় প্রয়োজন। পাট গবেষণা ও সম্প্রসারণে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন ৷ তার সঙ্গে বাজার স্থিতিশীল রাখতে সচেষ্ট হতে হবে। পাট সংশ্লিষ্ট শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে।

ড. মিহির কুমার রায়
লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক

Source: https://www.dainikbangla.com.bd/opinion/57493
48
কর্মশক্তি কৌশল ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা


চলমান প্রযুক্তিগত বিপ্লব আমাদের অর্থনীতি, শিল্প, প্রশাসন ও কর্মজীবনে দ্রুত পরিবর্তন আনছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), রোবোটিকস, স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি একদিকে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে, অন্যদিকে অনেক প্রচলিত কাজের প্রয়োজনীয়তাও কমিয়ে দিচ্ছে। এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আন্তর্জাতিক অস্থিরতা শ্রমবাজারকে আরো জটিল করে তুলছে। তাই ভবিষ্যতে দরকার এমন দক্ষতা, যা শুধু প্রযুক্তি জানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে ধারণা, পাশাপাশি সৃজনশীলতা ও সমালোচনামূলক চিন্তার মতো মানবিক গুণও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতামূলক ও টেকসই রাখতে হলে এ পরিবর্তনগুলো আগেভাগে বুঝে কর্মশক্তি পরিকল্পনা নিতে হবে। নিয়োগকর্তা ও কর্মী দুই পক্ষকেই নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। সবচেয়ে জরুরি উচ্চ শিক্ষার সংস্কার, যাতে স্নাতকরা শুধু চাকরির যোগ্যতা নয়, বরং ভবিষ্যতের অর্থনীতির চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা ও মানসিকতা অর্জন করতে পারে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতাও ঝুঁকির মুখে পড়বে।

গত তিন দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মূলত তৈরি পোশাক, রেমিট্যান্স ও কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারে, যার মধ্যে ৮০ শতাংশেরও বেশি এসেছে পোশাক খাত থেকে। একটি মাত্র খাতের ওপর এত বেশি নির্ভরশীলতা নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে যখন বিশ্ব এরই মধ্যে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছে। তাই বাংলাদেশের জন্য এখন জরুরি নতুন খাত চিহ্নিত করা, যেখানে প্রযুক্তি, দক্ষতা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা অর্জন করা সম্ভব। ওষুধ শিল্প, তথ্য-প্রযুক্তি, কৃষি-প্রযুক্তি, ডিজিটাল সেবা এবং সবুজ উৎপাদন এসব খাত রফতানিকে বৈচিত্র্যময় করতে ও অর্থনীতিকে আরো স্থিতিশীল ভিত্তি দিতে পারে। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) এবং উদ্যোক্তা কার্যক্রমের নতুন পথ অনুসন্ধানও টেকসই সমাধান হতে পারে। সঠিকভাবে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের জন্য তৈরি পোশাকনির্ভর প্রবৃদ্ধির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে।

অন্যদিকে অনেক প্রচলিত কাজ ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে। তাই সৃজনশীলভাবে চিন্তা করা, দ্রুত অভিযোজিত হওয়া এবং নতুন দক্ষতা অর্জন অত্যন্ত জরুরি। ভবিষ্যতের কর্মজগৎ গড়ে উঠছে হাইব্রিড ওয়ার্ক, রিমোট জব, গিগ ইকোনমি ও উদ্যোক্তা বৃত্তির ওপর ভিত্তি করে। কর্মীদের তাই আরো নমনীয়, অভিযোজ্য ও স্বনির্ভর হতে হবে। পাশাপাশি চাকরি পরিবর্তন ও নতুন শিল্পে প্রবেশ করা সাধারণ ব্যাপার হয়ে উঠবে। এর মানে প্রতিটি ব্যক্তিকে সারাজীবন শেখা ও পুরনো ধারণা ভুলে নতুন দক্ষতা আয়ত্ত করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।

বিশেষভাবে গুরুত্ব পাওয়া ক্ষেত্র হলো সাইবার নিরাপত্তা। যত বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্লাউড কম্পিউটিং, ডিজিটাল লেনদেন ও রিমোট ওয়ার্কের মাধ্যমে অনলাইনে চলে যাচ্ছে, তত বেশি র‍্যানসমওয়্যার, ফিশিং, ডাটা চুরি এবং সাইবার হামলার ঝুঁকি বাড়ছে। প্রতিটি সংযুক্ত সিস্টেম নতুন দুর্বলতা তৈরি করছে। তাই সাইবার নিরাপত্তা ও নেটওয়ার্ক রক্ষা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন দক্ষতার একটি হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে। ভবিষ্যতের কর্মজগতে টিকে থাকতে পার্থক্য গড়ে দেবে—দৃঢ়তা, নমনীয়তা ও অভিযোজন ক্ষমতা, সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দক্ষতা, গুণগত মাননিয়ন্ত্রণ, প্রোগ্রামিং ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান। বাংলাদেশ যদিও এসব বিষয়ে পিছিয়ে আছে। এটা বড় সমস্যা নয়। বরং অগ্রণী দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে শেখার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরাসরি আধুনিক, সাশ্রয়ী ও সম্প্রসারণযোগ্য স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং সিস্টেমে প্রবেশ করতে পারে। সঠিক নীতি ও মানবসম্পদ বিনিয়োগ থাকলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাকের বাইরে রফতানি বৈচিত্র্য আনতে এবং বৈশ্বিক শিল্প ব্যবস্থায় নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে সক্ষম হবে।

বাংলাদেশকে পুরনো ও ব্যয়বহুল স্বয়ংক্রিয়তা নয়, বরং আধুনিক ও নমনীয় স্মার্ট সমাধানের পথে এগোতে হবে। একই সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে এমন কর্মশক্তি, যারা সাংগঠনিক ও মানসিক দক্ষতা (বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা, সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধান, বহুভাষিকতা, পাঠ্য ও গাণিতিক জ্ঞান), প্রযুক্তিগত দক্ষতা (প্রযুক্তি সাক্ষরতা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও বিগ ডাটা, সাইবার নিরাপত্তা, প্রোগ্রামিং, ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা নকশা) এবং মানবিক দক্ষতা (দৃঢ়তা, অভিযোজন, নেতৃত্ব, সহমর্মিতা, জীবনব্যাপী শেখার মনোভাব, পরিবেশ-সচেতনতা ও বৈশ্বিক নাগরিকত্ব) অর্জন করবে। এ সমন্বিত দক্ষতা বাংলাদেশকে ভবিষ্যতের কর্মবাজারে প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে।

গত দুই দশকে ভিয়েতনাম, ভারত ও চীন শ্রমনির্ভর শিল্প থেকে উচ্চমূল্য সংযোজিত উৎপাদনের দিকে রূপান্তর করেছে। তাদের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশকে পথ দেখাতে পারে। ভিয়েতনাম দেখায় কীভাবে প্রযুক্তিনির্ভর প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণ করা যায়। ভারত শেখায় কীভাবে উদ্ভাবন ও দক্ষতাভিত্তিক ইকোসিস্টেম তৈরি করা যায়। চীনের অভিজ্ঞতা বলে দেয় কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি নীতি, গবেষণা ও উন্নয়ন এবং শিল্পকেন্দ্রিক গুচ্ছ তৈরি করে স্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব।

বাংলাদেশেও স্বয়ংক্রিয়তা, আইওটি রক্ষণাবেক্ষণ ও ডিজিটাল গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের মতো ক্ষেত্রে পুনঃদক্ষীকরণ ও দক্ষতা উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। শিল্প-বিশ্ববিদ্যালয় সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করলে তা কর্মশক্তিকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করবে।

বাংলাদেশের কর্মশক্তি কৌশল এগিয়ে নিতে তিনটি পদক্ষেপ জরুরি। প্রথমত, উচ্চ শিক্ষাকে শিল্পের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য করা। দ্বিতীয়ত, সারাজীবন শেখা ও পুনঃদক্ষীকরণের সুযোগ বাড়ানো। তৃতীয়ত, গবেষণা, উদ্ভাবন, সাইবার নিরাপত্তা ও ডিজিটাল অবকাঠামোয় নীতিগত বিনিয়োগ বাড়ানো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের পাঠ্যক্রম, শিক্ষণ পদ্ধতি ও শেখার প্রক্রিয়া আধুনিক করতে হবে, যাতে স্নাতকরা শুধু সনদ নয়, বরং ভবিষ্যতের চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারে।

এ পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি তৈরি পোশাক শিল্পের শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আরো বহুমুখী ও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। ফলে একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী জ্ঞানভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। পৃথিবী দ্রুত বদলাচ্ছে। টিকে থাকতে এবং সফল হতে হলে আমাদেরও বদলাতে হবে। শুধু বইয়ের পড়াশোনা নয়, প্রযুক্তি বোঝা, নতুন টুল ব্যবহার করা, সৃজনশীল হওয়া এবং নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতাই এখন সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি।

এমএম শহিদুল হাসান: ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও অধ্যাপক (অব.), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

Source: https://bonikbarta.com/editorial/J6gXlsI4W3NYbKpJ
49
Technology / Advanced automation will lead the way
« Last post by Badshah Mamun on September 01, 2025, 02:11:34 PM »
Advanced automation will lead the way
The future of Bangladesh’s economy depends on smart manufacturing


Smart manufacturing -- powered by automation, robotics, data analytics, the Internet of Things (IoT), and artificial intelligence (AI) -- is reshaping industrial landscapes in advanced economies such as Germany, South Korea, China, and the United States.

In this transformation, IoT acts as the “eyes and ears,” collecting and transmitting data, while AI serves as the “brain,” analyzing information and guiding decisions. Together, they make industries smarter, safer, and more efficient.

Bangladesh, though a latecomer, cannot afford to overlook this shift if it wants to sustain export competitiveness and move up the global value chain.

At present, Bangladesh’s industrial base is dominated by labour-intensive sectors, particularly ready-made garments (RMG), light engineering, leather, and basic manufacturing. These industries have thrived on the advantage of low-cost labour.

Today, economic growth is driven by export-oriented industries, domestic demand, and remittance inflows.

The RMG sector alone accounts for more than 80% of export earnings. But in the present era, this model is no longer sufficient.

Global buyers in Europe, North America, and East Asia now demand speed, zero-defect quality, full traceability, and demonstrable sustainability.

Advances in automation, AI, digital design, and smart supply chains are changing the rules of the game: Buyers no longer reward only low prices but also agility, predictability, and verifiable environmental and social performance.

For Bangladesh, clinging to a purely labour-cost advantage is a risky strategy -- one that will yield diminishing returns as competitors embrace technology and brands shift orders to suppliers that can meet these new standards.

Yet this is not a fatalistic argument. Bangladesh’s RMG sector can survive and thrive in the 4IR -- if it chooses transformation over complacency.

That survival, however, will not be passive. It requires coordinated action by factories, buyers, financial institutions, and the state to upgrade technology, skills, energy systems, and governance.

The challenge is to keep the RMG engine running while accelerating diversification into higher-value manufacturing and digital services. The goal is twofold: Reduce macro-economic risk from overdependence on a single sector and capture higher margins and resilience through technology-enabled products and services.

Globally, Industry 4.0 and smart factories mean that cost efficiency alone will no longer guarantee market share. To sustain growth and remain competitive, Bangladesh must identify emerging sectors where technology, skills, and innovation can create a decisive edge.

The opportunities are clear: Pharmaceuticals, ICT, agro-tech, digital services, and green manufacturing could diversify exports and build a more resilient, future-ready economy. If managed wisely, the 4IR could be the turning point that propels Bangladesh beyond its garment-driven growth model.

Pharmaceuticals -- blockchain and digital tagging (RFID/QR codes) can ensure end-to-end traceability. Smart R&D, robotic packaging, and precision instruments can help Bangladesh move into high-value exports such as biosimilars, vaccines, and medical equipment.

Agro-tech and food processing --  agriculture still employs a large share of Bangladesh’s workforce. Smart food processing, IoT-enabled cold-chain logistics, sensor-based quality sorting, and automated packaging can raise farmers’ incomes and strengthen processed food exports.

Smart packaging and blockchain traceability will also boost Bangladesh’s position in organic food markets.

Light engineering and electronics -- 3D printing and smart prototyping can supply spare parts. The domestic electronics market (TVs, refrigerators, mobile phones) can be a foundation for export-oriented production. Smart manufacturing can position Bangladesh as a supplier of precision parts and components in global automotive and machinery value chains.

Digital services and ICT -- integration of IoT, AI, and software solutions can allow Bangladeshi firms to compete in regional markets for consumer electronics, IoT devices, and renewable energy components.

Green manufacturing and circular economy  --
Renewable energy integration is vital, since 4IR technologies are energy-intensive. Solar module assembly, inverter and battery-pack production, and small wind systems can contribute to both rural electrification and green branding. Recycling plants that turn industrial and urban waste into new feedstock can cut import dependence while reducing environmental risks.

Bangladesh is not yet ready for fully automated “lights-out” factories, but it is well-positioned for hybrid smart manufacturing: Selective automation, digital integration, sustainable production, and traceable supply chains. This model fits the country’s current industrial base, preserves employment, and satisfies the evolving demands of global buyers.

The shift, however, will not be easy. Bangladesh faces significant constraints: High upfront investment in automation, limited access to finance for SMEs, and a serious skills gap, as most workers are trained in traditional manufacturing.

To overcome these challenges, three measures are essential:
1. Upskilling and reskilling through large-scale training programs to prepare the workforce for new roles;
2. Technology diffusion, with programs that help SMEs adopt affordable and modular smart manufacturing solutions;
3. Policy support with financing, including targeted incentives, credit facilities, and partnerships to lower entry barriers for firms.
4. Bangladesh may be behind global frontrunners, but this is not necessarily a disadvantage. By learning from the experiences of early adopters,
5. Bangladesh can leapfrog into modular, scalable, and cost-efficient smart manufacturing systems, avoiding outdated models.

If supported by coherent policies and strategic investment in human capital, smart manufacturing could become the catalyst that propels Bangladesh beyond its garment-dependent growth path -- towards a more diversified, resilient, and future-ready economy.

Author:
MM Shahidul Hassan is Distinguished Professor, Eastern University, and Professor (retd), BUET.

Source: https://www.dhakatribune.com/opinion/op-ed/390177/advanced-automation-will-lead-the-way

50
মনকে নিজের আয়ত্বে আনুন

মনকে নিজের আয়ত্বে আনুন, এটাই হল আকবরী হজ; হাজার হাজার কা'বা থেকে একটি হৃদয় অতি উত্তম

একটি প্রবাদ যা আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে আলোড়ন সৃষ্টি করে, আমাদের জীবনের লক্ষ্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখায়। সেই প্রবাদটি হলো – "মনকে নিজের আয়ত্বে আনুন, এটাই হল আকবরী হজ; হাজার হাজার কা'বা থেকে একটি হৃদয় অতি উত্তম।"

এই বাক্যটি আপাতদৃষ্টিতে সরল মনে হলেও, এর গভীরতা অসীম। হজ ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম, যা প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য অবশ্য পালনীয়। কা'বা শরীফ মুসলিমদের পবিত্রতম স্থান, যেখানে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মানুষ আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের আশায় ছুটে যান। তাহলে কেন একটি হৃদয়কে হাজার হাজার কা'বার থেকেও উত্তম বলা হচ্ছে?

এর কারণ হলো, বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের চেয়ে অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা এবং আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হজ একটি শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত, যা আমাদের পাপ মোচনের এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি মাধ্যম। কিন্তু যদি আমাদের মন কলুষিত থাকে, হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার আর পার্থিব লোভ-লালসায় পরিপূর্ণ থাকে, তাহলে শুধু বাহ্যিক হজের মাধ্যমে প্রকৃত মুক্তি লাভ করা সম্ভব নয়।

অন্যদিকে, একটি বিশুদ্ধ হৃদয় আল্লাহর আরশস্বরূপ। যে হৃদয়ে ভালোবাসা, সহানুভূতি, ক্ষমা, এবং অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বিদ্যমান, সেই হৃদয় আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয়। যখন আমরা আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, কুপ্রবৃত্তি দমন করতে পারি এবং সৎগুণাবলী অর্জন করতে পারি, তখন আমরা যেন আমাদের অন্তরেই এক পবিত্র কাবা নির্মাণ করি।

আকবরী হজ বলতে এখানে সেই আধ্যাত্মিক যাত্রাকে বোঝানো হচ্ছে, যেখানে একজন মানুষ তার ভেতরের কুপ্রবৃত্তি ও অন্ধকারকে পরাজিত করে আত্মশুদ্ধির পথে অগ্রসর হয়। এই যাত্রা কোনো নির্দিষ্ট স্থান বা কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সাধনা।

হাজার হাজার কা'বা প্রদক্ষিণ হয়তো বাহ্যিক দিক থেকে অনেক বড় ইবাদত মনে হতে পারে, কিন্তু একটি বিশুদ্ধ হৃদয় আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস ও ভালোবাসার আবাসস্থল। যে হৃদয় অন্যের কষ্টে ব্যথিত হয়, অন্যের সুখে আনন্দিত হয়, এবং সর্বদা ন্যায় ও কল্যাণের পথে অবিচল থাকে – সেই হৃদয় নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে অধিক মূল্যবান।

আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহ আমাদের বাহ্যিক রূপ বা সম্পদের দিকে তাকান না, বরং তিনি আমাদের অন্তরের পবিত্রতা ও ভালোবাসার গভীরতা দেখেন। তাই আসুন, আমরা আমাদের বাহ্যিক ইবাদতের পাশাপাশি আমাদের অভ্যন্তরীণ জগতকে পরিশুদ্ধ করার দিকে মনোযোগ দেই।

আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখি। লোভ, মোহ, অহংকার, ঘৃণা – এই সমস্ত নেতিবাচক আবেগ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখি। ধৈর্য, সহনশীলতা, ক্ষমা, এবং ভালোবাসার মতো গুণাবলী নিজেদের মধ্যে লালন করি।

যখন আমরা আমাদের মনকে আয়ত্তে আনতে পারব, তখন আমাদের প্রতিটি কাজ ইবাদতে পরিণত হবে। আমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাস আল্লাহর স্মরণে ভরে উঠবে। তখন আমাদের হৃদয়ই হবে আমাদের আকবরী হজ, এবং সেই পবিত্র হৃদয় নিঃসন্দেহে হাজার হাজার কা'বার চেয়েও উত্তম হবে।

আমাদের অন্তরকে পবিত্র করি, আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করি এবং একটি সুন্দর, সহানুভূতিশীল সমাজ গড়ে তুলি।
Pages: 1 ... 3 4 [5] 6 7 ... 10